প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা সেন্ট মার্টিনে সভা করতে যাচ্ছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি দ্বীপটিতে থাকা জেলা প্রশাসনের তথ্য ও সেবাকেন্দ্রে কমিটির ৩৩তম সভা ডাকা হয়েছে।
কমিটির একজন সদস্য বলেছেন, সেন্ট মার্টিন দ্বীপের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা করাই তাঁদের লক্ষ্য। সরেজমিনে পরিদর্শন করে তাঁরা দ্বীপটি নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করবেন।
অবশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দ্বীপটির পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য কেন নষ্ট হচ্ছে, তা সবার জানা। সমস্যাগুলো চিহ্নিত। সমাধানে নানা নির্দেশনা অতীতে দেওয়া হয়েছে। দরকার সেই সব পদক্ষেপের বাস্তবায়ন। সেটা না করে সংসদীয় কমিটির সভা সেন্ট মার্টিন দ্বীপে আয়োজনের উদ্যোগ ভ্রমণ ছাড়া আর কিছু নয়। এই কমিটির সুপারিশ করা ছাড়া কোনো ক্ষমতাও নেই।
বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্বাংশে অবস্থিত সেন্ট মার্টিন দেশের একমাত্র প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ। এটি কক্সবাজার জেলা শহর থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে সাগরবক্ষে অবস্থিত। আয়তন ৮ বর্গকিলোমিটার। পরিবেশ আইন অনুযায়ী, এটি একটি প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা।
বৈঠকে কারা থাকবেন
সংসদ সচিবালয়ের কমিটি শাখা-৫–এর এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, কমিটির সব সদস্য সভায় থাকবেন। এই কমিটির সভাপতি ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের সংসদ সদস্য র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী। সদস্যরা হলেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী মাহবুব আলী, সংসদ সদস্য মোশাররফ হোসেন, কাজী ফিরোজ রশীদ, তানভীর ইমাম, আশেক উল্লাহ রফিক, আনোয়ার হোসেন খান, শেখ তন্ময়, সৈয়দা রুবিনা আক্তার ও কানিজ ফাতেমা আহমেদ।
বৈঠকে সাচিবিক সহায়তা দিতে যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে সংসদ সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোশারফ হোসেন মোল্লার।
কমিটির সভাপতি র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর একান্ত সচিব হুমায়ুন কবীর, উপপরিচালক (রিপোর্টিং) সেলিম মৃধা ও কমিটি শাখা ৫–এর কর্মকর্তা খুর্শিদা খাতুনও সফরসঙ্গীর তালিকায় রয়েছেন।
বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সফরে স্থায়ী কমিটির সভাপতি, সদস্য ও জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের অংশগ্রহণকারী সব কর্মকর্তা সরকারি বিধি অনুযায়ী তাঁদের ভ্রমণভাতা (টিএ) ও দৈনিক ভাতা (ডিএ) প্রাপ্য হবেন। সভাটির ক্ষেত্রে স্পিকারের অনুমতি রয়েছে।
জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধির ২০০ নম্বর ধারায় বলা আছে, জাতীয় সংসদের সীমার মধ্যে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক বসবে। প্রয়োজন হলে স্পিকারের অনুমতি নিয়ে বাইরে সভা করা যাবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে লোকপ্রশাসন বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণত কমিটির বৈঠক সংসদ ভবনের সীমার মধ্যেই হয়ে থাকে। এটাই রেওয়াজ। তবে কার্যপ্রণালি বিধিতে সংসদের বাইরে সভা করার সুযোগ আছে। তবে এমন ঘটনা খুবই বিরল। তিনি বলেন, সৎ কিংবা ভালো কিছু করার উদ্দেশ্যে সেন্ট মার্টিনে যদি কমিটির সভা হয়, তবে সেটিকে ইতিবাচকভাবে দেখতে হবে। এর আগেও ঢাকার বাইরে অন্য কমিটির সভা হয়েছিল। যদিও সেখান থেকে ফলপ্রসূ কিছু হয়নি।
