ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া সুখী পরিবারের সব সুখ নিয়ে চলে গেছেন
আকলিমা আক্তারকে পরিবারের সদস্যরা সুখী নামে ডাকতেন। হাসিখুশি সুখী সবাইকে সুখে রাখতে চাইতেন। সেই সুখী আজ বুধবার সকালে ডেঙ্গুতে মারা গেছেন। বিকেলে আকলিমার লাশ নিয়ে তাঁর স্বামী সাইফুল ইসলাম যখন ঢাকা থেকে ছুটছেন নোয়াখালীর দিকে, তখন এই দম্পতির দুই বছরও না হওয়া একমাত্র সন্তান সামিহা বিনতে ইসলাম জ্বর নিয়ে হাসপাতালের বিছানায়।
মুঠোফোনে সাইফুল ইসলাম বললেন, সুখী পরিবারের সব সুখ নিয়ে চলে গেছেন। নোয়াখালীতে গ্রামের বাড়িতে স্ত্রীকে দাফন করে তাঁকে ঢাকায় ফিরতে হবে মেয়ের কাছে—এ চিন্তাই এখন করতে হচ্ছে। জানালেন, আজই মেয়েকে হাসপাতালে ভর্তি করেছেন। পরিবারের সদস্য ছাড়াও তাঁদের দুজনের কয়েকজন সহকর্মী মেয়ের পাশে আছেন।
বাংলাদেশ রেলওয়ে ঢাকা ডিজেল লোকোমোটিভ ওয়ার্কশপে ট্রেড অ্যাপ্রেনটিস পদে কর্মরত ছিলেন আকলিমা আক্তার। কাকরাইলের ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় আজ সকাল আটটার দিকে আকলিমা মারা যান।
সিটি ব্যাংকে কর্মরত সাইফুল জানান, মায়ের লাশ দেখে অসুস্থ মেয়ে সামিহা এটুকু বুঝতে পেরেছে, নিশ্চয়ই মায়ের অসুখ হয়েছে বা ব্যথা পেয়েছে। তাই সে মায়ের মুখে আদর করে দিয়েছে। সবাইকে বলেছে মাকে ‘ওষুদ’ দিতে।
সাইফুল বললেন, ‘মেয়েটা ছোট হলেও অনেক কিছু বুঝতে পারে। মাকে আদর করে সে আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়েছে, যা দেখে আমার মনে হয়েছে, সে যে মাকে হারিয়ে ফেলেছে, তা সে বুঝতে পেরেছে। এতটুকুন বয়সে সে মাকে হারিয়ে ফেলল।’
সাইফুল-আকলিমা ২০২০ সালে বিয়ে করেন। রেলওয়ে কলোনিতে বরাদ্দ পাওয়া বাসাটি চার তলা এবং সেখানে গরম হওয়ায় তাঁরা গত মে মাসে উত্তর বাসাবোতে নিচতলায় বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন। গত শনিবার আকলিমার জ্বর আসে। প্রথমে সোমবার মতিঝিলের একটি হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করা হয়। অবস্থা খারাপ হলে সেখান থেকে তাঁকে কাকরাইলের হাসপাতালটিতে ভর্তি করা হয়েছিল।
সাইফুল তাঁদের সুখের সংসারের বর্ণনা দিচ্ছিলেন। বললেন, তাঁর স্ত্রী সুখী খুব যত্ন করে বাসাটি সাজাচ্ছিলেন। জ্বর হওয়ার আগেও ঘর সাজানোর নানা জিনিস কিনে এনেছিলেন। সুখী সারাক্ষণ সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন। খুব সচেতন ছিলেন। একই সঙ্গে দায়িত্ববানও ছিলেন। তাঁর বাবা ক্যানসারের রোগী। তাই বাবা, মা ও ছোট বোনকে নিজের বাসায় রেখেছিলেন। তাঁদের দায়িত্বও কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন।
আকলিমা ঘুরতে পছন্দ করতেন। ১১ নভেম্বর মেয়ের জন্মদিন, আর ডিসেম্বরের ২৮ তারিখ ছিল আকলিমার স্বামী সাইফুলের জন্মদিন। আর ১৮ অক্টোবর ছিল এই দম্পতির বিবাহবার্ষিকী। সাইফুল বলেন, আকলিমা এই দিনগুলো কীভাবে উদ্যাপন করবেন, তার সব পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন। সাইফুল চেয়েছিলেন, বিবাহবার্ষিকীতে স্ত্রীকে ‘সারপ্রাইজ গিফট’ দেবেন।
সাইফুল বলেন, ‘আমি আর আমার স্ত্রীকে কী সারপ্রাইজ দেব, সে–ই তো আমাদের সারপ্রাইজ দিয়ে চলে গেল। ও মরতে চাইত না। একা কোথাও থাকতে ভয় পেত। মারা যাওয়ার আগেও বারবার বলছিল, সে বাঁচতে চায়।’
সাইফুল ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মতিঝিলের যে বেসরকারি হাসপাতালে স্ত্রীকে ভর্তি করা হয়েছিল, সেখানে স্ত্রী ভালো চিকিৎসা পাননি। অনেক কষ্ট পেয়েছেন। তবে কাকরাইলের হাসপাতালটির চিকিৎসকেরা আন্তরিক ছিলেন, কিন্তু তখন হাতে সময় ছিল না।
৩০ বছর বয়সী আকলিমার ফুসফুসে পানি জমাসহ নানা শারীরিক জটিলতা দেখা দিলে তাঁকে কাকরাইলের হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়।
সাইফুল বলেন, ‘স্ত্রীকে যখন আইসিইউতে নেওয়া হচ্ছিল, তখন সে ছটফট করছিল। “মরে যাচ্ছি, মরে যাচ্ছি” বলে চিৎকার করছিল। আমি যেন তাঁর কাছ থেকে না যাই, বারবার বলছিল। মারা যাওয়ার আগে পানি খেতে চেয়েছিল। খুব কষ্ট পেয়ে সে মারা গেছে।’
ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে, তাই সাইফুল-আকলিমা দম্পতি মশা যাতে কামড় না দিতে পারে, তার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা করেছিলেন। জানালায় মশারির কাপড় লাগিয়েছিলেন। তবে শেষ রক্ষা আর হলো না। তাঁদের একমাত্র মেয়েকে জ্বরের জন্য সেগুনবাগিচায় বারডেম-২ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে, তবে তার এখনো ডেঙ্গু ধরা পড়েনি।
সাইফুল বলেন, ‘আকলিমা দেশ ছেড়ে চলে যেতে চাইত, এ কারণে আমাকে চাপও দিত। এখন তো সে পৃথিবী ছেড়েই চলে গেল।’
সাইফুল বলেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়লেও হাসপাতালগুলোর প্রস্তুতি তেমন নেই। ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকারের তেমন কোনো কার্যক্রমও চোখে পড়ছে না। অথচ ডেঙ্গুতে মানুষ মারা যাচ্ছে। যে পরিবারে কেউ মারা যাচ্ছেন, শুধু সেই পরিবারের সদস্যরাই এই কষ্ট ও যন্ত্রণাটা বুঝতে পারছেন।
আকলিমা তাঁর ফেসবুকে ইংরেজিতে লিখে রেখেছেন, ‘স্মাইল টু সলভ প্রবলেম, সাইলেন্স টু সলভ প্রবলেম।’ তবে সদা হাস্যোজ্জ্বল থেকেও আকলিমা ডেঙ্গু সমস্যার কোনো সমাধান করতে পারলেন না।