বাংলাদেশেই ক্যানসার চিকিৎসাবিষয়ক অনলাইন আলোচনা
সঠিক সময়ে ডায়াগনোসিস হলে স্তন ক্যানসারে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ৯৯ শতাংশ
‘১৮০৪ সালে একজন জাপানিজ অনকোলজিস্ট প্রথমবারের মতো স্তন ক্যানসারের সার্জারি করেন। সে সময় এ ধরনের ক্যানসার নিয়ে ছিল না কোনো পর্যাপ্ত গবেষণা ও চিকিৎসাব্যবস্থা। তাই এর মৃত্যুর হারও ছিল ভয়াবহ। বর্তমানে ক্যানসারের গবেষণা ও আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থার কারণে এর বিরুদ্ধে জয়ী হওয়ার হার ৯৯ শতাংশ।’ এমন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করেন উপস্থাপক নাসিহা তাহসিন।
অক্টোবর মাস স্তন ক্যানসার নিয়ে বিশ্বব্যাপী সচেতনতার মাস হিসেবে পালিত হয়। এ উপলক্ষে এসকেএফ অনকোলজি আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় ‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা। এতে আলোচক হিসেবে ছিলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সিনিয়র ক্লিনিক্যাল অনকোলজিস্ট ও সহকারী অধ্যাপক ডা. আলী আসগর চৌধুরী, সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবু খালেদ মুহম্মদ ইকবাল এবং মেরিন সিটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সাগরিকা শারমিন। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে স্তন ক্যানসারের বর্তমান পরিস্থিতি, ডায়াগনোসিস, রিস্ক ফ্যাক্টর, চিকিৎসাব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে পরামর্শ দেন আলোচকেরা। ১৬ অক্টোবর পর্বটি সরাসরি প্রচারিত হয় প্রথম আলো, এসকেএফ অনকোলজি ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে।
স্তন ক্যানসার সচেতনতার মাসের গুরুত্ব সম্পর্কে ডা. সাগরিকা শারমিন বলেন, ‘উপমহাদেশের নারীরা আর্থসামাজিকভাবে অবহেলিত। তাই তাঁরা যখন স্তন ক্যানসার নিয়ে চিকিৎসকের কাছে আসেন, তখন অধিকাংশই থাকেন “অ্যাডভান্স স্টেজ”-এ। তাই অক্টোবর মাস সচেতনতার মাস হলেও বাকি ১১ মাসও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।’
স্তন ক্যানসার কী এবং এর রিস্ক ফ্যাক্টর সম্পর্কে জানতে চান উপস্থাপক। এ প্রসঙ্গে ডা. আলী আসগর চৌধুরী বলেন, ‘স্তনে কোষের অস্বাভাবিক পরিবর্তন হলে তাকে স্তন ক্যানসার বলা হয়। রিস্ক ফ্যাক্টর মানে হলো কারা ঝুঁকিতে আছেন? তাঁরা হলেন নারী, বয়স্ক নারী-পুরুষ; অর্থাৎ এটা বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত। এ ছাড়া নির্দিষ্ট বয়সের আগেই যেসব নারীর ঋতুস্রাব শুরু হয় এবং দেরিতে বন্ধ হয়, যাঁরা চর্বিজাতীয় খাবার খান, কায়িক শ্রম করেন না, দেহের স্থুলতা নিয়ন্ত্রণ করেন না, বংশের কারও এ ক্যানসার ছিল—এ ধরনের মানুষদের সতর্ক থাকতে হবে। তবে বাংলাদেশে ৫০ বছরের নিচে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। ফলে অকালমৃত্যু ঘটছে ১৫ থেকে ৫০ বছর বয়সী নারীদের, যাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই নিম্ন আয়ের। তাই দরকার সচেতনতা বৃদ্ধি।’
স্তন ক্যানসারের লক্ষণ সম্পর্কে ডা. আবু খালেদ মুহম্মদ ইকবাল বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট বয়স পরে কেউ যদি স্তনে ব্যথাহীন গোটা, বগলের নিচে কোনো ব্যথাহীন চাকা, স্তনের চামড়ার রং পরিবর্তন ইত্যাদি পেয়ে থাকেন, এগুলোই স্তন ক্যানসারের প্রাথমিক উপসর্গ।’ এ ধরনের রোগীরা কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন? উপস্থাপক জানতে চাইলে ডা. আবু খালেদ মুহম্মদ ইকবাল বলেন, ‘লক্ষণগুলোর যেকোনো একটি দেখামাত্রই অবহেলা না করে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত।’
