মোহাম্মদপুরে হঠাৎ বেড়েছে ছিনতাই–ডাকাতি

সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির প্রতিবাদে মোহাম্মদপুর থানার সামনে বিক্ষোভ করেন এলাকাবাসী। ঢাকা, ২৬ অক্টোবরছবি: দীপু মালাকার

বেসরকারি একটি টেলিভিশনে প্রচারিত খবরে দেখা যায়, একটি সুপারশপে মুখোশ পরা ডাকাতেরা চাপাতি দেখিয়ে কর্মচারীদের জিম্মি করে টাকা লুটে নিচ্ছে। শুক্রবার রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বছিলার গার্ডেন সিটি এলাকায় ওই ঘটনা ঘটে। 

২০ অক্টোবর সকালে মোহাম্মদপুর হাউজিং লিমিটেড এলাকায় দুটি মোটরসাইকেলে ছয়জন ছিনতাইকারী অস্ত্রের মুখে নেসলে কোম্পানির গাড়ি আটকে ১১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়।

কেবল এ দুটি ঘটনাই নয়, মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের আবাসিক এলাকা হিসেবে পরিচিত রাজধানীর মোহাম্মদপুরে হঠাৎ খুনখারাবি, ছিনতাই ও ডাকাতি বেড়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে সন্ত্রাসমুক্ত মোহাম্মদপুরের দাবিতে এলাকাবাসী গতকাল শনিবার বিকেলে মোহাম্মদপুর থানার সামনে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে। এমন অবস্থার জন্য তাঁরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দায়ী করেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দৃশ্যমান অগ্রগতির জন্য তাঁরা পুলিশকে তিন দিনের সময় বেঁধে দিয়েছে।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজধানীতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হয়নি। যানবাহন ও জনবল–সংকটে পুলিশের টহল কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হয়নি। এই সুযোগে অপরাধী চক্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পকেন্দ্রিক যুবকদের কেউ কেউ অপরাধ তৎপরতায় যুক্ত হয়েছেন; আর মোহাম্মদপুরে কিছু এলাকায় গড়ে উঠেছে নতুন সন্ত্রাসী গ্রুপ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চাকরিচ্যুত সদস্যদের কেউ কেউ ডাকাতি ও ছিনতাইয়ে যুক্ত হয়েছে।

জানতে চাইলে মোহাম্মদপুর থানার ওসি আলী ইফতেখার হাসান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, নানা কারণে মোহাম্মদপুর আগে থেকেই রাজধানীর অপরাধপ্রবণ এলাকাগুলোর একটি। ১০ শীর্ষ সন্ত্রাসীর বৃত্তান্ত খোঁজ করলে দেখা যায়, এর মধ্যে ছয়জনের জন্ম মোহাম্মদপুরে। জনবল–সংকটের কারণে পুলিশ সেখানে ঠিকমতো টহল দিতে পারছে না।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) হিসাব অনুযায়ী, ১ অক্টোবর থেকে ২৫ অক্টোবর অর্থাৎ গত ২৫ দিনে মোহাম্মদপুর থানায় চারটি হত্যাকাণ্ড, একটি ছিনতাই ও দুটি ডাকাতির মামলা হয়েছে। এর আগে সেপ্টেম্বর মাসে এই থানায় ১৭ খু্ন ও একটি ছিনতাইয়ের মামলা হয়।

বিভিন্ন সূত্র জানায়, মোহাম্মদপুরে প্রায় প্রতিদিনই ছিনতাই-ডাকাতির ঘটনা ঘটছে, যার বেশির ভাগই গণমাধ্যমে আসে না। ছিনতাইকারীর আঘাতে আহত হয়ে হাসপাতালে গেলে কিংবা থানায় মামলা হলে তা কেবল গণমাধ্যমে আসে। অনেকেই হয়রানির ভয়ে থানা-পুলিশ পর্যন্ত যেতে চান না। থানায় ছিনতাইয়ের যে পরিসংখ্যান লিপিবদ্ধ করা হয় তা প্রকৃত ঘটনার চেয়ে অনেক কম।

সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা

মোহাম্মদপুরে সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত ডাকাতির ঘটনা ঘটে ১১ অক্টোবর। সেদিন রাত সোয়া তিনটার দিকে তিন রাস্তার মোড়ে বেড়িবাঁধ এলাকায় ব্যবসায়ী আবু বকরের বাসায় ও কার্যালয়ে ডাকাতি হয়। সেনাবাহিনী ও র‌্যাবের পোশাক পরা ডাকাতেরা নিজেদের যৌথ বাহিনী বলে পরিচয় দেয়। তারা ৭৫ লাখ টাকা ও ৭০ ভরি সোনা লুট করে বলে গৃহকর্তা ও পুলিশ সূত্র জানায়।

ডাকাতির ঘটনায় র‍্যাবের সাবেক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও জড়িত বলে তথ্য পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদমর্যাদার ওই কর্মকর্তা র‍্যাব সদর দপ্তরের একটি শাখার প্রধান ছিলেন। এ ছাড়া এই ডাকাতির ঘটনায় র‍্যাব–৪–এ কর্মরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কয়েকজন সদস্যের (নন–কমিশন্ড) নাম এসেছে। তাঁদের বিষয়ে র‌্যাব ও সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও ঘটনাটি তদন্ত করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে। এই ডাকাতির ঘটনায় আটজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে র‍্যাব। মামলার তদন্ত সংস্থা ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) তিনজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে।

৫৬ সেকেন্ডের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এতে দেখা যায়, বৃহস্পতিবার রাজধানীর মোহাম্মদপুর নবীনগর হাউজিং এলাকায় এক তরুণী হেঁটে যাচ্ছেন। এক তরুণ এসে তাঁর গতিরোধ করে। এরপর আরও তিনজন এসে ওই তরুণীকে টানাহেঁচড়া করতে থাকে, তাঁর কাঁধে থাকা ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। এ ঘটনায় পুলিশ এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।

১০ অক্টোবর মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান এলাকায় ছিনতাইয়ে বাধা দেওয়ায় রবিউল ইসলাম (৩৫) নামে এক নিরাপত্তাকর্মীকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে ছিনতাইকারীরা।

স্থানীয় জনতার প্রতিবাদ

গতকাল বিকেলে মোহাম্মদপুর থানার সামনে শতাধিক মানুষের প্রতিবাদ কর্মসূচিতে স্থানীয় জনতা বলেন, অপরাধীরা অস্ত্র প্রদর্শন করে চাঁদাবাজি করছে। এমনকি বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক গ্যাংয়ের সদস্যরা গণডাকাতিও করছে। কিন্তু পুলিশ তাঁদের আইনের আওতায় আনতে পারছে না।

স্থানীয় জনতার পক্ষে জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য মুতাসিম বিল্লাহ ডাকাতি ও ছিনতাই নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য পুলিশকে ৭২ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেন। তিনি বলেন, এই সময়ের মধ্যে মোহাম্মদপুর এলাকায় পুলিশের টহল বাড়াতে হবে ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কিশোর গ্যাং, চাঁদাবাজি ও সহিংসতা বন্ধ করতে হবে। দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ দেখা না গেলে ছাত্র–জনতা মোহাম্মদপুর থানায় অবস্থান করবে।

প্রতিবাদ কর্মসূচি শেষে স্থানীয় জনতা মোহাম্মদপুর থানার ওসি আলী ইফতেখার হাসানের কক্ষে বৈঠক করেন। সেখানে তাঁরা পুলিশের তেজগাঁও অঞ্চলের অতিরিক্ত উপকমিশনার জিয়াউল হকের সঙ্গে কথা বলেন। স্থানীয় লোকদের বক্তব্য শুনে জিয়াউল হক বলেন, ৫ আগস্টের পর পুলিশের জনবল ও রসদসামগ্রীর ঘাটতি দেখা দিয়েছে। তা ছাড়া মোহাম্মদপুরে যেসব পুলিশ সদস্য আছেন, তাঁদের অধিকাংশই নতুন। এমন পরিস্থিতিতে তাঁরা স্থানীয় জনতার সহায়তা চান। এ জন্য আজ রোববার তাঁরা স্থানীয় জনতার সঙ্গে বসে পরবর্তী করণীয় ঠিক করবেন।

র‍্যাব-২–এর পরিচালক পুলিশের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক মোয়াজ্জেম হোসেন ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, অপরাধ ঘটনার পেছনে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব থাকতে পারে। অপরাধীদের ধরতে যৌথ বাহিনী ব্লক রেইড দিচ্ছে।