প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কর্মসংস্থানে চাই সমন্বিত পদক্ষেপ

‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য কর্মসংস্থান: সমস্যা ও সমাধানের পথ’ শীর্ষক এ বৈঠকের আয়োজন করে বিবিডিএন।

‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য কর্মসংস্থান: সমস্যা ও সমাধানের পথ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে (বাঁ থেকে) সালমা মাহবুব, পিটার বেলেন, মনসুর আহমেদ চৌধুরী ও মোহাম্মদ সোহরাব হোসেন। গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়েছবি: প্রথম আলো

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকারের বিষয়টি সরকার বা নীতিনির্ধারকদের অগ্রাধিকারের তালিকায় পিছিয়ে থাকে। কর্মসংস্থানসহ নানান ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া প্রতিবন্ধী ব্যক্তির উন্নয়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছার পাশাপাশি সরকারি–বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। প্রতিবন্ধিতা–বিষয়ক কার্যক্রমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও সংগঠনকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

গতকাল শনিবার ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য কর্মসংস্থান: সমস্যা ও সমাধানের পথ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকের আলোচকেরা এ কথা বলেছেন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এবং দ্য ইউনাইটেড নেশনস পার্টনারশিপ অন দ্য রাইটস অব পারসন্স উইথ ডিজঅ্যাবিলিটিসের (ইউএনপিআরপিডি) সহায়তায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানসহ মানবাধিকার নিয়ে কর্মরত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বাংলাদেশ বিজনেস অ্যান্ড ডিজঅ্যাবিলিটি নেটওয়ার্ক (বিবিডিএন) এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকটির প্রচার সহযোগী ছিল প্রথম আলো।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার নিয়ে কাজ করা মানবাধিকারকর্মী মনসুর আহমেদ চৌধুরী তাঁর বক্তব্যের শুরুতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলে মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন একজন মানুষকে চোর সন্দেহে পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মনসুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জারি করা সরকারি চাকরিতে কোটাপদ্ধতি সংশোধনের প্রজ্ঞাপনে শুধু ‘শারীরিক’ প্রতিবন্ধী শব্দটি লিখে দেওয়া হয়। অথচ সর্বোচ্চ আদালত যে রায় দিয়েছেন, তাতে ‘শারীরিক’ শব্দ নেই। এ প্রজ্ঞাপন সংশোধনের বিষয়টিতে তিনি গুরুত্ব দেন। এ ছাড়া ‘মেডিকেল ফিটনেস’–এর দোহাই দিয়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চাকরি থেকে বাদ দেওয়া, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের রুলস অব বিজনেস পরিবর্তন না করায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শুধু সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দিকে ঠেলে দেওয়া, ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে একজন করে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিবন্ধীবিষয়ক ফোকাল পারসন থাকলেও পরে তা উধাও হয়ে যাওয়া, জাতিসংঘের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সনদের আলোকে জাতীয় মনিটরিং কমিটি গঠনের কথা থাকলেও তা না করার বিষয়গুলো অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন সংস্কার কমিটির কাছে তুলে ধরতে হবে বলে উল্লেখ করেন।

সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপনে ‘শারীরিক প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ কোটা থাকবে’ কথাটি উল্লেখ করা আছে। গোলটেবিল বৈঠকের আলোচকেরা বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চাহিদা অনুযায়ী ১ শতাংশ কোটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এ ছাড়া প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সঙ্গে হিজড়া জনগোষ্ঠী (প্রজ্ঞাপনে তৃতীয় লিঙ্গ) যোগ থাকায় সংখ্যাটি এমনিতেই কমে যাচ্ছে। এ বিষয়টিতেও সংস্কার করার সুপারিশ করেন তাঁরা।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) চিফ টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার পিটার বেলেন বলেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ইস্যু বা বিষয়টি মূলধারায় গুরুত্ব পাচ্ছে না। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের লিঙ্গভিত্তিক ডেটা তৈরি, বিশ্ববাজারে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কাজের চাহিদা জরিপ করা এবং সর্বোপরি সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহির বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন তিনি। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শুধু চাকরি দিলেই হবে না, তাদের চাকরিক্ষেত্রে ধরে রাখতে হলে ওই ব্যক্তির চাহিদা অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রকে ঢেলে সাজানো, বিভিন্ন আইন ও নীতির বাস্তবায়ন এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চাকরি দেওয়াকে দায় হিসেবে না দেখে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করার সুপারিশ করেন তিনি।

বাংলাদেশ সোসাইটি ফর দ্য চেঞ্জ অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি নেক্সাসের (বি-স্ক্যান) সাধারণ সম্পাদক সালমা মাহবুব জানান, অন্তর্বর্তী সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার কাছে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে কোন কোন পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি, তার সুপারিশ জমা দিয়েছেন।

