নভেম্বরেও ডেঙ্গু কমল না
ডেঙ্গুর মৌসুম শেষ। কিন্তু ডেঙ্গুতে সংক্রমণ ও মৃত্যু কমছে না। এ বছর চলতি নভেম্বর মাসেই ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি হবে কি না, তা নিয়ে নিশ্চিত করে কেউ কিছু বলতে পারছেন না।
ঢাকা দক্ষিণ ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মশা নিয়ন্ত্রণে কিছু কাজ চোখে পড়ে। দেশের অন্যান্য সিটি করপোরেশন, শহর ও গ্রামে মশা নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো কর্মকাণ্ড চোখে পড়ে না। মশা না কমলে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ও ডেঙ্গুতে মৃত্যু কমে আসার সম্ভাবনা কম।
গতকাল সোমবার সরকারের রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক মো. হালিমুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘নভেম্বরে ডেঙ্গু কমে আসে। এ বছর তা হতে দেখছি না। সিটি করপোরেশনের মশা মারার কাজটি ঠিকমতো হচ্ছে বলে মনে হয় না। মশা না কমলে ডেঙ্গু কমবে না।’ তিনি আরও বলেন, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ডেঙ্গুর সংক্রমণ কমে আসবে বলে আশা করা যায়।
ডেঙ্গুতে এখন সারা বছর মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। তবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত মানুষের চিকিৎসা ও মৃত্যু নিয়ে যত আলোচনা বা গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচারিত হয়, ডেঙ্গু প্রতিরোধের কাজটি ততটা হয় না। মানুষকে সচেতন করার সরকারি কার্যক্রম নেই বললেই চলে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে কোনো নাগরিক উদ্যোগও দৃশমান নয়।
সরেজমিনে হাসপাতাল
ঢাকা শহরে ১৮টি সরকারি ও ৫৯টি বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা চলছে। এর মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল অন্যতম।
গতকাল ঢাকা মেডিকেলের নতুন ভবনের (ডিএমসি–২) পাঁচতলায় গিয়ে কথা হয় মো. সোলায়মানের সঙ্গে। এই কিশোরের বাড়ি ঝিনাইদহের মহেশপুরে। জ্বর, বমি ও শরীরব্যথার লক্ষণ দেখা গেলে সে প্রথমে ঝিনাইদহে ও পরে মাগুরার হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়। পরিস্থিতি কিছুটা খারাপ হলে সে ঢাকা মেডিকেলে চলে আসে। গতকাল তার মতো আরও ১২১ জন রোগী ঢাকা মেডিকেল ভর্তি ছিলেন।
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকার ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ডিএনসিসি কোভিড–১৯ হাসপাতালকে ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য ঠিক করেছে। গতকাল ওই হাসপাতালে গিয়ে জানা যায়, একসঙ্গে ৩০০ ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা সেখানে আছে। গতকাল রোগী ভর্তি ছিলেন ১৪৭ জন। টঙ্গীবাজার এলাকার বাসিন্দা আকলিমা আখতার তাঁর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ছয় বছরের মেয়ে রাফিয়া ইসলামকে নিয়ে ওই হাসপাতালে আছেন পাঁচ দিন। দুই দিন আগে মেয়ের পেটে অস্ত্রোপচার হয়েছে। আকলিমা আখতার বলেন, এখানে চিকিৎসা ভালো। চিকিৎসকেরা নিয়মিত আসেন। ডাকলেই নার্সদের পাওয়া যায়।
পরিস্থিতি কী
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ৯৩৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ সময়ে মারা গেছেন দুজন। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ৮৭ হাজার ৭২৫ জন ও মারা গেছেন ৪৬১ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এ বছর আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে পুরুষ ৬৩ শতাংশের বেশি ও নারী প্রায় ৩৭ শতাংশ। সব বয়সী মানুষ আক্রান্ত হলেও ১৬ থেকে ৩০ বছর বয়সী মানুষ বেশি আক্রান্ত হয়েছেন। পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় পাঁচ হাজার শিশু আক্রান্ত হয়েছে। অন্যদিকে ৮০ বছরের বেশি বয়সী মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন দুই শতাধিক।
