‘অন্য দিন সকালে ঘুম থেকে তুলতে গেলেই বলে, “আম্মু, আরেকটু পর উঠছি।” আর আজ এক ডাকেই উঠে গেছে। অন্য দিন স্কুলে আসার সময় চোখে ঘুম থাকলেও আজ ছিল উচ্ছ্বাস ও আনন্দের রেশ। বছরের এই একটি দিনের জন্য সে অপেক্ষায় থাকে।’
কথাগুলো বলছিলেন ঢাকার উইটন ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের নার্সারির ছাত্রী তাহিয়া আনজুমের মা নীলা আক্তার। তিনি এসেছিলেন মেয়ের স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজনে।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হলো ঢাকার শীর্ষস্থানীয় ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উইটন ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ‘বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ২০২৪’। গত শনি ও রোববার (২৮ ও ২৯ ডিসেম্বর) রাজধানীর ধানমন্ডির সুলতানা কামাল মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সে অনুষ্ঠিত দুই দিনব্যাপী আয়োজনটি হয়ে ওঠে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আনন্দ-উচ্ছ্বাসের উপলক্ষ।
‘এক্সপ্লোর-ডিসকভার-সাইন’ স্লোগানে আয়োজিত সপ্তম ‘অ্যানুয়াল স্পোর্টস ডে’তে অংশ নেয় প্রতিষ্ঠানটির ধানমন্ডির একটি এবং লালমাটিয়ার দুটি ক্যাম্পাসের দুই হাজারের বেশি শিক্ষার্থী। তারা মেতেছিল নিজেদের ক্রীড়ানৈপুণ্য দেখানোর উৎসবে। প্রথম দিন ছেলেশিক্ষার্থী এবং দ্বিতীয় দিন মেয়েশিক্ষার্থীরা আলাদাভাবে প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়।
ক্রিকেট তারকাদের উপস্থিতিতে জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান
আয়োজনটির প্রথম দিনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ছিল জমজমাট। শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করতে এদিন উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক চারজন সদস্য মোহাম্মদ রফিক, জাভেদ ওমর বেলিম, হাবিবুল বাশার ও মোহাম্মদ আশরাফুল। দুই দিনব্যাপী বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করেন তাঁরা।
এ সময় জাভেদ ওমর বেলিম বলেন, ‘ভবিষ্যৎ খেলোয়াড় তৈরি করতে দরকার ছোটবেলা থেকেই নিয়মিত চর্চা। এ স্কুল সেটি ঠিকভাবেই করেছে বলে আমি মনে করি। এমন একটি জমজমাট আয়োজনে আসতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত।’
খেলাধুলার গুরুত্ব প্রসঙ্গে মোহাম্মদ রফিক বলেন, ‘এটা খুবই ইতিবাচক একটি উদ্যোগ, যা প্রশংসার দাবি রাখে। এর ফলে শিশুরা মনের দিক থেকে চাঙা থাকার পাশাপাশি মাঠে এসে খেলার কারণে শারীরিকভাবেও ফিট থাকবে। কিছু সময়ের জন্য হলেও ডিভাইস-আসক্তি থেকে তারা মুক্ত থাকবে।’
জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশার সুমন স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘এখানে এসে আমার স্কুলজীবনের কথা মনে পড়ে গেল। এদিনটার জন্য আমরা সব সময় অপেক্ষা করতাম। আমি মনে করি, ঢাকার অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও শিক্ষার্থীদের মাঠমুখী করতে এ রকম উদ্যোগ নেবে।’
