হাসিনার সরকারকে হটানোর পর গণতন্ত্র পুনর্গঠনের কাজ করছেন শিক্ষার্থীরা

বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে কী ভাবছেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা, সংস্কার কমিশনগুলো কীভাবে কাজ করছে, নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর চাপ, দেশের অর্থনীতি কোন দিকে যাচ্ছে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য নিউইয়র্ক টাইমস। প্রতিবেদন করেছেন অনুপ্রিতা দাসসাইফ হাসনাত

২০২৪ সালের আন্দোলনের পুরো সময়ে শিক্ষার্থীদেরস্লোগান স্লোগানে মুখর ছিল রাজপথফাইল ছবি: প্রথম আলো

কয়েক দিন আগে ঢাকায় সন্ধ্যাবেলায় একটি বাণিজ্যিক ভবনের নিচতলায় গিয়ে দেখা গেল, সেখানে একেবারে নতুন একটি দপ্তর নির্মাণের কাজ চলছে। ছাদ থেকে তার ঝুলছে। নতুন মেঝে বানানো হচ্ছে। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি দল বাংলাদেশের নতুন ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের ছক কষছেন।

মাস কয়েক আগেও এই শিক্ষার্থীরা সেসব হাজারো মানুষের মধ্যেই ছিলেন, যাঁরা শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছেন। কর্তৃত্ববাদী শাসন, নৃশংসতা আর দুর্নীতিতে ডুবে ছিল শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামল।

এখন, এসব শিক্ষার্থী নতুনভাবে শুরু করতে বদ্ধপরিকর। রাষ্ট্র সংস্কারের প্রক্রিয়া যতই দীর্ঘস্থায়ী হোক কিংবা যতই প্রতিবন্ধকতা আসুক না কেন, তাঁরা বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী গণতন্ত্রের দেশ হিসেবে পুনর্গঠন করতে চান। তাঁরা একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং শাসনকাঠামোর স্বৈরাচার হয়ে ওঠা ঠেকাতে এমন একটি ব্যবস্থার কথা বলছেন; সেটা কোনো নেতাই উপেক্ষা করতে পারেননি।

২৬ বছর বয়সী ছাত্রসংগঠক আরিফ সোহেল বলেন, ‘আমাদের রাজনৈতিক শক্তি এই মুহূর্তে খুবই ধোঁয়াটে অবস্থানে আছে।’ শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ করে রাজনৈতিক দলগুলোকে বলিষ্ঠ বার্তা দেওয়ার আশাবাদের কথা জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এমন একটি দেশ চাই, যা স্থিতিশীল থাকবে এবং সামনে এগিয়ে যাবে।’

আজ থেকে ৫৩ বছর আগে ব্যাপক রক্তক্ষয়ের মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশের জন্য এটা বেশ দুঃসাধ্য একটি কাজ। আর এর ভার এমন একটি অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর বর্তেছে, যারা অনির্বাচিত এবং এই সরকার নানা মত–পথের মানুষের সংমিশ্রণে গঠিত হয়েছে। এঁদের অনেকেরই দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। আবার এমন শিক্ষার্থীও রয়েছেন, যাঁরা কেবল শুরু করেছেন। তাঁরা সবাই প্রচুর চাপের মধ্যে কাজ করছেন।

ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতন এ বছর বৈশ্বিক তাৎপর্যময় এক ঘটনা
ছবি: প্রথম আলো

শেখ হাসিনার আমলে দমন–পীড়নের শিকার একটি প্রধান রাজনৈতিক দলের দাবি, আনুষ্ঠানিকভাবে সংস্কার হোক বা না হোক, কয়েক মাসের মধ্যে নতুন নির্বাচন দিতে হবে। নানা চাপে থাকা নাগরিকেরা এরই মধ্যে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ভোগান্তিতে পড়েছেন। এ পরিস্থিতিতে চাল–তেলের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে।

একের পর এক বিক্ষোভে রাজধানী ঢাকায় জনজীবন ব্যাহত হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার অভিযোগ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উত্তেজনা বাড়িয়ে দিয়েছে। সেই সঙ্গে দেশে মুসলিম চরমপন্থার পুনরুত্থানের আশঙ্কাও রয়ে গেছে।

খুব অল্প সময়ের মধ্যে পুরোনো ব্যবস্থাকে উৎখাত করা হয়েছে। এখন সংস্কারে বেশ সময় লাগতে পারে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার ততটা সময় না–ও পেতে পারেন।

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাজধানীর রাজপথে মানুষের উল্লাস
ছবি: প্রথম আলো

