গুম কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন
গুমের পর লাশও গুম: কারও লাশ রেললাইনে, কারও নদীতে
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে গত শনিবার গুম কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। এতে আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে বিরোধী মতের মানুষকে গুমের সঙ্গে কারা জড়িত, কীভাবে গুম করা হতো, কীভাবে নির্যাতন বা হত্যা করা হতো, তার নানা বর্ণনা উঠে এসেছে। ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় উঠে এসেছে নানা চিত্র। প্রতিবেদনে অপহরণের কৌশল নিয়ে উঠে আসা চিত্র পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
জোরপূর্বক বিভিন্ন ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে ৪৮ ঘণ্টা থেকে কয়েক সপ্তাহ, কয়েক মাস, এমনকি ৮ বছর পর্যন্ত গোপন বন্দিশালায় আটকে রাখা হতো। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিকে মাথায় গুলি করে হত্যার পর লাশের সঙ্গে সিমেন্টভর্তি ব্যাগ বেঁধে ফেলে দেওয়া হতো নদীতে। আবার কারও লাশ ছিন্নবিচ্ছিন্ন করতে ফেলে রাখা হতো রেললাইনে।
গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোর নৃশংস নির্যাতনের এসব তথ্য উঠে এসেছে। ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ’ (সত্য উন্মোচন) শীর্ষক এই প্রতিবেদন গত শনিবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেওয়া হয়। প্রতিবেদনের ‘প্রকাশযোগ্য অংশ’ গতকাল রোববার বিভিন্ন গণমাধ্যমকে সরবরাহ করেছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং।
কমিশনের তদন্ত, ঘটনায় জড়িত কর্মকর্তা ও নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের বক্তব্যে উঠে এসেছে গুম ও নির্যাতনের ভয়াবহ বর্ণনা। গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনেক সময় কাউকে আটকের পর নির্যাতন করে অন্যদের নাম বের করা হতো। এরপর তাঁদেরও ধরে এনে নির্যাতন করা হতো। পরে সবাইকে গুম করা হতো। এ ছাড়া রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি অথবা তাঁদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের সরাসরি নির্দেশে গুম ও নির্যাতন করা হতো। কারও যৌনাঙ্গসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হতো, কাউকে পেটানো হতো। গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের নির্যাতন করতে বিশেষ যন্ত্রও ব্যবহার করা হতো।
২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত গুমের ঘটনাগুলো তদন্ত করতে অন্তর্বর্তী সরকার গত ২৭ আগস্ট কমিশন গঠন করে। এই কমিশন ১ হাজার ৬৭৬টি জোরপূর্বক গুমের অভিযোগ পেয়েছে। এর মধ্যে ৭৫৮টি অভিযোগ পর্যালোচনা করেছে তারা। কমিশন এখন পর্যন্ত যে ৭৫৮ জনের অভিযোগ যাচাই-বাছাই করেছে, তার মধ্যে ৭৩ শতাংশ ভুক্তভোগী ফিরে এসেছেন। বাকি ২৭ শতাংশ (অন্তত ২০৪ জন) এখনো নিখোঁজ রয়েছেন।
কমিশন প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে যাঁরা ফিরে এসেছেন, তাঁদের অনেককে সন্ত্রাসবিরোধী আইন, অস্ত্র আইন, বিস্ফোরকদ্রব্য আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইন অথবা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ বিভিন্ন আইনে করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, চারটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে এমন সব ঘটনাকে গুম হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে কমিশন। সেগুলো হলো ভুক্তভোগীর স্বাধীনতা হরণ; ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় বাহিনী বা কর্তৃপক্ষের সম্পৃক্ততা অথবা তাদের প্ররোচনা থাকা; বন্দীর অবস্থান সম্পর্কে তার পরিবারকে না জানানো এবং ভুক্তভোগীকে কোনো আইনি সুরক্ষা না দেওয়া।
প্রতিবেদনে অপহরণ, আটক, নির্যাতন, হত্যা ও মুক্তি—এই পাঁচ ভাগে গুমের ঘটনাগুলোর কথা বলা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, র্যাব, পুলিশ, ডিবি, সিটিটিসি, ডিজিএফআই ও এনএসআই—এই গুমের
ঘটনাগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত। সাধারণত সাদাপোশাকে ভুক্তভোগীদের তুলে নেওয়া হতো এবং নিজেদের পরিচয় গোপন করার জন্য এক সংস্থা আরেক সংস্থার নাম ব্যবহার করত। গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের কাউকে কাউকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিনিময় করার তথ্যও র্যাবের গোয়েন্দা শাখার সংশ্লিষ্টদের বক্তব্যের মাধ্যমে পেয়েছে তদন্ত কমিশন। সুখরঞ্জন বালি এবং বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিন আহমদকে গুমের পর ভারতে স্থানান্তরের ঘটনা কমিশনের প্রতিবেদনে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
