কেন চলে গেলেন আশকা, হিসাব মেলাতে পারছেন না বন্ধু-স্বজনেরা
শেষবার আলাপের সময় মা-মেয়ে একজন অন্যজনকে ‘দোস্ত’ বলে ডেকেছিলেন। মেয়ে ও মায়ের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের সম্বোধন ছিল দোস্ত। মেয়ে খেতে ভালোবাসেন, কিন্তু থাকেন দূরে। তাই প্রতি সপ্তাহে রান্না করে সাতক্ষীরা থেকে ঢাকাগামী বাসে খাবার পাঠিয়ে দিতেন মা। সেদিনও মেয়ের পছন্দের সব খাবার রান্না করেছিলেন। মেয়ে বাঁধাকপি দিয়ে গরুর মাংস খেতে ভালোবাসেন। মুলা, বেগুন দিয়ে পালংশাক। ভাদ্রের গরমে সুতির জামা আরামদায়ক, তাই মাকে বলেছিলেন, জামা বানিয়ে পাঠাতে। এসব পাঠানোর সব প্রস্তুতি শেষ করেছেন মা আর তখনই খবর পান, মেয়ে আর নেই।
কাজী সামিতা আশকা ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের ইতিহাস বিভাগের ৪৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের আমবাগান এলাকায় ভাড়া বাড়িতে থাকতেন তিনি। ১ সেপ্টেম্বর রাতে নিজের ঘর থেকে তাঁর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করেন ওই বাড়ির বাসিন্দা একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাঈশা নূসরাতসহ কয়েকজন। দরজা ছিল ভেতর থেকে বন্ধ। সবাই মিলে লাথি দিয়ে দরজা খুলতে হয়েছিল। ওই ঘটনার পর এক সপ্তাহ পার হলেও এখনো কেউ ফিরে যাননি সে বাসায়। মাঈশা নূসরাত বললেন, ভয় নয়, ভালোবাসার দায় থেকে ওই ফ্ল্যাটের কেউ মানতে পারছেন না আশকা নেই।
সামিতা আশকা আত্মহত্যা করতে পারেন, এমন কোনো ইঙ্গিত আগে পাননি পরিচিতজনেরা। তাঁদের ধারণা, কোনো এক বন্ধুর সঙ্গে কথা-কাটাকাটি থেকে অভিমান করে আত্মহত্যা করেছেন তিনি।
মাঈশা প্রথম আলোকে বললেন, ‘আশকা আপুর সঙ্গে এক বছর ধরে এক বাড়িতে থেকেছি। মানসিকভাবে খুব শক্ত একজন মানুষ। পরিবারের ব্যাপারে খুব আবেগী ছিলেন। সব সময় তাঁর মুখে ছোট ভাই আর বাবা-মায়ের গল্প থাকত।’
কাজী সামিতা আশকার বাড়ি সাতক্ষীরা সদরে। তাঁর সঙ্গে টেলিফোনে মায়ের সর্বশেষ কথা হয় মৃত্যুর আগের দিন ৩১ আগস্ট রাতে। আশকার বাবা কাজী শাফিউল আজিম ৮ সেপ্টেম্বর টেলিফোনে প্রথম আলোকে জানালেন, মেয়ের মৃত্যুর পর থেকে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন আশকার মা কাজী ফরিদা ইয়াসমিন। এক বছর আগে তাঁর হার্টে (হৃদ্যন্ত্রে) চারটি রিং পরানো হয়। এখন তাঁকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে অধিকাংশ সময় ঘুম পাড়িয়ে রাখা হচ্ছে। জেগে থাকলেই তিনি শুধু সন্তানের কথা বলে বিলাপ করে করে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।
আশকার একমাত্র ছোট ভাই কাজী সুয়াইব আয়াজ এইচএসসির ছাত্র। সাতক্ষীরায় বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকে। দুই ভাই-বোনের সম্পর্ক ছিল বন্ধুর চেয়ে বেশি। ছোট ভাইটি বোনের এমন আকস্মিক মৃত্যুর পর কথা বলা বন্ধ করেছে। দরজা বন্ধ করে ঘরে একা বসে থাকে।
আশকার বাবা বলছিলেন, ‘এত প্রাণপূর্ণ মেয়ে আমার, এত বেশি পরিবার ঘনিষ্ঠ, ওকে দিয়ে এমন ঘটনা কেউ কল্পনাও করতে পারে না।’
সামিতা আশকা সব সময় সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন। বন্ধুদের মধ্যে হয়ে উঠতেন দলনেতা। জবা ফুল তাঁর খুব প্রিয় ছিল জানিয়ে বাবা বলেন, ‘ওর মা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েকে দেখতে গিয়েছিল। দুজনে কানে ফুল গুঁজে ছবি তুলেছে। সেই মেয়ে কেন আত্মহত্যা করবে বলেন?’
