বিক্ষোভ–সহিংসতা
দেশজুড়ে কারফিউ, মাঠে সেনা
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লে সরকারের নির্দেশে দেশের ভেতরে সব ধরনের ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ ছিল। এ কারণে প্রথম আলো ডটকমে কোনো সংবাদ বা লেখা প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। যদিও এ কয়েক দিনে নানা ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সংঘাত–সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ২০৪ জন। সংকট নিরসনে সরকারও একাধিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে এ সময়ে ছাপা পত্রিকা নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য উল্লেখযোগ্য সংবাদ ও লেখাগুলো অনলাইনে প্রকাশ করা হলো। এই প্রতিবেদনটি গত রোববার (২১ জুলাই) ছাপা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
সারা দেশে কারফিউ চলছে। প্রথম দফায় গত শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টা থেকে গতকাল শনিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত কারফিউ চলে। মাঝে দুই ঘণ্টার বিরতি দিয়ে বেলা ২টা থেকে আবার কারফিউ শুরু হয়। আজ রোববার বেলা তিনটা পর্যন্ত কারফিউ চলবে। এরপর দুই ঘণ্টা শিথিল থাকবে। পরে বিকেল পাঁচটা থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কারফিউ বলবৎ থাকবে বলে জানানো হয়েছে। এর আগের ঘোষণায় আজ সকাল ১০টা পর্যন্ত কারফিউ বলবৎ থাকার কথা জানানো হয়েছিল।
কারফিউ চলার সময় সারা দেশে যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। তবে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের কয়েকটি স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে ২৬ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকায় ১৫ জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া ময়মনসিংহ ও সাভারে ৪ জন করে, গাজীপুরে ২ জন এবং নরসিংদীতে ১ জন নিহত হয়েছেন। এ নিয়ে গত মঙ্গল, বৃহস্পতি, শুক্রবার এবং গতকাল মিলে মোট নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪৮। এ ছাড়া গতকাল নারায়ণগঞ্জসহ আরও কয়েকটি জেলায় বিক্ষোভ–সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে।
এদিকে আজ রোববার ও আগামীকাল সোমবার সারা দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিএমএ জানিয়েছে, আজ সারা দেশের পোশাক কারখানা বন্ধ থাকবে। গতকালও এসব কারখানা বন্ধ ছিল। দেশের অন্য বড় শিল্পকারখানাগুলো গতকাল বন্ধ ছিল এবং আজও বন্ধ থাকবে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ বা সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচিকে ঘিরে গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার দেশের বিভিন্ন জেলায় ব্যাপক বিক্ষোভ, সংঘর্ষ ও সহিংসতা হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গত শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টা থেকে সারা দেশে কারফিউ জারি করে সরকার। বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করার জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়।
গতকাল রাজধানী ঢাকার অধিকাংশ মোড়ে সেনাসদস্যরা সতর্ক অবস্থানে ছিলেন। তাঁরা পথে বের হওয়া লোকজনের পরিচয় যাচাই করে চলাচলের অনুমতি দেন। কারফিউর মধ্যেও জরুরি পরিষেবা, রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স, গণমাধ্যমের গাড়ি ও আন্তর্জাতিক-অভ্যন্তরীণ গন্তব্যের যাত্রীরা টিকিট দেখিয়ে যাতায়াতের সুযোগ পান।
তবে গতকাল রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, মেরুল বাড্ডা ও মিরপুরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হয়েছে। পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়। কাঁদানে গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে বিক্ষোকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। তবে গতকাল আগের দুই দিনের মতো ব্যাপক সহিংসতা হয়নি।
গত কয়েক দিনের সহিংসতায় জনমনে তীব্র আতঙ্ক তৈরি হয়। এর মধ্যে সরকারের কারফিউ জারির সিদ্ধান্তে অনেকেই বিচলিত হয়ে পড়েন। এর আগে দেশে কারফিউ জারি হয়েছিল এক–এগারোর সময়কার সেনা–সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। ফলে কারফিউয়ে কী করা যাবে, কী করা যাবে না, সেটি নিয়েও অনেকে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েন।
গত শুক্রবার রাতে কারফিউ–সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪-এর ২৪/১ ধারা অনুযায়ী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা মহানগর এলাকার পুলিশ কমিশনাররা প্রয়োজন অনুযায়ী কারফিউ জারি করবেন। একই সঙ্গে তাঁরা ফৌজদারি কার্যবিধির ১৮৯৮-এর সংশ্লিষ্ট ধারা অনুযায়ী, ইন এইড টু সিভিল পাওয়ারের (বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা) আওতায় সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
গত রাত ১১টার দিকে রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় নিজ বাসভবনে এক বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সাংবাদিকদের জানান, চলমান কারফিউ রোববার (আজ) বেলা তিনটা পর্যন্ত চলবে। এরপর দুই ঘণ্টা শিথিল থাকবে। পরে বিকেল পাঁচটা থেকে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কারফিউ বলবৎ থাকবে।
এর আগের ঘোষণায় আজ সকাল ১০টা পর্যন্ত কারফিউ বলবৎ থাকার কথা জানানো হয়েছিল।
সরকার কারফিউ জারি করার পর রাতেই সেনাবাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান নেন। গতকাল সকালে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ঘুরে দেখা যায়, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো ঘিরে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি ছিল। কারফিউর সময়েও কোনো কোনো জায়গায় পরিচয় যাচাইয়ের পর জরুরি প্রয়োজনে বের হওয়া লোকজনকে যেতে দিতে দেখা গেছে। আবার কিছু সড়কে যানবাহন প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।
কারফিউয়ে রাজধানীর প্রধান বিপণিবিতান ও প্রধান সড়কের পাশের দোকানপাট বন্ধ ছিল। সড়কে মানুষের উপস্থিতি ছিল একেবারেই কম। তবে অলিগলিতে লোকজনকে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। জরুরি প্রয়োজনে কেউ কেউ গাড়ি বের করেন। তবে সকালে ঢাকার সড়কে রিকশা ও অল্পসংখ্যক সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচল করতে দেখা গেছে।
কারফিউয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন গণভবনের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। গণভবনের চারদিকের সড়কেই ব্যারিকেড বসিয়ে সেনাসদস্যদের অবস্থান নিতে দেখা যায়। পাশাপাশি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ ও পুলিশ সদস্যরাও সতর্ক পাহারায় ছিলেন।
এ ছাড়া দেশের জেলায় জেলায় মাঠে নেমেছেন সেনাসদস্যরা। গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে সতর্ক পাহারায় থাকতে দেখা যায় তাঁদের।