আর হাঁটতে পারবে না, তা মানতে নারাজ গুলিবিদ্ধ কিশোর তাহসিন
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগের দিন ৪ আগস্ট রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে গুলিবিদ্ধ হয় তাহসিন। মোহাম্মদপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির তাহসিন এখন সিআরপিতে চিকিৎসাধীন।
ভাই-বোনের মধুর সম্পর্কে খুনসুটির শেষ নেই। তাহসিন হোসেন নাহিয়ান (১৫) ঠিক করে রেখেছে, বাড়ি ফিরে সবার আগে ছোট বোন নাফিজা জাহানকে (১২) ‘লাথি’ দেবে। এটা দেখে মা–বাবা খুশি হবেন, না আগের মতো রাগ করবেন—তা দেখতে চায় তাহসিন! কেন এমন ইচ্ছা?
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৪ আগস্ট পিঠে মেরুরজ্জুতে (স্পাইনাল কর্ড) গুলি লাগে তাহসিনের। এর পর থেকে তার দুই পা পুরোপুরি অবশ হয়ে গেছে। গত বৃহস্পতিবার সাভারের পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে (সিআরপি) তাহসিনের মা তাহেরা নয়ন চোখের পানি ফেলতে ফেলতে যখন ছেলের এই ইচ্ছের কথা বলছিলেন, তখনো বিছানায় শোয়া তাহসিন মাথা দুলিয়ে হাসছিল।
তাহসিন ধরেই নিয়েছে, তিন মাস পর সিআরপি থেকে নিজের পায়ে হেঁটেই সে বাসায় ফিরবে। সে এটাও বলল, চিকিৎসক এখনো পুরোপুরি বলে দেননি যে সে হাঁটতে পারবে না।
৪ আগস্ট রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে গুলিবিদ্ধ হয় তাহসিন। এরপর ২১ আগস্ট পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল সে। গত ৮ আগস্ট ঢাকা মেডিকেলে ‘অস্ত্রোপচারের পর পায়ের শক্তির উন্নতি নাও হতে পারে’, এমন কথা জেনেই অস্ত্রোপচার করার লিখিত অনুমতি দিয়েছিলেন মা তাহেরা। তারপর ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসা শেষে ২১ সেপ্টেম্বর থেকে সিআরপিতে চিকিৎসাধীন তাহসিন। এর মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চীন থেকে আসা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দলও তাহসিনকে দেখেছে। তাহসিন আবার হাঁটতে পারবে, সে ধরনের কোনো আশ্বাস তারাও দিতে পারেনি। তাই তাহসিনের মা জানেন এবং মেনেও নিয়েছেন, তাঁর ছেলে আর হাঁটতে পারবে না। তবে তাহসিন সে কথা মানতে নারাজ।
গুলি লাগার পর প্রথমে মনে হয়, কেউ পেছন দিকে জোরে ধাক্কা দিয়েছে। পিঠ জ্বলে যাচ্ছিল। সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারি, আমি পা নাড়াতে পারছি না।
তাহেরা নয়ন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছেলে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না, সে আর হাঁটতে পারবে না। তাকে যতই বলি, নিজের খাওয়াসহ অন্য কাজগুলো কীভাবে করতে হবে, তা আস্তে আস্তে শেখার জন্য। কিন্তু ছেলে তাতেও রাজি না। শুধু বলে, “আগে বাসায় ফিরি, তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে।”’
মোহাম্মদপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী তাহসিন। মা তাহেরা জানান, অস্ত্রোপচার করে তাহসিনের গুলি বের করা হয়েছে। তবে গুলিতে মেরুরজ্জু থেঁতলে গেছে। গুলি লাগার পর থেকেই তাহসিনের পেটের নিচ থেকে দুই পা পুরোপুরি অবশ হয়ে গেছে। সে প্রস্রাব-পায়খানার কথা বলতে পারে না।
তাহসিন দুই হাতসহ শরীরের ওপরের অংশ নাড়াতে পারে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে মুঠোফোনে বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ৪ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর তাহসিনকে অন্যরা ধরাধরি করে নিয়ে যাচ্ছেন, এমন একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। তাহসিন শুয়ে শুয়ে সে ভিডিও দেখে। তাহসিন প্রথম আলোকে বলল, ‘ফেসবুকের ভিডিওটা দেখে মন খারাপ হয়। ওই দিনের কথা মনে হয়। সেদিন সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে কোনো পুলিশ ছিল না। সবাই বলছিল, ছাত্রলীগের ছেলেরা গুলি করছে। গুলি লাগার পর প্রথম মনে হয়, কেউ পেছন দিকে জোরে ধাক্কা দিয়েছে। পিঠ জ্বলে যাচ্ছিল। সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারি, আমি পা নাড়াতে পারছি না।’
চীন থেকে আসা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দলও তাহসিনকে দেখেছে। তাহসিন আবার হাঁটতে পারবে, সে ধরনের কোনো আশ্বাস তারাও দিতে পারেনি। তাই তাহসিনের মা জানেন এবং মেনেও নিয়েছেন তাঁর ছেলে আর হাঁটতে পারবে না। তবে তাহসিন সে কথা মানতে নারাজ।