উইটন ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ক্রীড়া কোচের দায়িত্ব পালন করছেন জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মোহাম্মদ আশরাফুল। তিনি বলেন, ‘আগে প্রায় প্রতিটি স্কুলেই মাঠ থাকত, এখন সেভাবে নেই। সব অভিভাবকের উচিত সন্তানকে প্রতিদিন কমপক্ষে ৪০ মিনিট মাঠে এনে খেলাধুলা করানো। এতে তাদের মন প্রফুল্ল থাকবে। শারীরিক ও মানসিক বিকাশও নিশ্চিত হবে।’
দুই দিনব্যাপী এ আয়োজনে উপস্থিত থেকে শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের ক্রীড়াশৈলী উপভোগ করেন উইটন ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল কাদের, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও অধ্যক্ষ আবদুল্লাহ্ জামানসহ অন্য পরিচালকেরা।
যেসব আয়োজনে সরব ছিল মাঠ
ভিন্নধর্মী নানা আয়োজনে সাজানো হয়েছিল বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতাটি। ছাত্রদের ১৬৫টি এবং ছাত্রীদের জন্য ছিল ১২৬টি ইভেন্ট। মাঠের মধ্যে খণ্ড খণ্ড সাতটি ভেন্যুতে খেলা পরিচালনা করা হয়। এর মধ্যে ছিল ৮০, ১৫০ ও ২০০ মিটার দৌড়, মোরগ লড়াই, ঝুড়িতে করে বল সংগ্রহ, বাধা অতিক্রম করে দৌড়, খরগোশ-দৌড়, দৌড়ে গিয়ে ফেলুন ফাটানো, চকলেট–দৌড়, উচ্চ ও দীর্ঘ লাফ, বল নিক্ষেপ, ভারসাম্য-দৌড়, গণিত-দৌড় ইত্যাদি। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে অংশগ্রহণ করতে হয়েছে তিনটি খেলায়।
প্রতিষ্ঠানটির তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের শিক্ষক শামীম আহমেদ সিদ্দিকী ও সিনিয়র সেকশনের সহকারী সমন্বয়ক শরীফুল হকের ধারাভাষ্যে পুরো আয়োজন ছিল প্রাণবন্ত। অভিভাবক গ্যালারিও ছিল পরিপূর্ণ। তাঁদের একজন ঢাকার লালমাটিয়ার বাসিন্দা শহীদুল্লাহ কায়সার লিটন। তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। তাঁর ছেলে ফারদিন ইসলাম অয়ন কেজি টুর শিক্ষার্থী। ছেলে পুরস্কার জিততে পারবে তো? এমন প্রশ্নের উত্তরে লিটন বলেন, ‘পুরস্কারপ্রাপ্তি নয়, অংশগ্রহণ করেছে, এটাই বড় বিষয়। আর সামগ্রিক আয়োজন আমার খুব ভালো লেগেছে। বলা যায়, এটা শুধু শিক্ষার্থীদেরই নয়, আমাদের অভিভাবকদেরও একটা মিলনমেলা।’
আয়োজনের সার্বিক দিক নিয়ে স্কুলের অধ্যক্ষ আবদুল্লাহ্ জামান বলেন, ‘মানুষের মস্তিষ্কে তিনটি ভাগ আছে। সামনের ভাগকে বলে “ফ্রন্টাল লব”। যেখানে থাকা সেলগুলোকে সচল রাখতে দরকার ফিজিক্যাল মুভমেন্ট। আর এর সবচেয়ে ভালো মাধ্যম হলো খেলাধুলা। এতে ব্রেন ফ্রেশ হয়, যা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় মনোযোগী হতে সহায়তা করে।’ এত বড় পরিসরে আয়োজনটি কেন করা হলো? এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এখানে দুটি কারণ রয়েছে। একটি হলো শিক্ষার্থীদের বড় পরিসরে খেলাধুলার জন্য অভ্যস্ত ও তৈরি করা। অন্যটি হলো আমাদের শিক্ষার্থীরা স্কুলের ইনডোরে সব সময় খেলার সুযোগ পায়। তাই একটু বড় পরিসরে তাদের খেলাধুলার মাধ্যমে একটা দিন উদ্যাপনের ব্যবস্থা করা।’