অন্তর্বর্তী সরকার বড় বড় পরিকল্পনা সামনে আনতে চায়। এরপর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা বিস্তারিত সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে এটাও আশা করা হচ্ছে, বড় পরিসরে সংস্কার কার্যকর করা হবে। জনসাধারণ ও রাজনীতিবিদের থেকে, বিশেষ করে পরবর্তী সরকারে নেতৃত্ব দিতে পারেন এমন নেতারাও পরিবর্তনের পক্ষে সমর্থন দেবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

জনাব মজুমদারের কমিশন (নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার) এমন একটি ব্যবস্থার কথা বিবেচনা করছে, যেটা বাংলাদেশি প্রবাসীদেরও ভোট দেওয়ার সুযোগ এনে দেবে। ভোটকেন্দ্রে নারী ভোটারদের সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা এবং ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা হবে।

শত শত ই–মেইলে বাংলাদেশিরা বলতে দ্বিধা করছেন না যে যাঁরা বিভিন্ন দপ্তর ও সংগঠন চালাবেন, তাঁদের অবশ্যই নির্দিষ্ট শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত পূরণ করতে হবে।

বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘মানুষ মনে করে যে সংগঠন বা দপ্তর চালানোর মতো ওই সব ব্যক্তির প্রয়োজনীয় বোঝাপড়া ও জ্ঞান থাকতে হবে। তবে আমি মানুষকে এটাও বলতে চাই, সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সবাই উচ্চশিক্ষিত।’

শেখ হাসিনা গত আগস্ট মাসে পালিয়ে ভারতে যাওয়ার পর থেকে বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব ব্যাপক বেড়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর একজন ঘনিষ্ঠ মিত্র। অন্তর্বর্তী সরকার গত সোমবার বলেছে, শেখ হাসিনাকে বিচারের মুখোমুখি করার লক্ষ্যে তাঁকে দেশে প্রত্যর্পণ করার জন্য ভারতের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ জানিয়েছে তারা। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন, তাঁরা এ অনুরোধ পেয়েছেন। তবে এ বিষয়ে ‘কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি’ তিনি।

অন্তর্বর্তী সরকারের কাজের অগ্রগতি নিয়ে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, ‘কাজ এগোচ্ছে, কাজ এগোচ্ছে, কাজ এগোচ্ছে।’ ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দিকে বেশি নজর দেওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে মাহফুজ বলেন, ‘প্রথম দুই মাস সরকারের কাজ অনেকটা স্থবির ছিল। এখন সংস্কারকাজ চলছে এবং দেশ ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠছে।’

এখন অন্তর্বর্তী সরকার আরও দৃশ্যমান বিষয়ে, বিশেষ করে নির্বাচনী নিয়মকানুন হালনাগাদ করার মতো স্বল্পমেয়াদি সংস্কারকাজে মনোযোগ দিচ্ছে বলেও জানান মাহফুজ। সরকারে নারীদের প্রতিনিধিত্ব বাড়ানো, তরুণদের জন্য নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির মতো বিষয়গুলো বাস্তবায়নে আরও সময় লাগবে।

নৈতিক দায়িত্ব

বদিউল আলম মজুমদারের বয়স ৭৮ বছর। তিনি প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ, অধিকারকর্মী ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ। নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে তাঁর নিয়োগের বিষয়টি মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া টেলিভিশন ভাষণে ঘোষণা দিয়েছিলেন। এর কয়েক মিনিট আগে বদিউল আলম মজুমদার সেটা জানতে পারেন।

এই অভিজ্ঞতা হয় আলী রীয়াজেরও। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক। বাংলাদেশে সংবিধান সংস্কার কমিটির দায়িত্ব পেয়েছেন তিনি।

গত সেপ্টেম্বরে এমন ছয়টি সংস্কার কমিটি গঠন করেছেন মুহাম্মদ ইউনূস। মূলত সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদ, সরকারি কর্মকর্তা, নাগরিক সমাজ ও ছাত্র প্রতিনিধিদের নিয়ে এসব কমিটি করা হয়েছে। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর কাউকে রাখা হয়নি। এ মাসের মধ্যে সুপারিশ জমা দেওয়ার কথা কমিটিগুলোর।

বিদ্যমান দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) শক্তিশালী করার কাজ করছেন ইফতেখারুজ্জামান। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অর্থের বেআইনি প্রবাহ নিয়ে কয়েক দশক ধরে কাজের অভিজ্ঞতা আছে তাঁর।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এখন দরকার হলো সঠিক মানুষদের সঠিক জায়গায় বসানো। খারাপ মানুষদের প্রতিষ্ঠান থেকে সরিয়ে দেওয়া। আর মালিকানার বোধ তৈরি করা।’ তবে একে ‘বিশাল’ কাজ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আলী রীয়াজ বলেন, তিনি সংস্কার কমিশনের কাজকে ‘নৈতিক দায়িত্ব’ হিসেবে বিবেচনা করছেন। শেখ হাসিনার প্রশাসনের হাতে গত গ্রীষ্মের ছাত্র আন্দোলনের সময় চরম দমন–পীড়নে শত শত মানুষের প্রাণ হারানোর পর এটা তাঁর নৈতিক দায়িত্ব।