ক্যানসারের ক্ষেত্রে ‘জেনেটিক হিস্ট্রি’র প্রভাব সম্পর্কে ডা. সাগরিকা শারমিন বলেন, ‘এটি গুরুত্বপূর্ণ। কোনো নারীর মা-বোনের বা নানি-খালাদের যদি স্তন ক্যানসার থাকে, তাঁরও এটি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। তবে মা-বোনের থাকলে ঝুঁকিটা বেশি। তাই যাঁদের বংশের কারও ক্যানসার আছে, তাঁদের উচিত হবে নির্দিষ্ট বয়সের আগেই স্ক্রিনিং করা।’ সঙ্গে স্ক্রিনিংয়ের গুরুত্ব বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘স্ক্রিনিংয়ের গুরুত্ব অনেক। এর মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায়ে স্তন ক্যানসার শনাক্ত করা সহজ। এতে সুস্থতার হার অনেক গুণ বেশি। তাই নির্দিষ্ট বয়সের পর নারীদের এ ধরনের স্ক্রিনিং করা দরকার।’
নারীরা অ্যাডভান্স স্টেজেই কেন চিকিৎসকের কাছে আসেন, এর কারণ কী? উত্তরে ডা. সাগরিকা শারমিন বলেন, ‘আমাদের দেশের অধিকাংশ নারীই পরিবারের সদস্যদের প্রতি এতটা যত্ন নেন যে নিজের যত্ন নিতেই ভুলে যান। তাই শুরুতে এ ধরনের সমস্যাকে তাঁরা গুরুত্ব দেন না। এ ব্যাপারে নারীদের উচিত নিজেদের প্রতি যত্ন বাড়ানো। সেই সঙ্গে পরিবারের অন্য সদস্যদেরও সেই নারীর প্রতি বিশেষ যত্ন নিতে হবে। এ ছাড়া স্ক্রিনিংয়ে কোনো কিছু অনুভূত হওয়ামাত্র অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে দেখাতে হবে।’
মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়া নারীদের হরমোন থেরাপি নিলে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি কতটুকু বাড়ে? উপস্থাপকের এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. আলী আসগর চৌধুরী বলেন, ‘৪৫ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে নারীদের মাসিক একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। এই অবস্থাকে বলা হয় “মেনোপজ”। এ সময় একজন নারীর নানা রকম শারীরিক ও মানসিক কষ্ট হয়, তাই অনেকেই হরমোন গ্রহণ করেন। একে “হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি” বলা হয়, যা গ্রহণ করলে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। যদিও আমাদের দেশে এ ধরনের থেরাপির প্রচলন খুবই কম। তবু এ ব্যাপারে থাকতে হবে সচেতন।’
স্তন ক্যানসারে সার্জারির সঠিক সময় প্রসঙ্গে ডা. আবু খালেদ মুহম্মদ ইকবাল বলেন, ‘সলিড টিউমারের ক্ষেত্রে অবশ্যই সার্জারি প্রয়োজন। বাকিটা ওই গুটির অবস্থান, ধরন এবং রিসেপটরগুলোর পজেটিভ-নেগেটিভ হওয়ার ওপর নির্ভর করে। তাই বলতে পারি, অনেক ক্ষেত্রে শুরুতেই আবার কখনো কেমোথেরাপির পর সার্জারি হয়।’
সার্জারির ধরন সম্পর্কে ডা. আবু খালেদ মুহম্মদ বলেন, ‘একধরনের সার্জারি হলো পুরো স্তন ফেলে দেওয়া, যাকে মেডিকেলের ভাষায় বলে “মডিফাইড রেডিক্যাল মাস্টেকটমি”। যদি রোগী স্তন রাখতে চান বা চিকিৎসক যথাযথ মনে করলে “ব্রেস্ট কনজার্মিং সার্জারি” করেন। যদিও প্রতিটির মধ্যে আরও ভাগ আছে। তবে প্রধানত এ দুই প্রকারের সার্জারিই হয়ে থাকে।’
স্তন ক্যানসারের দেশ ও বিদেশের মধ্যে চিকিৎসাব্যবস্থার পার্থক্য সম্পর্কে ডা. আলী আসগর চৌধুরী বলেন, ‘করোনা মহামারির সময় দুই বছর যখন কেউ বিদেশ যেতে পারেননি, তখন কিন্তু দেশেই ক্যানসারের চিকিৎসা হয়েছে। সুতরাং নির্দ্বিধায় বলতে পারি, আমাদের এখানে চিকিৎসাপদ্ধতি আন্তর্জাতিক মানের। আর হাসপাতাল-ওষুধও পর্যাপ্ত পরিমাণে রয়েছে। শুধু রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আর্থিক অনুদান নিশ্চিত করা গেলে অস্বচ্ছল রোগীদের ক্যানসারের বিরুদ্ধে জয়ী হওয়ার হার বেড়ে যাবে।’