‘মার্কস অ্যাক্টিভ স্কুল চেস চ্যাম্পস’ সিলেট বিভাগীয় চ্যাম্পিয়নদের গল্প
দাবার সৌন্দর্যে বিশ্বব্যাপী মুগ্ধতা ছড়াতে চায় সেরারা
‘দুটি পাতা একটি কুড়ির দেশ’ হিসেবে খ্যাত সিলেট। চায়ের সুবাদেই সিলেটের সুনাম ছড়িয়ে আছে বিশ্বব্যাপী। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত প্রাচীন এই জনপদ বনজ, খনিজ ও মৎস্য সম্পদে ভরপুর। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত সিলেটের রয়েছে প্রসিদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্য। নানা বৈচিত্র্যের সম্ভার সিলেট দেশের অন্যতম পর্যটন এলাকা। এ অঞ্চলের মানুষের অন্যতম প্রিয় খেলা দাবা। বুদ্ধিভিত্তিক এই খেলাটি ‘পারিবারিক খেলা’ হিসেবেও অঞ্চলটিতে পরিচিত। এবার সিলেটের কয়েকটি পরিবারের খুদে সদস্য দাবা খেলে দেশসেরা হওয়ার প্রাথমিক ধাপ পার করেছে। ‘মার্কস অ্যাক্টিভ স্কুল চেস চ্যাম্পস’ প্রতিযোগিতায় বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয়। এই চ্যাম্পিয়নদের লক্ষ্য দাবার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী সিলেটের নাম ছড়িয়ে দেওয়া।
দাবা ও চা—প্রমিত দত্তর দুটোই পছন্দ। সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণিপড়ুয়া প্রমিত দত্তের দলই হয়েছে বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় দাবায় হাতেখড়ি তার। তবে দাবার প্রতি ভালোবাসা গভীর হয় করোনার অলস সময়ে। প্রায় দুই বছর বাসায় থাকতে থাকতে অন্যদের মতো প্রমিতের মধ্যেও একঘেয়েমি ভর করেছিল। তাই বন্ধুদের সঙ্গে অনলাইনে দাবা খেলে সময় কাটাত সে। সেই ‘অলস সময় কাটানোর বুদ্ধি’ যে বৃথা যায়নি, তা এবার প্রমাণ হলো। পরিবারের সদস্যরাও প্রমিতকে উৎসাহ দিচ্ছেন দাবার প্রতি আরও মনোযোগী হতে।
চ্যাম্পিয়ন দলের আরেক সদস্য বিশ্বজিৎ দাস শ্রেষ্ঠ। নামের প্রতি ‘সুবিচার’ করেছে সে। দলগতভাবে শ্রেষ্ঠ হয়েছে। এবার জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ হয়ে তারপর বিশ্বজয় করার স্বপ্ন তার। ছোটবেলায় শ্রেষ্ঠ ছিল খুব চঞ্চল আর দুষ্টু। বাবা-মা চিন্তিত ছিলেন শ্রেষ্ঠকে নিয়ে। বলতে গেলে তাকে সুস্থির রাখতেই কিনে দেওয়া হয় একটি দাবার বোর্ড। প্রথম প্রথম অবশ্য সাদা–কালো বোর্ড ও ঘুঁটি দেখে বিরক্ত হয়েছিল শ্রেষ্ঠ। কিন্তু ধীরে ধীরে দাবা খেলার প্রতি আগ্রহ তৈরি হতে থাকে তার। অস্থির শ্রেষ্ঠকে ‘শান্ত’ রাখতে টনিক হিসেবে কাজ করেছে দাবা। আর এভাবেই চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য হয়ে পরিবারের পাশাপাশি নিজের স্কুলকেও গর্বিত করেছে সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিপড়ুয়া শ্রেষ্ঠ।
সিলেটের শিশু ও তরুণদের দাবা খেলা শেখান সাফওয়ান স্বাধীন অর্জনের বাবা সনাতন জাহিদ। তাঁর স্বপ্ন—সিলেটের তরুণেরা দাবা খেলে একদিন বিশ্বব্যাপী সুনাম কুড়াবে। সে লক্ষ্যেই দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দাবাড়ু তৈরিতে কাজ করছে সনাতন জাহিদের একাডেমি। অন্যদের পাশাপাশি নিজের ছেলেকেও দাবায় দক্ষ করে গড়ে তুলছেন তিনি। সাফওয়ানের দাবায় হাতেখড়ি ছয় বছর বয়সে।
