ন্যায়বিচার ও জবাবদিহি ছাড়া জাতীয় ঐক্য অসম্ভব

রাজধানীর সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন ইয়াসমিন সুকা। মঞ্চে বসা (বাঁ থেকে) সারা হোসেন, কার্লোস ক্যাস্ট্রেসানা ফার্নান্দেজ ও শামসুল বারী। গতকাল বিকেলেছবি: প্রথম আলো

ইতিহাসের শিক্ষা হচ্ছে ন্যায়বিচার ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা ছাড়া রিকনসিলিয়েশন (বিভেদ ঘুচিয়ে একসঙ্গে চলা) ও জাতীয় ঐক্য সম্ভব নয়। কারণ, ন্যায়বিচার ও জবাবদিহি হচ্ছে এই প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন মিলনায়তনে ক্রান্তিকালীন ন্যায়বিচারবিষয়ক আলোচনায় আন্তর্জাতিক দুজন আইনবিশেষজ্ঞ এই অভিমত দিয়েছেন। বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ও সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড লিগ্যাল অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস স্টাডিজ যৌথভাবে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রেক্ষিতে সত্য, ন্যায়বিচার, জবাবদিহিতা ও প্রতিকার: আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার তুলনামূলক অভিজ্ঞতা’ শীর্ষক ওই আলোচনার আয়োজন করে।

আমরা যখন বিভেদ ঘুচিয়ে একসঙ্গে চলার কথা বলি, তখন ইতিহাসের একটি বড় শিক্ষা হচ্ছে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা না করে রিকনসিলিয়েশন ও জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
ইয়াসমিন সুকা, দক্ষিণ সুদানের মানবাধিকার বিষয়ে জাতিসংঘ কমিশনের প্রধান

এমন একটা সময়ে এই আলোচনার আয়োজন করা হলো, যখন ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিগত সরকারের চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচারিক কাজ শুরু হয়েছে। এই বিচারপ্রক্রিয়ায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আওয়ামী লীগ শাসনামলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম এবং জুলাই ও আগস্টে গণ–অভ্যুত্থানসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করেছে।

অনুষ্ঠানে দক্ষিণ সুদানের মানবাধিকার বিষয়ে জাতিসংঘ কমিশনের প্রধান ইয়াসমিন সুকা বলেন, ‘অপরাধের জবাবদিহি নিশ্চিত করাটা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, যা নিয়ে সমাজকে লড়াই চালাতে হয়। আমাদের দেশে (দক্ষিণ আফ্রিকা) রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ১৫ বছর পর ২০০–এর বেশি মামলা আদালতের মাধ্যমে সুরাহা করতে চেয়েছি। এর উদ্দেশ্য ছিল ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো যাতে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার পায়।’

বিচার অতীতের ভুলগুলোকে শুধরে দিতে পারে না। তবে বিচারের মধ্য দিয়ে অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত হয় এবং এটাও প্রমাণ করে যে প্রতিষ্ঠানগুলোকে যথাযথভাবে কাজ করতে হবে।
কার্লোস ক্যাস্ট্রেসানা ফার্নান্দেজ, দক্ষিণ সুদানে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনার

ইয়াসমিন সুকা বলেন, ‘আমরা যখন বিভেদ ঘুচিয়ে একসঙ্গে চলার কথা বলি, তখন ইতিহাসের একটি বড় শিক্ষা হচ্ছে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা না করে রিকনসিলিয়েশন ও জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। আর ন্যায়বিচার ও জবাবদিহি হচ্ছে এই প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।’

ইয়াসমিন সুকা দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন, সিয়েরা লিওনে সত্য ও রিকনসিলিয়েশন কমিশন এবং শ্রীলঙ্কা গৃহযুদ্ধ–পরবর্তী যুদ্ধাপরাধ তদন্তে জাতিসংঘের প্যানেলের সদস্য ছিলেন। তিনি বলেন, প্রত্যেক মানুষের ন্যায়বিচার এবং ক্ষতিপূরণের অধিকার রয়েছে, কিন্তু সমস্যা শুরু হয় যখন একটি দেশের রাজনীতিবিদেরা দুর্নীতির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান দখল করেন। এমন পরিস্থিতিতে বিচার বিভাগ ভয় ছাড়া কাজ করতে পারে না। একটি দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা খুব চ্যালেঞ্জিং কিন্তু অসম্ভব নয়, যদি ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক দুই ধরনের বিচার প্রক্রিয়াকে কাজে লাগাতে পারেন।

ইয়াসমিন সুকা বলেন, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্রমাণের অভাব একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সুতরাং, ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে সাক্ষ্য

সংগ্রহ ও বজায় রাখার বিষয়ে প্রসিকিউটরদের প্রশিক্ষণ জরুরি। কখনো কখনো দুর্নীতিবাজ ও অধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিচার করা যায় না। এই ধরনের ক্ষেত্রে, আন্তর্জাতিক আদালত ব্যবহার করা যেতে পারে।

দক্ষিণ সুদানে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনার কার্লোস ক্যাস্ট্রেসানা ফার্নান্দেজ বলেন, বিচার অতীতের ভুলগুলোকে শুধরে দিতে পারে না। তবে বিচারের মধ্য দিয়ে অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত হয় এবং এটাও প্রমাণ করে যে প্রতিষ্ঠানগুলোকে যথাযথভাবে কাজ করতে হবে। সংঘাত থেকে সহাবস্থানের পথে উত্তরণ এবং আইনের শাসন ফিরিয়ে আনাটা জরুরি।

গুয়াতেমালায় দায়মুক্তির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক কমিশনের কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী কার্লোস ক্যাস্ট্রেসানা ফার্নান্দেজ আরও বলেন, গণতন্ত্র মানে শুধুই নির্বাচন নয়। গণতন্ত্র মানে আইন অনুসরণ করে চলা। আইনের প্রয়োগ ছাড়া গণতন্ত্র নিশ্চিত হয় না। তাই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, সন্ত্রাসবাদের সংজ্ঞা নিয়ে মতভেদ রয়েছে, যা রাজনৈতিক অপব্যবহারের স্বার্থে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যাহোক, নির্যাতনের সংজ্ঞাটি যথার্থভাবেই গৃহীত এবং প্রয়োজন অনুসারে নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার করা যায়।

আলোচনার সঞ্চালক ও ব্লাস্টের সম্মাননীয় নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন বলেন, বাংলাদেশ একটি সংকটময় সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যখন ন্যায়বিচার ও বিভেদ ঘুচিয়ে একসঙ্গে চলার বিষয়টি নিশ্চিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রায়ই আদালতগুলো অতিরিক্ত চাপে পড়ে এবং এটি দেখা যায় যে নাগরিক সমাজ কীভাবে ক্রান্তিকালীন বিচার নিশ্চিত করতে সহায়তা করতে পারে।

আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন ব্লাস্টের ভাইস চেয়ারম্যান শামসুল বারী।