পুরুষ আক্রান্ত বেশি হলেও মৃত্যুর তথ্যে দেখা যায়, পুরুষের তুলনায় নারীদের মৃত্যুর হার বেশি। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে নারী ৫১ শতাংশ ও পুরুষ ৪৯ শতাংশ। এ পর্যন্ত পাঁচ বছরের কম বয়সী ২৩ জন শিশু ডেঙ্গুতে মারা গেছে। অন্যদিকে ৮০ বছরের বেশি বয়সী মারা গেছেন আটজন। তাঁরা সবাই পুরুষ।
সরকারি তথ্যে এ বছর এই পর্যন্ত ১৯৭ রোগী মারা গেছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার হাসপাতালগুলোয়। ভর্তি রোগীর সংখ্যা সাড়ে ১৫ হাজারের বেশি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা নিয়মিত মশা নিধনের কাজ করছেন এবং তা তদারকিও করা হয় ঠিকঠাক। তবে দেশের অনেক অঞ্চলের খারাপ রোগী এই এলাকার হাসপাতালগুলোয় ভর্তি হন। প্রকৃতপক্ষে সব রোগী ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার নন।
৭০ শতাংশই ডেনভি–২
ডেঙ্গুর ধরন চারটি—ডেনভি–১, ডেনভি–২, ডেনভি–৩ ও ডেনভি–৪। একজন মানুষের একটি ধরনে একবারই সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। ডেনভি–১ ধরনে একবার আক্রান্ত হলে ওই ব্যক্তি আর কখনো একই ধরনে আক্রান্ত হবেন না। কারণ, তাঁর শরীরে ডেনভি–১ প্রতিরোধী ব্যবস্থা (অ্যান্টিবডি) গড়ে ওঠে। কিন্তু তাঁর অন্য ধরন দিয়ে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে, অর্থাৎ একজন ব্যক্তির মোট চারবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি আছেন। একাধিকবার আক্রান্ত হলে জটিলতা বাড়ে।
রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরিন প্রথম আলোকে বলেন, এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৭০ শতাংশই ডেনভি–২। ডেনভি–৩ ও ডেনভি–৪ দিয়ে আক্রান্ত হচ্ছেন যথাক্রমে ২০ শতাংশ ও ৯ শতাংশ। বাকি ১ শতাংশ আক্রান্ত হচ্ছেন ডেনভি–১ ধরনে। আইইডিসিআরের পরিচালক আরও বলেন, আশা করা যায় ডিসেম্বরের শুরুর দিকে ডেঙ্গুর সংক্রমণ কমে আসবে।
কেন নভেম্বরে বেশি
নভেম্বর মাসে এসেও কেন ডেঙ্গুর সংক্রমণ বা ডেঙ্গুতে মৃত্যু কমছে না, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তবে এর সঠিক ব্যাখ্যা কারও কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে না।
রোগতত্ত্ববিদেরা বলেন, বাংলাদেশে ডেঙ্গুর মৌসুম মে–জুন থেকে সেপ্টেম্বর–অক্টোবর পর্যন্ত। সারা বছর ডেঙ্গুর সংক্রমণ থাকলেও জুন মাস থেকে বাড়তে দেখা যায় এবং নভেম্বর থেকে কমতে থাকে। গত ২৪ বছরের মধ্যে ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে সংক্রমণ ছিল সবচেয়ে বেশি। গত বছর সংক্রমণ কমতে থাকে অক্টোবর মাস থেকে। যদিও নভেম্বরে সংক্রমণ ও মৃত্যু এ বছর এই সময়ের চেয়ে বেশি ছিল।
২০২২ সালে সংক্রমণ কমেছিল নভেম্বর মাস থেকে। ২০২১ সালে কমতে থাকে অক্টোবর মাস থেকে। করোনার কারণে ২০২০ সালে ডেঙ্গুর সংক্রমণ কম ছিল। পুরো বছরের তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সংরক্ষণ করেনি। এর আগের বছর ২০১৯ সালে সেপ্টেম্বর মাস থেকে সংক্রমণ কমতে থাকে।
কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, একাধিক কারণে এ বছর নভেম্বর মাসেও ডেঙ্গুর প্রকোপ চলছে। প্রথমত, জুলাই–আগস্ট ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনে ঘাটতি ছিল। তাতে মশা নিধনের কাজটি ঠিকমতো হয়নি। মশা আছে, একই সঙ্গে রোগীও অনেক। এমন অবস্থায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ে। এ ছাড়া বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও থাকতে পারে।
কবিরুল বাশার মনে করেন, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ডেঙ্গু কমে আসবে। তবে জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে আবার ডেঙ্গু বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি আছে।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন সুহাদা আফরিন ও ড্রিঞ্জা চাম্বুগং]