দুই দিনব্যাপী প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন স্কুলটির শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। উইটন ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ফেসবুক পেজ থেকে আয়োজনটি সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
বিজয়ীরা পেল আকর্ষণীয় পুরস্কার
প্রতিটি ইভেন্টের বিজয়ীর নাম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তা প্রদর্শিত হচ্ছিল মাঠের এক কোনায় থাকা বড় পর্দায়। বিজয়ীদের গলায় পদক পরিয়ে দেন স্কুলের সিনিয়র, জুনিয়র ও আর্লি সেকশনের দুই উপাধ্যক্ষ এবং একজন ইনচার্জ। গ্রেডভিত্তিক পুরস্কার প্রদান করেন তাঁরা। এ সম্পর্কে সিনিয়র স্কুল শাখার উপাধ্যক্ষ পারভীন কাদের বলেন, ‘আমরা ছোটবেলায় এ রকম পুরস্কার পেয়ে ভাষাহীন হয়ে পড়তাম। কিন্তু আমাদের শিক্ষার্থীরা অনেক স্মার্ট। তারা পরস্পরের সঙ্গে নিজেদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। পাশাপাশি তাদের অভিভাবকেরাও তাঁদের মতোই উদ্যাপন করছেন। এটি সত্যি দেখার মতো একটি চিত্র।’
জুনিয়র স্কুল শাখার বিজয়ী শিক্ষার্থীদের পুরস্কার তুলে দেন উপাধ্যক্ষ সৈয়দা মিরা তাবাস্সুম। তিনি বলেন, ‘পুরস্কার গ্রহণের জন্য যখন শিক্ষার্থীরা হেঁটে আসে, সবার চোখ থাকে মেডেলের দিকে। কে কোন স্থান অধিকার করল, সেটার চেয়েও একটা পদক পেয়েছে, এটাই সবার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাদের এ আনন্দ দেখে আমি নস্টালজিক হয়ে যাই, বারবার নিজের শৈশবে ফিরে যাই।’
আর্লি স্কুল শাখার (প্লে থেকে কেজি টু) ইনচার্জ শামীমা ইয়াসমিন বলেন, ‘আমাদের শিক্ষার্থীরা খুবই ছোট। তারা প্রতিযোগিতা বিষয়টা কী, তা সেভাবে বোঝে না। তাই আমরা এখানে বিজয়ী ছাড়াও অংশগ্রহণকারী সব শিক্ষার্থীর জন্য সান্ত্বনা পুরস্কারের ব্যবস্থা রেখেছি।’
উচ্ছ্বসিত বিজয়ীরা
প্রথম দিনের প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে তিনটি পুরস্কার পায় সপ্তম শ্রেণির ছাত্র ফারহান ইশমাম বাসেত। আনন্দিত কণ্ঠে বাসেত বলল, ‘বল নিক্ষেপ, ২০০ মিটার দৌড় ও লং জাম্প খেলায় আমি যথাক্রমে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় হয়েছি। আমার খুব ভালো লাগছে।’
বেলুন ফোলানো প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান অধিকারী ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী মানহা বশির বলল, ‘আমার খুব ভালো লেগেছে পুরস্কার জিতে। তার চেয়ে বেশি ভালো লেগেছে খেলায় অংশগ্রহণ করে।’
একই শ্রেণির ছাত্রী মেহেরিন সারাফ ইউশা জিতেছে দুটি পুরস্কার। প্রতিক্রিয়ায় ইউশা বলল, ‘আমি বেলুন ফোলানো ও কোর ব্যালান্স খেলায় দ্বিতীয় হয়েছি। পুরস্কার পেয়ে খুব ভালো লাগছে। অপেক্ষা করব আগামী বছর আবার এ প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্য।’
‘মানসম্মত পড়াশোনার পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার কারণেই অভিভাবকদের আস্থার প্রতিষ্ঠান উইটন ইন্টারন্যাশনাল স্কুল,’ বলেন অধ্যক্ষ আবদুল্লাহ্ জামান। সামনের বছর থেকে এ প্রতিযোগিতায় আরও নতুন ইভেন্ট যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে বলেও জানান তিনি।