আইন না মানা পৌরসভার প্রতি সরকার ‘নমনীয়’

দুই মাস আগে ৩৩টি পৌরসভার তালিকা স্থানীয় সরকার বিভাগে জমা হয়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

  • প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণি মিলিয়ে দেশে বর্তমানে পৌরসভা রয়েছে ৩২৮টি।

  • ৩৩টি পৌরসভায় ১২ মাস থেকে ৪৭ মাস পর্যন্ত কর্মীদের বেতন-ভাতা বকেয়া।

  • শতাধিক পৌরসভায় কর্মীদের বকেয়া বেতন-ভাতার পরিমাণ প্রায় ৮৭৫ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ সরকারছবি: সংগৃহীত

কোনো পৌরসভায় কর্মকর্তা–কর্মচারীদের ১২ মাসের বেতন-ভাতা বকেয়া থাকলে সরকার সেই পৌরসভার নির্বাচিত পরিষদ ভেঙে দিতে পারবে। অর্থাৎ, সেই পৌরসভার মেয়র ও কাউন্সিলরদের দায়িত্ব থেকে সরে যেতে হবে। গত ১১ এপ্রিল পৌরসভা আইনে এই সংশোধনী আনা হয়। কিন্তু ৩৩টি পৌরসভা তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দিতে না পারলেও কারও বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়নি সরকার।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইন না মানা পৌরসভার মেয়র ও কাউন্সিলরদের সরাতে না চাওয়ার কারণটি রাজনৈতিক। সরকার তাঁদের প্রতি ‘নমনীয়’।

গত জুন মাসে পৌর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংগঠন বাংলাদেশ পৌরসভা সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএসএ) পক্ষ থেকে বেতন দিতে না পারা ৩৩টি পৌরসভার তালিকা স্থানীয় সরকার বিভাগে জমা দেওয়া হয়। এসব পৌরসভায় ১২ মাস থেকে ৪৭ মাস পর্যন্ত বেতন-ভাতা বকেয়া রয়েছে।

বকেয়া বেতন-ভাতা ৩৫ মাসের মতো হবে। পৌরসভার আকার ছোট, ব্যয় বেশি। কর আদায়ের পরিমাণ কম। কর মূল্যায়ন করা যায়নি। ভোটের রাজনীতি করায় একবারে কর বাড়ানোও যায় না।
মেয়র সামছুজ্জামান, কুমারখালী পৌরসভার

দেশে বর্তমানে ৩২৮টি পৌরসভা রয়েছে। এর মধ্যে ‘ক (প্রথম)’, ‘খ (দ্বিতীয়)’ ও ‘গ (তৃতীয়)’ শ্রেণির পৌরসভা রয়েছে। অধিকাংশ পৌরসভার অবস্থাই রুগ্‌ণ। রাজস্ব আয় কম, কর্মীদের বেতন-ভাতা বকেয়া। কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে পৌর মেয়রদের স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগও রয়েছে। বিপিএসএর তথ্য অনুযায়ী, দেশের শতাধিক পৌরসভায় কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বকেয়া বেতন-ভাতার পরিমাণ প্রায় ৮৭৫ কোটি টাকা।

স্থানীয় সরকার বিভাগে জমা দেওয়া তালিকার ৩৩টি পৌরসভার মধ্যে ‘ক’ ও ‘খ’ শ্রেণির পৌরসভাই বেশি। কোনো পৌরসভার বার্ষিক রাজস্ব আয় পরপর তিন বছরের প্রতিবছর গড়ে এক কোটি টাকার বেশি হলে সেটি প্রথম শ্রেণির পৌরসভা। একইভাবে পর পর তিন বছরের প্রতিবছর গড় রাজস্ব ৮০ লাখ টাকার বেশি হলে সেটি দ্বিতীয় শ্রেণির পৌরসভা। আর প্রতিবছরে গড় রাজস্ব আয় ৬০ লাখ টাকার বেশি হলে তা তৃতীয় শ্রেণির পৌরসভা।

প্রায় দেড় শ বছরের পুরোনো কুষ্টিয়ার কুমারখালী পৌরসভা। ‘ক’ বা প্রথম শ্রেণির এই পৌরসভায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ৪৪ মাসের বেতন-ভাতা বকেয়া। পৌর এলাকার নাগরিক সুযোগ-সুবিধাও অপ্রতুল। দ্বিতীয় মেয়াদে এই পৌরসভার মেয়রের দায়িত্বে রয়েছেন মো. সামছুজ্জামান। তিনি কুমারখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য সেলিম আলতাফের চাচা।

কুমারখালী পৌরসভার মেয়র সামছুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বকেয়া বেতন-ভাতা ৩৫ মাসের মতো হবে। পৌরসভার আকার ছোট, ব্যয় বেশি। কর আদায়ের পরিমাণ কম। কর মূল্যায়ন করা যায়নি। ভোটের রাজনীতি করায় একবারে কর বাড়ানোও যায় না। আগামী দুই বছরের মধ্যে বকেয়া বেতন-ভাতার বিষয়টি মীমাংসা হয়ে যাবে।

‘ছয় মাস হলো দায়িত্ব নিয়েছি। এ সময়ে কোনো বেতন বকেয়া নেই। সাবেক মেয়রের সময়ে পৌরকর মূল্যায়ন ও আদায় সঠিকভাবে হয়নি। কীভাবে বকেয়া পরিশোধ করা যায় সে বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’
মেয়র আবু নাসের, সেনবাগ পৌরসভার