সালমা মাহবুব বলেন, নতুন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ অন্তর্ভুক্তিমূলক করার চেষ্টা করা হলেও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতিনিধিত্ব রাখা হয়নি। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে কথা বলতে গেলে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির শিক্ষার বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায় নেই। দেশের চলমান পরিস্থিতিতে নানান ইস্যুর ভিড়ে প্রতিবন্ধিতা ইস্যুটি হারিয়ে যাওয়া বা আরও পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী সালমা মাহবুব গণপরিবহন, বিভিন্ন ভবনে প্রবেশগম্যতার বিষয়টিতেও গুরুত্ব দেন।

পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসনকেন্দ্র সিআরপির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ সোহরাব হোসেন বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ বাড়াতে হবে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা না হলে ওই ব্যক্তিকে পুনর্বাসন করা সম্ভব না বলে উল্লেখ করেন সোহরাব হোসেন। কারিগরিসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির পাশাপাশি ওই ব্যক্তির পরিবারের অন্য কোনো সদস্যকেও প্রশিক্ষণের আওতায় আনার সুপারিশ করেন তিনি।

জাতীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সমিতি বাংলাদেশের (নাসিব) সভাপতি মির্জা নুরুল গণি শোভন বলেন, ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়োগে আমাদের মধ্যেও অনীহা কাজ করে। অনেকেই চিন্তা করি তাদের দিয়ে কাজটা করিয়ে নিতে পারব কি না। এই ব্যক্তিদের যে বিশেষ চাহিদা আছে, তা–ও আমরা পূরণ করতে পারছি না।’

মির্জা নুরুল গণি বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভালো উদ্যোক্তা হওয়ার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠান খুলতে যে পুঁজি লাগবে, তা কে দেবে? এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ কার্যক্রম হাতে নিতে পারে।

নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর যুগ্ম সচিব ফারজানা শারমিন বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নের বিষয়টি অনেকটা চাল আছে তো চুলা নেই, এমন পরিস্থিতিতে আছে। কারখানাগুলো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চাকরির জন্য দরজা খোলা রেখেছে। কিন্তু কমিউনিটি থেকে একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি কীভাবে আসবেন, তা নিশ্চিত করা হয়নি। কারখানার ভেতরে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য হোস্টেলের ব্যবস্থা রাখা, ভবন নির্মাণের সময়ই ভবনটি যাতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবান্ধব হয়, তা নিশ্চিত করা এবং পোশাকশিল্প কারখানায় শুধু অপারেটর পদে নিয়োগ না দিয়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির দক্ষতা অনুযায়ী অন্য পদেও যাতে নিয়োগ দেওয়া হয়, সে সুপারিশ করেন তিনি।

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের ডিজঅ্যাবিলিটি ইনক্লুশন জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভার্সিটি প্রোগ্রামের লিড মো. জাহিদুল কবির বলেন, অনেকের ধারণা, একটি র‍্যাম্প বানিয়ে দিলেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তির চাহিদা পূরণ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিষয়টি আসলে তা না। প্রতিবন্ধী মানুষের মধ্যে নানা বৈচিত্র্য আছে, এমনকি শহুরে আর গ্রামীণ প্রতিবন্ধী নারী যে সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন, তা এক নয়। তাই প্রতিবন্ধী ব্যক্তির উন্নয়নে এই বিষয়গুলোকে মাথায় রাখতে হবে।

ইউএন উইমেনের ন্যাশনাল প্রজেক্ট সাপোর্ট অফিসার দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী নাজমা আরা বেগম (পপি) বলেন, প্রতিবন্ধী নারীদের ভোগান্তির মাত্রাটা একটু বেশি। চাকরিক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী নারীরা কেন পিছিয়ে আছেন, তা নিয়ে তেমন কোনো গবেষণাও নেই। ২০১৩ সালের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সুরক্ষা আইনসহ বিভিন্ন আইনেও প্রতিবন্ধী নারীর বিষয়টি গুরুত্ব পায়নি।

উইমেন উইথ ডিজঅ্যাবিলিটি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর প্রিয়তা ত্রিপুরা বলেন, প্রতিবন্ধী নারীরা কাজ করে আয় করলেও তাদের সেই টাকা খরচ করা বা কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকে না। স্বামী, মা বা অন্যরা এই টাকা খরচ করেন।

সাইটসেভারস বাংলাদেশের অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড কমিউনিকেশন কো-অর্ডিনেটর খন্দকার সোহেল রানা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানের জন্য তথ্যভান্ডার থাকা, কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন, এসএমই ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য আলাদা ইউনিট গঠনের সুপারিশ করেন। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়োগ দিলে কর মওকুফের যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তা কেন কাজে লাগছে না, সে বিষয়টিও তলিয়ে দেখা দরকার বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

বৈঠকে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন বিবিডিএনের হেড অব অপারেশনস আজিজা আহমেদ। বৈঠকে সমাপনী বক্তব্যের মাধ্যমে সবাইকে ধন্যবাদ দেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।