কাজী সামিতা আশকার বন্ধু দল ছিল ১১ জনের। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের দলটিকে অন্যরা ডাকতেন ‘ওরা এগারোজন’ নামে। এই দলের একজন গিয়াসউদ্দিন মোল্লা। প্রথম আলো বন্ধুসভার সদস্য গিয়াসউদ্দিন বললেন, ‘আমরা বন্ধু ছিলাম। কিন্তু আশকার ব্যক্তিত্বটাই এমন ছিল, যেন সে সবার বড় বোন। আমাদের ও আগলে রাখত।’
আশকা শিশুশিল্পীদের প্রতিযোগিতা নতুন কুঁড়িতে পুরস্কার পেয়েছিলেন। সেই তথ্য উল্লেখ করে গিয়াসউদ্দিন বলেন, ‘সবকিছুতে ওর উপস্থিতি ছিল প্রবল। আশকা চলে যাওয়ার পর আমরা এখনো কেউ বিশ্বাস করি না ও নেই। আমরা নিজেদের সান্ত্বনা দিয়ে বলি, আশকা আসলে অন্য কোথাও, অন্য কোনো দেশে পড়তে গেছে। তাই ক্যাম্পাসে নেই। আশকা আবার ফিরবে।’
আশকা আর ফিরে আসবে না এই সত্যি মানতে পারছেন না এক ফ্ল্যাটে থাকা অন্য মেয়েরাও। ৮ সেপ্টেম্বর রাতে মাঈশা নূসরাত বললেন, ‘আশকা আপু আত্মহত্যা করেছেন, খবরটা প্রথম পাই তাঁরই এক বন্ধুর কাছ থেকে। এর কয়েক মিনিট আগে আমি বাসা থেকে বের হয়েছি। তখনো আমাকে বলেছেন, “ফেরার সময় আমার জন্য ফল নিয়ে আসিস।” আশকা আপু নেই, এটাই আমরা মানতে পারছি না এখনো।’
আজ রোববার (১০ সেপ্টেম্বর) আন্তর্জাতিক আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের গবেষণা বলছে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত আত্মহত্যা করেছেন ৩৬১ জন শিক্ষার্থী। গবেষণায় ধারণা পাওয়া যায়, এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৩১ দশমিক ৬০ শতাংশই নানা বিষয়ে শুধু অভিমান করে আত্মহত্যা করেছেন। ৯ সেপ্টেম্বর দিবসটি উপলক্ষে অনুষ্ঠিত সমীক্ষাবিষয়ক সেমিনারে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দীন আহমদ বলেন শিক্ষার্থীদের মানসিক শক্তি বৃদ্ধিতে শিক্ষক ও পরিবারের দিক থেকে জোর দেওয়ার কথা। আত্মহত্যা করার সব উপকরণ সহজলভ্য না রাখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি।
আজ দুপুরে আবার কথা হয় আশকার বাবা কাজী শাফিউল আজিমের সঙ্গে। তিনি বললেন, সন্তান দূরে থাকলে সব সময় তাকে নজরে রাখা সম্ভব হয় না সত্যি, কিন্তু এই কাজ বাবা-মাকে করতেই হবে। বাচ্চাদেরও বুঝতে হবে, বাবা-মায়ের জন্য সবচেয়ে ভারী সন্তানের লাশ।
শাফিউল আজিম বলেন, ‘মেয়েটার এমন মৃত্যুতে আমাদের পুরো পরিবার শেষ হয়ে গেল। কে ফোন করে ওর মামণিকে বলবে, “দোস্ত তুমি কী করো? আমার জন্য রান্না করে পাঠাও।” ওর মা আর আমি কী নিয়ে বাঁচব?’