বর্তমানে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তার রেটিং সাড়ে ১৬। সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির এই শিক্ষার্থী সারা দেশের মধ্যে জুনিয়র দাবা প্রতিযোগিতাতেও সাফল্য পেয়েছে। বাবা দাবার প্রশিক্ষক হলেও বন্ধুদের সঙ্গে দাবা খেলেই জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে সাফওয়ান।
কিছু পরিবার আছে, যাদের কাছে দাবা খেলা অনেকটাই বাধ্যতামূলক! অবস্থাটা এমন, পড়াশোনার পাশাপাশি দাবা খেলায় মনোযোগী হলে সবার কাছে মেধাবী ছেলে হিসেবে পরিচিতি মেলে। তেমনই একটি পরিবারে বেড়ে ওঠা শাহরিয়ার আমিন আরিফের। নবম শ্রেণিপড়ুয়া আরিফ চার বছর বয়সেই দাবা খেলা শিখেছে। আরিফের মা-বাবার বিশ্বাস, ছোটবেলা থেকে দাবা খেললে শিশুরা একটা বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের মধ্যে দিয়ে যায়, যা ভবিষ্যতে তাদের সৃজনশীল চিন্তাভাবনা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। তাই দক্ষ দাবা-প্রশিক্ষকের কাছে আরিফকে দাবা খেলা শেখাচ্ছেন তাঁরা। তাঁদের প্রচেষ্টা বৃথা যায়নি। দলগতভাবে বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় আরিফের সাফল্যের আনন্দ ছুঁয়ে গেছে পরিবারের সদস্য, নিজ স্কুলসহ সিলেটবাসীকে।
প্রায় এক মাস ধরে বিশ্ব মাতোয়ারা ছিল বিশ্বকাপ ফুটবলে। এই ডামাডোলের মধ্যে কেউ কেউ মজেছে দাবাতে। তাদের কাছে দাবাড়ুরা আক্ষরিক অর্থেই বড় তারকা। তাই গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার লক্ষ্য নিয়েই চর্চা চালিয়ে যাচ্ছে সিলেট বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন দলের কনিষ্ঠতম সদস্য মুনভী সরকার। সপ্তম শ্রেণিপড়ুয়া এই খুদে দাবাড়ু দেশ ও পরিবারের জন্য সম্মান বয়ে আনতে চায় দাবা খেলার মাধ্যমে। মুনভীর স্বপ্ন—কেবল দাবা খেলা দেখার উদ্দেশেই পথচারীরা বড় স্ক্রিনে হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকবে, প্রিয় খেলোয়াড়ের পক্ষে গলা ফাটাবে, প্রতিপক্ষকে হারাতে পারলে উল্লসিত হবে, যে রকমটা সাধারণত দেখা যায় ফুটবল বা ক্রিকেটে। দেশের হয়ে মুনভী নিয়মিত হারাতে চায় রাশিয়া, চীন বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের দাবাড়ুদের।
চ্যাম্পিয়ন দাবা দলটির অন্য সদস্য আদনান হুসাইন। নবম শ্রেণিপড়ুয়া আদনানেরও লক্ষ্য জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়া। বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের তত্ত্বাবধানে ও আবুল খায়ের গ্রুপের পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত এই প্রতিযোগিতায় ট্রফি, মেডেল বা সার্টিফিকেট অর্জনের চেয়েও সিলেটকে দেশসেরা বানানোই আদনাদের স্বপ্ন। যে স্বপ্নের ডালপালা একদিন ছড়িয়ে যাবে দেশ থেকে আন্তর্জাতিক পরিসরে। আর বাংলাদেশের খুদে দাবাড়ুদের খেলায় মুগ্ধ হবে পুরো বিশ্ব।