সীতাকুণ্ডে বিস্ফোরণ
২৩ মাসের ফাইজার মুখে একটাই বুলি, ‘বাবা’
সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণে প্রাণ হারানো আবদুস সোবহান রহমানের পরিবারে এখনো ফেরেনি স্বাভাবিকতা।
পুরোনো, ছোট বেড়ার ঘর। দরজা-জানালা নড়বড়ে। একচিলতে উঠানে খেলছিল ২৩ মাস বয়সী শিশু ফাইজা। এই বয়সে নানা শব্দ আওড়ায় শিশুরা। খেলতে খেলতে ফাইজাও অনর্গল শব্দের তুড়ি ছোটায়। তবে সেসবের মধ্যে কেবল স্পষ্ট বোঝা যায় ‘বাবা’ শব্দটি। ফুটফুটে ফাইজার মুখের এই বুলি শুনে যার উচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়ার কথা, সেই মানুষই নেই। তবে তাঁর অভাব যেন প্রকট হয়ে উঠেছে বাড়ির প্রতিটি স্থানে, প্রতিটি কোণে।
ফাইজার বাবা আবদুস সোবহান রহমান (২৮) চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোর আইসিটি সুপারভাইজার ছিলেন। গত বছরের ৪ জুন ওই ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঠিক আগে মা, বোন ও স্ত্রীর সঙ্গে মুঠোফোনে গ্রুপ কলে কথা বলছিলেন তিনি। এরপর মুঠোফোন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বিস্ফোরণে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া সোবহানের লাশ শনাক্ত করতে শিশু ফাইজার ডিএনএর নমুনা নিতে হয়েছিল। সেদিনের পর শোকের যে কালো ছায়া নেমেছিল, সোবহানের বাঁশখালীর শেখেরখীলের বাড়িতে তা আজও রয়ে গেছে।
গতকাল শনিবার দুপুরে চট্টগ্রামের বাঁশখালীর শেখেরখীল ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সোবাহান রহমানের বাড়িতে ঢুকতেই ফাইজার দেখা মেলে। উঠানে সে যখন খেলছিল, তখন পাশে ঘরের দাওয়ায় বসেছিলেন তার মা ইস্পাহান সুলতানা।
পরিচয়পর্ব শেষে সেদিনের প্রসঙ্গ তুললে কিছুক্ষণ চুপ হয়ে থাকেন ফাইজার মা; অর্থাৎ সোবহানের স্ত্রী ইস্পাহান। তারপর ফাইজাকে দেখিয়ে বলেন, ‘দেখুন, সবার আগে বাবা বলা শিখেছে সে। শব্দটা শুনলেই বুকটা মুচড়ে ওঠে। তিনি শুনলে কত খুশি হতেন।’ কথা বলতে বলতে চোখ মুছছিলেন ইস্পাহান সুলতানা।
বিস্ফোরণে শরীর বিকৃত হয়ে পড়ায় মেয়ে ফাইজার ডিএনএর নমুনা নিয়ে লাশ শনাক্ত করা হয় ৭ জুলাই। এক মাসের বেশি সময় অপেক্ষার পর সোবহানের লাশ দাফন করে পরিবার।
স্বামীর মৃত্যুর পর কোম্পানি ১০ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছিল। পাশাপাশি প্রতি মাসে সোবহানের মাসিক বেতনটাও পাচ্ছেন তাঁরা। স্বামী সোবহানের টাকায় এখনো সংসার চলছে বলে জানালেন ইস্পাহান। শাশুড়ি ও মেয়ে ফাইজাকে নিয়ে কোনোরকমে দিন কাটলেও স্বামীর অভাব অনুভব করেন প্রতিমুহূর্তে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইস্পাহান বলেন, ‘জীবন কত ছোট! ২০২০ সালের জুনে আমাদের বিয়ে হয়। ২০২১ সালের ৩০ জুন ফাইজা কোলজুড়ে এল। আর ২০২২ সালের ৪ জুন তিনি চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে।’
বেরিয়ে আসার সময় পেছন থেকে সোবহানের স্ত্রী ইস্পাহান সুলতানার ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ আসছিল। সে কান্না হয়তো থামবে। শোকও কিছুটা প্রশমিত হবে, কিন্তু সোবহান তাঁর প্রিয় বাড়িতে মেয়ের মুখে বাবা ডাক শুনতে আর কখনো ফিরবেন না।