আলী রীয়াজ বলেন, বাংলাদেশের সংবিধান ‘সমতা, মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের’ আদর্শে পরিচালিত হয়েছিল। তাঁর লক্ষ্য সংবিধানের সেই আদর্শ পুনরুদ্ধার করা।

বিদ্যমান সংবিধান সংশোধন করা হবে নাকি নতুন করে তা লেখা হবে, সেই বিষয়ে বিতর্ককে স্বাগত জানান আলী রীয়াজ। তবে যাঁরা শেখ হাসিনার অগণতান্ত্রিক স্বৈরাচারী শাসনকে সমর্থন দেন বা বৈধ করতে চান, তাঁদের বিতর্কে আমন্ত্রণ জানানো হবে না বলেও সাফ জানিয়ে দেন তিনি।

আলী রীয়াজের প্রশ্ন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিকে যখন নতুন করে গড়ে তোলা হচ্ছিল, তখন কি কেউ নাৎসিদের সঙ্গে কথা বলেছিল?’ তিনি নিজেই এর জবাব দেন, ‘আমার মনে হয় না, তারা সেটা করেছিল।’

চারদিকে চাপ

গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক বাংলাদেশের একজন আইনজীবী ও হিন্দু নেতা। ভারত ও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে সম্পর্ক তিক্ততায় রূপ নেওয়ার মধ্যে আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছেন তিনি।

শেখ হাসিনা গত আগস্টে পালিয়ে ভারতে যাওয়ার পর থেকে বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব ব্যাপক বেড়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতাচ্যুত হাসিনার একজন ঘনিষ্ঠ মিত্র। অন্তর্বর্তী সরকার গত সোমবার বলেছে, শেখ হাসিনাকে বিচারের মুখোমুখি করার লক্ষ্যে তাঁকে দেশে প্রত্যর্পণ করতে ভারতের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ জানিয়েছে তারা। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন, তাঁরা এ অনুরোধ পেয়েছেন। তবে এ বিষয়ে ‘কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি’ তিনি।

ইউটিউবে সম্প্রতি এক ভিডিওতে দেখা যায়, শেখ হাসিনা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে হিন্দুদের ‘গণহত্যায়’ জড়িত থাকার অভিযোগ করছেন। নয়াদিল্লি সরকারের সমর্থক কিছু ডানপন্থী ভারতীয়ও একই দাবি করেছেন।

শেখ হাসিনাকে উৎখাত করার পর সহিংসতায় অনেকে মারা গেছেন। তাঁদের কাউকে পরিকল্পিতভাবে হিন্দু হিসেবে চিহ্নিত করে মারা হয়নি।
—গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক, আইনজীবী ও হিন্দু নেতা

গোবিন্দ প্রামাণিক এসব অভিযোগ ‘রাজনৈতিক’ বলে নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, শেখ হাসিনাকে উৎখাত করার পর সহিংসতায় অনেকে মারা গেছেন। তাঁদের কাউকে পরিকল্পিতভাবে হিন্দু হিসেবে চিহ্নিত করে মারা হয়নি। তিনি ঘনিষ্ঠভাবে ইউনূস সরকারের বার্তার দিকে নজর রেখেছেন। বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৯ শতাংশ হিন্দু উল্লেখ করে তিনি আশা প্রকাশ করেন, তাঁরা দেশ পুনর্গঠনের প্রচেষ্টায় শরিক হতে পারবেন।

দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বেড়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গত মাসে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার এক হিন্দু গুরুর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনেছে। বলা হয়েছে, তিনি জাতীয় পতাকার অবমাননা করেছেন। অন্যদিকে ভারত সরকার বলেছে, হিন্দুদের সুরক্ষার বৈধ দাবি তোলা একজন ধর্মীয় নেতাকে নিশানা করেছে বাংলাদেশ।

দুই দেশের সরকারি কর্মকর্তারা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার উপায় খুঁজছেন। এ মাসের শুরুর দিকে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি ঢাকায় মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। যদিও তিনি হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনের ওপর হামলার খবরে ভারত উদ্বিগ্ন বলে জানিয়েছেন। মিশ্রি শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, দুই দেশের সম্পর্ক ‘একক রাজনৈতিক দলের’ সঙ্গে সম্পর্কের ঊর্ধ্বে।

শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর লাখো মানুষ জড়ো হন সংসদ ভবন এলাকায়। তাঁদের কারও কারও হাতে ছিল জাতীয় পতাকা
ছবি: কবির হোসেন

অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ তৈরির আরেকটি বড় উৎস, দেশের আরেক বড় দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি।

এ দলের নেতৃত্বে আছেন হাসিনার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান। নতুন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে গঠিত কমিশনগুলোতে স্থান না পেয়ে দলটি ক্ষুব্ধ।

বিএনপি বলেছে, নির্বাচন আয়োজন বা সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের রূপরেখা তুলে ধরতে খুব ধীরগতিতে এগোচ্ছেন মুহাম্মদ ইউনূস। গত সপ্তাহে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, প্রস্তাবিত সংস্কারকাজের অগ্রগতির ওপর ভিত্তি করে ২০২৫ সালের শেষ থেকে ২০২৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘অনির্বাচিত সরকারকে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। তাই যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত।’ ঢাকা ও অন্যান্য শহরে অটোরিকশাচালকসহ বিভিন্ন পক্ষের সংঘর্ষ এবং বিক্ষোভ বেড়ে যাওয়ার দিকে ইঙ্গিত করেন তিনি।

বাড়তি চাপ তৈরি করেছে দুই অঙ্কের ঘরের মূল্যস্ফীতিও। উদাহরণ হিসেবে সম্প্রতি এক সকালে ঢাকায় ভর্তুকি মূল্যে তেল, চাল ও সবজি বিক্রির একটি সরকারি ট্রাকের সামনে প্রায় ১০০ লোকের হাজির হওয়ার কথা বলা যায়।

নাছিমা নামের একজন পোশাককর্মী বলেন, ‘আপনি যা চান, তার সবটা এখান (ট্রাক) থেকে নিতে পারবেন না।’ তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু আমি যদি এগুলো বাজার থেকে কিনতে চাই, দ্বিগুণ খরচ হবে।’

ব্যক্তিগত ভবিষ্যৎ

ঢাকায় বন্ধ জাতীয় সংসদ ভবনের এক কোণে আবর্জনার স্তূপে পড়ে আছে শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর লেখা বড় আকারের একটি বই। এর পাতাগুলো পানিতে নষ্ট হচ্ছে। শেখ হাসিনার বাবা ও বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে বিবেচিত শেখ মুজিবের জন্মবার্ষিকীর প্রায় ৩৫ হাজার বই শহরের এখানে-সেখানে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে।

বাবার স্মরণে হাসিনার তৈরি করা হাজারো ভাস্কর্য ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় গুঁড়িয়ে দেওয়া বা বিকৃত করা হয়েছে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান আলী রীয়াজ বলেন, ‘ছাত্ররা বলেছেন, তিনি কোনো দেবতা নন।’

তবে যে ক্ষোভ একসময় অচিন্তনীয় লুটপাট-ভাঙচুরের দৃশ্য তৈরি করেছিল, তা এখন প্রশমিত হয়ে এসেছে। শিক্ষার্থীরা আবার পড়াশোনা ও ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করেছে দুই অঙ্কের ঘরের মূল্যস্ফীতি। উদাহরণ হিসেবে সম্প্রতি এক সকালে ঢাকায় ভর্তুকি মূল্যে তেল, চাল ও সবজি বিক্রির একটি সরকারি ট্রাকের সামনে প্রায় ১০০ লোকের হাজির হওয়ার কথা বলা যায়।

সংস্কার কমিশনগুলোর একটির একমাত্র নারী শিক্ষার্থী সদস্য নিশিতা জামান নিহার মতো কেউ কেউ সুযোগ পেলে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যেতে চান। এমনকি মুহাম্মদ ইউনূসের ‘প্রধান ছাত্র উপদেষ্টা’ মাহফুজ আলমও বলেছেন, পরিশেষে তিনি তাঁর আগ্রহের বিষয় ভাষা ও ইতিহাসে ফিরতে চান।

এখন পর্যন্ত এ শিক্ষার্থীরা (ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া ছাত্রছাত্রী) রাজনীতিকে একটি কল্যাণমুখী শক্তিতে পরিণত করার দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী আসিফুল হক রবিন বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশে রাজনীতিতে এক নতুন প্ল্যাটফর্ম তৈরির চেষ্টা করছি। এটা যদি আমাদের জন্য না-ও হয়, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য যেন হয়।’

অনুবাদ: মো. আবু হুরাইরাহ্‌অনিন্দ্য সাইমুম ইমন