বিগত আট বছরের মধ্যে ২০২২ সালে সড়কে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের বার্ষিক দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে সড়কের এ চিত্র উঠে এসেছে। বিদায়ী বছরে সড়ক, রেল ও নৌপথে ৭ হাজার ৬১৭টি দুর্ঘটনায় ১০ হাজার ৮৫৮ জন নিহত হন। আহত হন ১২ হাজার ৮৭৫ জন।
আজ সোমবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে যাত্রী কল্যাণ সমিতি আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী এ প্রতিবেদন তুলে ধরেন। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সড়ক, রেল ও নৌপথে দুর্ঘটনার সংবাদ পর্যবেক্ষণ করে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
এতে বলা হয়, বিদায়ী বছরে ৬ হাজার ৭৪৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৯ হাজার ৯৫১ জন নিহত হন। আহত হন ১২ হাজার ৩৫৬ জন। একই সময় রেলপথে ৬০৬টি দুর্ঘটনায় ৫৫০ জন নিহত হন। আহত হন ২০১ জন। নৌপথে ২৬২টি দুর্ঘটনায় ৩৫৭ জন নিহত ও ৩৫৭ জন আহত হন। নৌ দুর্ঘটনায় ৭৪৩ জন নিখোঁজ হয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বিদায়ী বছরে ২০২১ সালের চেয়ে সড়কে দুর্ঘটনা ১৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ আর প্রাণহানি ২৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ বেড়েছে। বিগত আট বছরের মধ্যে ২০২২ সালে সড়কে সর্বোচ্চ দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে বলেও পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে।
বিগত আট বছরে বিশেষ করে মোটরসাইকেল ও ইজিবাইকের সংখ্যা চার গুণ বৃদ্ধির পাশাপাশি সরকারি আদেশ অমান্য করে জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে ইজিবাইক, মোটরসাইকেল ও থ্রি-হুইলারের অবাধে চলাচলের কারণে দুর্ঘটনা বেড়েছে বলে পর্যবেক্ষণে বলা হয়।
সবচেয়ে বেশি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, বিদায়ী বছরে সড়কে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে মোটরসাইকেল। এ সংখ্যা দুর্ঘটনাকবলিত মোট ৯ হাজার ৬১৬টি যানবাহনের ২৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
সড়ক দুর্ঘটনায় এরপরই রয়েছে ট্রাক, পিকআপ, কাভার্ড ভ্যান ও লরি; যা ২৪ দশমিক ৫০ শতাংশ। দুর্ঘটনাকবলিত বাসের পরিমাণ ১৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ আর ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইকের পরিমাণ ১১ দশমিক ৪২ শতাংশ।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, আগের বছরের তুলনায় ২০২২ সালে বাস দুর্ঘটনা ৩ দশমিক ১৯ শতাংশ, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ৩ শতাংশ, ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান-ইজিবাইক দুর্ঘটনা ২ দশমিক ৭৪ শতাংশ আর সিএনজিচালিত অটোরিকশা দুর্ঘটনা ২ দশমিক ৫১ শতাংশ বেড়েছে। তবে বিদায়ী বছরে ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান-লরি দুর্ঘটনা ৫ দশমিক ৯২ শতাংশ ও নছিমন-মাহিন্দ্রা-লেগুনা দুর্ঘটনা ১ দশমিক ৩২ শতাংশ কমেছে।
সংগঠনটির পক্ষে বলা হয়, ৫২ দশমিক ৫৫ শতাংশ দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে পথচারীকে গাড়ি চাপা দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ২১ দশমিক ৬১ শতাংশ দুর্ঘটনায় যানবাহনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে। আর ১৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ দুর্ঘটনা যানবাহন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ার ঘটনায় ঘটেছে।
পর্যবেক্ষণে বলা হয়, সড়ক দুর্ঘটনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ৩ হাজার ৯০ জন চালক, ১ হাজার ৫০৩ জন পথচারী, ১ হাজার ১৫০ জন নারী, ৭৯৪টি শিশু, ৮৮৫ জন শিক্ষার্থী, ৭৪২ জন পরিবহনশ্রমিক, ২৮৩ জন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, ১৬৮ জন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা–কর্মী, ১৩২ জন শিক্ষক, ৪৪ জন সাংবাদিক, ৩১ জন চিকিৎসক ও ১৮ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন।