জাতীয় সংসদ সচিবালয় থেকে জারি করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কমিটির ৩৩তম বৈঠকে কক্সবাজার জেলায় গুরুত্বপূর্ণ পর্যটনশিল্পের অধিকতর উন্নয়ন, বিকাশ, সমস্যা ও সমাধান নিয়ে আলোচনা হবে। এ ছাড়া কক্সবাজার বিমানবন্দরে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের উন্নয়ন কার্যক্রম পর্যালোচনা করা হবে।
কমিটির সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেন্ট মার্টিনে বিচ্ছিন্নভাবে উন্নয়ন হচ্ছে। বড় বড় অবকাঠামো গড়ে উঠছে। পরিকল্পনা ছাড়া এসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। এতে সেখানকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে। আমরা সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ও সেখানকার জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করতে চাই।’ তিনি বলেন, কমিটির সদস্যরা সরেজমিন গিয়ে যা দেখবেন, তা-ই প্রতিবেদন আকারে জমা দেবেন। মূলত সেন্ট মার্টিন দ্বীপের বর্তমান চিত্র স্বচক্ষে দেখার লক্ষ্যেই পরবর্তী সভা সেখানে করা হচ্ছে।
দ্বীপটি বিপন্ন
প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সুরক্ষায় রয়েছে ১৪ বিধিনিষেধ। এতে বলা হয়েছে, দ্বীপে কোনো ধরনের পাকা স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। তবে সেন্ট মার্টিনে এখন ভবন আছে ১৩৮টির বেশি। অথচ মাত্র চার বছর আগে ২০১৮ সালে এ ধরনের স্থাপনা ছিল মাত্র ৪৮টি। অর্থাৎ এই চার বছরে ৯০টির মতো স্থাপনা নির্মিত হয়েছে। এখনো কমপক্ষে ৩০টি স্থাপনার নির্মাণকাজ চলছে।
সেন্ট মার্টিনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ও ১৩ দফা নির্দেশনা দিয়েছিল। সেটা নিয়ে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে সেন্ট মার্টিনের একটি আবাসিক হোটেলের সম্মেলনকক্ষে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এতে সভাপতিত্ব করেন।
বিগত বছরগুলোতে এমন আরও অনেক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তা কাগজেই রয়ে গেছে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষক ও এক শিক্ষার্থীর এক গবেষণা নিবন্ধে বলা হয়, ১৯৮০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৩৮ বছরে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে প্রবাল প্রজাতি ১৪১টি থেকে কমে ৪০টিতে নেমেছে। বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা সাড়ে চার বর্গকিলোমিটার থেকে কমে তিন বর্গকিলোমিটারে নেমেছে। বিপরীতে বাড়ছে পর্যটক। তাঁদের আবাসনের জন্য নতুন হোটেল ও অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে।
দ্বীপের মধ্যভাগের গলাচিপা এলাকায় পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যালয়। একজন কর্মকর্তাকে ওই কার্যালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হলেও তিনি বেশির ভাগ সময় অবস্থান করেন কক্সবাজার শহরে।
এদিকে পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ‘সেন্ট মার্টিন দ্বীপের পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা এবং টেকসই পর্যটন’ শীর্ষক নীতিমালার খসড়ায় দ্বীপটিতে পর্যটক সীমিত করা ও রাতে অবস্থান নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়েছিল। এ বিষয়ে আপত্তি জানায় পর্যটন মন্ত্রণালয়। নীতিমালাটি এখনো পাস হয়নি।
‘নতুন করে জানার কিছু নেই’
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, সংসদীয় কমিটির সদস্যরা গিয়ে যদি সেন্ট মার্টিনের সমস্যার উদ্ভাবনী কোনো সমাধান দিতে পারেন, তাহলে যাওয়া ঠিক আছে। তবে দ্বীপটির সমস্যার বিষয়ে নতুন করে কিছু জানার নেই, সমাধানের বিষয়েও নতুন কিছু বলার নেই। তিনি বলেন, টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিনে যাওয়ার জাহাজ বন্ধের পর ব্যবসায়ীরা যেভাবে চাপ দিলেন, সরকার যেভাবে হার মানল, তাতেই বোঝা যায়, দ্বীপটিতে পর্যটক নিয়ন্ত্রণের কোনো ইচ্ছা সরকারের নীতিনির্ধারণকারীদের মধ্যে নেই।