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেতন-ভাতা বকেয়া থাকা পৌরসভার বেশির ভাগই রাজনৈতিক বিবেচনায় করা। শর্ত পূরণ না করলেও আইন লঙ্ঘন করে গ্রামীণ বিভিন্ন এলাকাকে পৌরসভা ঘোষণা করা হয়। এসব পৌরসভার পর্যাপ্ত আয় নেই। আয় বাড়াতে তেমন কোনো উদ্যোগও নেই। সরকার পৌরসভা ঘোষণা করেই অনেকটা দায় সেরেছে।

নোয়াখালীর সেনবাগ পৌরসভা ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত। ‘খ’ শ্রেণির এই পৌরসভায় ২৫ মাসের বেতন বকেয়া। এই পৌরসভার মেয়র আবু নাসের গত জানুয়ারিতে দায়িত্ব নিয়েছেন। এর আগে টানা ১০ বছর পৌরসভার মেয়র ছিলেন সেনবাগ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু জাফর। বকেয়া বেতন-ভাতার প্রায় পুরোটাই সাবেক মেয়র আমলের।

সেনবাগ পৌরসভার মেয়র আবু নাসের প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছয় মাস হলো দায়িত্ব নিয়েছি। এ সময়ে কোনো বেতন বকেয়া নেই। সাবেক মেয়রের সময়ে পৌরকর মূল্যায়ন ও আদায় সঠিকভাবে হয়নি। কীভাবে বকেয়া পরিশোধ করা যায় সে বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’

স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন, ২০০৯-এর ৫ ধারায় পৌরসভাকে সরকারের একটি প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আইন অনুযায়ী, পৌরসভার কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বেতন–ভাতা পৌর তহবিল থেকে দিতে হবে। কিন্তু দেশের অধিকাংশ পৌরসভার নিজস্ব আয় পর্যাপ্ত না থাকায় কর্মীদের বেতন-ভাতা দেওয়ার সামর্থ্য নেই।

বাংলাদেশ পৌরসভা সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবদুল আলীম মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ২ মাস আগে ১২ মাসের বেশি বেতন-ভাতা বকেয়া পৌরসভার তালিকা মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কৈফিয়ত চেয়ে মেয়রদের কাছে চিঠি পাঠানো হবে বলা হয়েছিল, তা–ও পাঠানো হয়নি। চিঠি পাঠানো হলে মেয়ররা বেতন-ভাতা পরিশোধের বিষয়ে সতর্ক থাকত।

ঝালকাঠির নলছিটি পৌরসভাটি অতি প্রাচীন। ১৮৬৫ সালে নলছিটি পৌরসভা গঠিত হয়। ১৯৯৯ সালে পৌরসভাটিকে ‘গ’ শ্রেণি থেকে ‘খ’ শ্রেণিতে উন্নীত করা হয়। এই পৌরসভায় কর্মীদের ১৮ মাসের বেতন-ভাতা বকেয়া। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, ন্যূনতম নাগরিক সুবিধাও তাঁরা পাচ্ছেন না। এলাকার অধিকাংশ সড়কই ব্যবহার অনুপযোগী।

স্থানীয় সরকার বিভাগের নগর উন্নয়ন অধিশাখার যুগ্ম সচিব সবুর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বেতন-ভাতা বকেয়া থাকা পৌরসভাগুলোর সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগ করা হচ্ছে। বেতন-ভাতা হালনাগাদ না করতে পারলে মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া হবে।

দেশের পৌরসভাগুলোতে বর্তমানে স্থায়ী কর্মী রয়েছেন ১১ হাজার ৬৭৫ জন। আর অস্থায়ী ভিত্তিতে বা দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করেন এমন কর্মীর সংখ্যা ২০ হাজার ৩৫৫। স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে পৌরসভাগুলোতে অস্থায়ী কর্মী নিয়োগ বন্ধ করতে বলা হলেও সেটি মানা হচ্ছে না। মেয়ররা নিজেদের খেয়ালখুশিমতো অস্থায়ী কর্মী নিয়োগ দিচ্ছেন।

এমন পরিস্থিতিতে পৌরসভার আয়-ব্যয় ও কার্যক্রমে স্বচ্ছতা আনতে ডিজিটাল তথ্যভান্ডার করার উদ্যোগ নিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। ‘প্রমিস’ শীর্ষক একটি সফটওয়্যার তৈরি করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। এই সফটওয়্যারে হালনাগাদের জন্য পৌরসভার জনপ্রতিনিধিসহ স্থায়ী ও চুক্তিভিত্তিক কর্মকর্তা-কর্মচারী, আয়-ব্যয়ের তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। কিন্তু অনেক পৌরসভা এখনো তথ্য পাঠায়নি।

পৌরসভার বকেয়া বেতন-ভাতার বিষয়টিকে রাজনৈতিকভাবে সৃষ্ট সংকট বলে মনে করেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় পৌরসভা করা হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ রেখেই এসব এলাকার উন্নয়ন করা যেত। পৌরসভা করা হলেও কোনো সেবা দেওয়া হচ্ছে না। নিরপেক্ষ পেশাজীবীদের দিয়ে কমিটি করে এসব পৌরসভার আয়-ব্যয়, সার্বিক অবস্থা মূল্যায়ন করে পৌরসভার পরিষদ ভেঙে দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।