দুর্ঘটনা বেশি আঞ্চলিক মহাসড়কে
দুর্ঘটনার ধরন বিশ্লেষণ করে সংগঠনটি বলছে, ২০২২ সালে মোট সংঘটিত দুর্ঘটনার ২৭ দশমিক ৭০ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ৫২ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে আর ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ ফিডার রোডে সংঘটিত হয়েছে। এ ছাড়া সারা দেশে সংঘটিত মোট দুর্ঘটনার ৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ ঢাকা মহানগরীতে সংঘটিত হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, আগের বছরের চেয়ে বিদায়ী বছরে ছোট যানবাহনের সংখ্যা হঠাৎ কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং এসব যানবাহন জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে অবাধে চলাচলের কারণে আঞ্চলিক মহাসড়কে ১২ দশমিক ৭৩ শতাংশ, জাতীয় মহাসড়কে ৩ দশমিক ৮১ শতাংশ আর রেলক্রসিংয়ে শূন্য দশমিক ১৬ শতাংশ দুর্ঘটনা বেড়েছে।
বিশ্লেষণে বলা হয়, ২০২২ সালে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে ১৫ জুলাই। এই দিনে ৩৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৩ জন নিহত ও ৯৭ জন আহত হয়েছেন। তবে সড়ক দুর্ঘটনায় এক দিনে সবচেয়ে বেশি নিহত হয়েছে ২৯ জুলাই। এদিন ২৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৪ জন নিহত ও ৮৩ জন আহত হন।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণে সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে প্রধানত বেপরোয়া গতি, বিপজ্জনক ওভারটেকিং, রাস্তাঘাটের নির্মাণত্রুটি, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের অবাধে চলাচল, যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা, চালকের অদক্ষতা, চালকের বেপরোয়া মনোভাব, চলন্ত অবস্থায় মুঠোফোন বা হেডফোন ব্যবহারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
এ ছাড়া মোটরসাইকেল ও সিএনজিচালিত অটোরিকশানির্ভর গণপরিবহন–ব্যবস্থার দিকে ধাবিত হওয়ার কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বেপরোয়াভাবে বাড়ছে বলে সংগঠনটির বার্ষিক পর্যবেক্ষণে তুলে ধরা হয়েছে।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সড়ক নিরাপত্তায় বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন, আইনের ত্রুটি চিহ্নিত করে সংস্কারপূর্বক ডিজিটাল পদ্ধতিতে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করে সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ ও বিধিমালা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন, আলাদা সড়ক নিরাপত্তা ইউনিট গঠন, সড়ক নিরাপত্তায় ইতিমধ্যে প্রণীত সুপারিশমালা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়ার সুপারিশ করেছে সংগঠনটি।
দুর্ঘটনা রোধে নেই উদ্যোগ, গবেষণা
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক বলেন, গত বছরে প্রায় ১০ হাজারের ওপর মানুষ মারা গেছেন শুধু সড়ক, রেল ও নৌ দুর্ঘটনায়। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ এখন বড় সমাবেশ করার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। অথচ এই মানুষদের যদি একসঙ্গে জমায়েত করা যেত, বড় সমাবেশ হতো।
মোজাম্মেল হক আরও দাবি করেন, বিশ্বে বিভিন্ন স্থানে যে যুদ্ধগুলো চলছে, সেখানেও এত মানুষ নিহত হয়নি। বর্তমান করোনাভাইরাস মহামারির পরিপ্রেক্ষিতেও এত মানুষ মারা যায়নি। সরকারের পক্ষ থেকে সড়ক শৃঙ্খলা ও দুর্ঘটনা রোধে যেসব সংস্থা কাজ করে, তাদের নেই কোনো উদ্যোগ, নেই গবেষণা।
এ সময় গণপরিবহন–বিশেষজ্ঞ আবদুল হক বলেন, সড়ক নিরাপত্তায় সেনাবাহিনীকে যুক্ত করা যেতে পারে। তারা যদি উন্নত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সড়কে শৃঙ্খলা আনতে পারে, তবে মানুষের নিরাপত্তা বাড়বে।