যখন বাবা বাড়ি ফিরে স্পর্শ করতে পারতেন না তাঁর সন্তানকে
যখন চিকিৎসক মা বন্দী থাকতেন ঘরে,
আর একটুখানি কাছে আসার জন্য
দরজার ওপারে ছটফট করত তাঁর শিশুসন্তান
যখন আমাদের রাস্তাগুলো পরিণত হয়েছিল
রূপকথার পাথরপুরীতে
যখন অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ ঢেকে দিয়েছিল পাখির কাকলি
যখন একটুখানি অক্সিজেনের জন্য হাপরের মতো
ওঠানামা করত আমাদের ফুসফুস
যখন সূর্য ডুবে যাওয়ার পর আর কখনো উঠবে না বলে
আমরা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম
যখন মানুষ কাছে যেতে পারত না মানুষের
যখন আঙুল স্পর্শ করতে পারত না আঙুল
যখন মায়া মানে ছিল কেবল নিজের জন্য মায়া
যখন বাঁচা মানে ছিল কেবল নিজেকে বাঁচানো—
তখনো আমাদের দরজায় টোকা দিয়েছিল আশা
মায়ের আঁচলের গন্ধের মতো আশা
দয়িতার ভেজা চুলে গামছার বেণি বেয়ে
টুপটুপ ঝরে পড়া পানির মতো আশা
আমাদের আর কোনো দিন বাইরে বেরোনোর কথা ছিল না
ছিল আশা
আমাদের আর কোনো দিন রোদে ভিজবার কথা ছিল না
ছিল আশা
২
বালকের হাতে চরকির মতো পৃথিবী পশ্চিম থেকে ঘুরছে পুবে
আর রোজ পূর্ব দিগন্ত রাঙিয়ে উঠছে সূর্য
অ্যাম্বুলেন্স, গোরস্তান, শ্মশানের স্মৃতি
লোবানের গন্ধের সঙ্গে ধীরে ধীরে
আমাদের ঘরদোর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।
রোদ এসে ভরে তুলছে আমাদের উঠান
স্কুলগুলোতে ঘণ্টা বাজছে ঢং–ঢং–ঢং
মেলায় কাচের চুড়ির পসরা নিয়ে বসেছে বেদেনিরা
কিশোরীর হাসির শব্দ মিশে যাচ্ছে নিক্বণের সঙ্গে
নদীর ওপর কুয়াশা
সান্ধ্য পল্লিগুলোতে ভেসে আসছে হাটের আওয়াজ
গাছের পাকা কুল আর লাল পাতার সঙ্গে
মিলেমিশে দলা পাকাচ্ছে রান্নাঘরের ধোঁয়া।
আমরা দল বেঁধে মিলছি বৈঠকে–উৎসবে আড্ডায়,
ফিরছি মায়ের কাছে, বাবার কাছে,
প্রিয়জনের আলিঙ্গনের মধ্যে।
ইটের দেয়ালে পাঁচতলার কার্নিশে একটা অশ্বত্থ চারা
পাতা মেলে বলছে, ‘বাঁচো’
ত্রিশালে দুর্ঘটনায় মায়ের মৃত্যুর আগে আগে
সড়কেই জন্ম নিয়েছিল যে শিশু
আজ সে শিখেছে নিজে নিজে বসতে
৩
আমরা তো উৎসবে মিলব বলে ঘর থেকে
বেরোতে শুরু করেছিলাম
কিন্তু
চড়ুইপাখির প্রধান শত্রু বাজপাখি নয়
হরিণের প্রধান শত্রু বাঘ নয়
নদীর প্রধান শত্রু মরুভূমি নয়
বনের প্রধান শত্রু দাবানল নয়
মানুষের প্রধান শত্রু তো ভাইরাস নয়
পাখির প্রধান শত্রু মানুষ
হরিণের প্রধান শত্রু মানুষ
অরণ্যের প্রধান শত্রু মানুষ
মানুষের প্রধান শত্রু মানুষ
৪
যখন ইউক্রেনে আটকে পড়া বধূর জন্য
মস্কোতে ছটফট করছেন স্বামী
যখন বোমারু বিমানের শব্দে ত্রস্ত জনপদ
স্কুলগুলো পরিণত হচ্ছে ধ্বংসস্তূপে
যখন আমাদের বিদ্যুৎকলগুলো বন্ধ করে রাখতে হচ্ছে
লোডশেডিংয়ের দোয়াত ঢেলে দিচ্ছে কালি
যখন ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো আশা দেখাতে পারছেন না
পৃথিবীর সবচেয়ে আশাবাদী মানুষটিও
তখনো উঁকি দিচ্ছে আশা
৫
আমাদের কিষানি আসন্ন আকালের জন্য
বীজ ধান হাঁড়িতে রাখতে রাখতে
ঘর্মাক্ত কপাল মুছছেন, তাঁর পান খাওয়া দাঁতে
একটুখানি হাসি হয়ে ঝিলিক দিচ্ছে আশা
মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়
শঙ্খচিলের ডানায় রোদের ঝলকে
ফিরে আসেন জীবনানন্দ দাশ
ইয়েমেনে খালি পেটে ঘুমাতে যাওয়া শিশুর আর্তনাদে
আর্তি—যুদ্ধ থামাও,
বন্ধ করো তোমাদের ধনুক ব্যবসা।
৬
বটগাছের ছায়ায় একটুখানি জুড়াতে বসে ক্লান্ত পথিক।
তার মাথার ওপর ঝরে পড়ে লাল ফল
গাছের ডালে মিষ্টি সুরে ডেকে ওঠে একঝাঁক পাখি
পাশে এসে বসা ফেরিওয়ালার কাছ থেকে
প্লাস্টিকের লাল পুতুল কেনে পথিক তার নাতনিটির জন্য
পাখি বলে, ভালো থেকো তোমরা মানুষ
বটের ছায়া বলে, ভালো থেকো তোমরা মানুষ
আকাশে সাদা মেঘদল বলে, ভালো থেকো তোমরা মানুষ
আকালের ছায়া মুছে যায় দিগন্ত থেকে
চনমনে রোদ অনন্ত ধানখেতে
নীল আকাশে সাদা মেঘের বিস্তার বলে—আশা
নদীজলে কাঁপা ঢেউ কল্লোল তোলে—আশা
মানুষ ধ্বংসের বোতামটি থেকে হাত ফিরিয়ে নেবে
চাকাগুলো ঘুরবে সামনের দিকে
আমাদের দেয়ালে নতুন ক্যালেন্ডার
শেষ সূর্য ডুবে যাওয়ার পর
নতুন বছরের নতুন দিন নিয়ে ওঠে সূর্য
তার রশ্মিজুড়ে আশা
আমাদের উঠানে, বারান্দায় রোদ্দুরের আলপনা—
সুদিনের গাঢ় সমাচার।