তাহসিনের মা জানান, তাহসিন আন্দোলনে যাওয়ার আগে বাসায় বলত, সে খেলতে যাচ্ছে। পরে ফোন করলেও বলত, সে খেলতে গেছে। ৪ আগস্টও খেলতে যাওয়ার কথা বলে সকালে বাসা থেকে বের হয়। তারপর বেলা আড়াইটা বা তিনটার দিকে কেউ একজন ফোন করে জানান, তাহসিন গুলিবিদ্ধ হয়েছে।
৪ আগস্টের পর থেকে তাহসিনের পরিবারের সদস্যদের রোজনামচা পাল্টে গেছে। তাহসিনের বাবা মো. নীরব হোসেন একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কর্মরত। চাকরি সামলানোর পাশাপাশি ছেলের সঙ্গে থাকছেন হাসপাতালে। মাকেও সংসারের সব ফেলে ছেলের পেছনেই সময় দিতে হচ্ছে।
মা–বাবাকে আন্দোলনে যাচ্ছে বললে তাঁরা যেতে দিতেন না, তাই মিথ্যা কথা বলে যেত—একগাল হেসে এ কথা জানায় তাহসিন। কেন আন্দোলনে যেত, এ প্রশ্নের উত্তরে তাহসিন বলে, তার বন্ধুরাও আন্দোলনে যেত। এ ছাড়া আন্দোলনে অংশ নেওয়াদের গুলি করে মেরে ফেলা হচ্ছে, এটা সে সহ্য করতে পারত না। আন্দোলনে গেলে তার শরীরেও গুলি লাগতে পারে, এ ভয় কখনো কাজ করত না। ৪ আগস্টের আগেও বিভিন্ন দিন সে মিরপুর ১০ নম্বর, জাতীয় প্রেসক্লাব, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ধানমন্ডি ২৭ নম্বরসহ বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল—এ কথা তাহসিন বেশ গর্বের সঙ্গেই জানাল।
গুলি লাগার পরও তাহসিনের চেতনা ছিল। তাহসিন নিজেই জানাল, তাকে প্রথমে পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। হাসপাতালে শুয়েই তাহসিন জানতে পারে, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে। এ খবর শুনে তাহসিন খুশি হয়েছিল।
তাহসিনের মা বলেন, ‘ভাবতাম, আমার ছেলেটা ছোটই আছে। আমি ফেসবুক ব্যবহার করি না। তাই জানতেও পারিনি, ছেলে ফেসবুকে আন্দোলন নিয়ে স্ট্যাটাস দিচ্ছে। ৪ আগস্ট আমি অন্যদের বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে সাবধান করেছি, তখনো মনে হয়নি, ছেলেকে সাবধান করা উচিত। কেননা আমি তো ভেবেই নিয়েছিলাম, আমার ছেলেটা আন্দোলনে যায় না বা যাবে না। যদি জানতাম, তাহলে ছেলের সঙ্গে আমি আর ওর বাবাও সঙ্গে যেতাম। ছেলেটাকে হয়তো গুলি থেকে রক্ষা করতে পারতাম।’
তাহেরা নয়ন বলেন, সিআরপিসহ বিভিন্ন জায়গার চিকিৎসকেরা ছেলের শারীরিক অবস্থার কথা জানিয়েছেন। তারপরও আশা জাগে, মনে হয় ছেলেটা আবার হাঁটতে পারবে। তারপরই মনে হয়, এত ছোট বয়সেই ছেলেটার জীবন থেমে গেল বা থমকে গেল।
বৃহস্পতিবার সিআরপিতে দায়িত্ব পালন করছিলেন ‘ইনডোর অফিসার’ চিকিৎসক কাকলী আক্তার ও মিশরী রহমান। দুজনই তাহসিনের প্রসঙ্গে জানান, তাহসিন আবার হাঁটতে পারবে—এখন পর্যন্ত সে ধরনের কোনো সম্ভাবনার কথা তাঁরা বলতে পারছেন না। তাহসিনের শারীরিক এ অবস্থার কথা তাহসিন ও তার পরিবারের সদস্যরা যাতে মেনে নিতে পারেন, তার জন্য কাউন্সেলিং করা হচ্ছে। তাহসিনের প্রয়োজন অনুযায়ী হুইলচেয়ার বানিয়ে দেওয়া হবে। হুইলচেয়ারে বসে সে তার দৈনন্দিন পড়াশোনাসহ অন্যান্য কাজ কীভাবে করবে, তা শিখিয়ে দেওয়া হবে।
সিআরপি সূত্র জানায়, আহত তাহসিনসহ চারজন গত বৃহস্পতিবার চিকিৎসাধীন ছিল। আর সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত গণ–অভ্যুত্থানে আহত ২৫ জন সেখানে সেবা নিয়েছেন। সিআরপির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ সোহরাব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আন্দোলনে আহত ব্যক্তিদের সিআরপিতে বিনা মূল্যে বিভিন্ন সেবা দেওয়া হচ্ছে। আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার পাশাপাশি পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শুধু সাভার নয়, সারা দেশের সিআরপির ১২টি সেন্টারেই আন্দোলনে আহত ব্যক্তিদের সেবা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছে।
৫ আগস্ট সরকার পতনের আগপর্যন্ত তাহসিনের চিকিৎসায় কত টাকা খরচ হয়েছে, তার কোনো হিসাব রাখতে পারেননি তাহসিনের মা–বাবা। তবে সরকার পতনের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিএমএইচ এবং সিআরপিতে বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন বলে জানান মা তাহেরা নয়ন।
তাহসিনের বাবা নীরব হোসেন বলেন, চিকিৎসা বিনা মূল্যে পাওয়া গেলেও মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে হাসপাতালগুলোতে যাতায়াতসহ অন্যান্য খরচ তো একেবারে কম না। বাবা বলেন, ‘একজন বাবার একটিই চাওয়া, ছেলেটি আবার সুস্থ হবে, নিজের পায়ে হাঁটবে।’ তাঁর বিশ্বাস, ছেলের বয়স কম, সরকার বিদেশে নিয়ে ছেলের চিকিৎসা করালে সে আবার হাঁটতেও পারবে।