গুমের ঘটনায় নির্দেশদাতা হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছে কমিশন। এ ছাড়া হাসিনা প্রশাসনের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার গুমের ঘটনায় সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। যাঁদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান এবং পুলিশ কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলাম ও মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।
যেভাবে গুম করা হতো
প্রতিবেদনে বলা হয়, যাঁকে গুম করা হতো, প্রযুক্তির সহায়তায় তাঁর অবস্থান আগেই জেনে নেওয়া হতো। ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্সের (ডিজিএফআই) তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ন্যাশনাল মনিটরিং সেন্টার (এনএমসি) এবং পরবর্তী সময়ে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) মোবাইলে নজরদারি পরিচালনা করত বলে কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে আসে।
কমিশন বলেছে, গুমের ঘটনাগুলোতে জড়িত বিভিন্ন সংস্থা ও বাহিনীর সদস্যরা কখনো নিজেদের ‘প্রশাসনের লোক’ হিসেবে পরিচয় দিতেন। পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) অভিযান চালিয়ে নিজেদের র্যাব বলে দাবি করত। আবার র্যাব (র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন) নিজেদের ডিজিএফআই হিসেবে পরিচয় দিত—এমন ঘটনাও ঘটেছে। সাধারণত গুম বা অপহরণের ঘটনাগুলো ঘটত রাতে। ভুক্তভোগীকে বাড়ি বা সড়ক থেকে জোরপূর্বক গাড়িতে (মাইক্রোবাস) তুলে নেওয়া হতো। এরপর চোখ বাঁধা হতো এবং হাতকড়া পরানো হতো। ঘটনাটি এত দ্রুত ঘটত যে আশপাশে থাকা মানুষ বুঝতেও পারত না যে কাউকে অপহরণ করা হয়েছে।
নির্যাতনের বর্ণনা
গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে নির্যাতন ও হত্যার কয়েকটি ঘটনার ভয়াবহ বর্ণনা উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, আটকের পর ভুক্তভোগীদের সাধারণত গোপন অন্ধকার কক্ষে রাখা হতো এবং সেখানেই তাঁদের ওপর নানা ধরনের নির্যাতন চালানো হতো। কয়েকজন ভুক্তভোগীর সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে কমিশন বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে এমন আটটি গোপন বন্দিশালার সন্ধান পাওয়ার কথা জানিয়েছে। যেগুলো ডিজিএফআই, র্যাব, কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট পরিচালনা করত।
নির্যাতনের একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১০ সালে ঢাকার ধানমন্ডি থেকে র্যাব এক যুবককে অপহরণ করে কোনো চেতনানাশক ছাড়াই তাঁর ঠোঁট সেলাই করে দেয়। গুম করে অনেককে হত্যা করার প্রমাণ পাওয়ার কথা জানিয়েছে কমিশন। এ ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় মাথায় গুলি করে মেরে ফেলা হতো। লাশ সিমেন্টের ব্যাগ দিয়ে বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হতো। যেসব নদীতে লাশ গুম করা হতো, তার মধ্যে রয়েছে বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা। নদীতে লাশ ফেলার জন্য ঢাকার পোস্তগোলা ও কাঞ্চন ব্রিজ ব্যবহার করা হতো।
র্যাবে কর্মরত একজনের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এক ভুক্তভোগী নদীতে ঝাঁপিয়ে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। পরে তাঁকে উদ্ধারের পর সেখানেই গুলি করে হত্যা করা হয়। আরেকটি ঘটনার বর্ণনায় বলা হয়, একটি লাশ ছিন্নবিচ্ছিন্ন করতে রেললাইনের ওপর ফেলে রাখা হয়েছিল। আরেকটি ঘটনায় তুলে নেওয়া এক ব্যক্তিকে সড়কে চলন্ত গাড়ির সামনে ধাক্বা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়। তবে গাড়িটি পাশ কেটে চলে যাওয়ায় তিনি প্রাণে বেঁচে যান।
একটি ব্রিজের ওপর দুজন ভুক্তভোগীকে গুলি করে হত্যার ঘটনা র্যাবের একটি ‘ওরিয়েন্টেশন’ অনুষ্ঠানে দেখানো হয়েছে—এমন তথ্য কমিশনকে জানিয়েছেন এক সাক্ষী।
গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে বলছে, গুমের ঘটনাগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা অনেক সময় জানতেনও না তাঁরা কাকে এবং কেন হত্যা বা নির্যাতন করছেন। এক দল কোনো ব্যক্তিতে তুলে আনত, অন্য দল তাঁকে বন্দিশালায় আটকে রাখার কাজ করত এবং তৃতীয় দল ওই ব্যক্তিকে হত্যা করত বা মুক্তি দিত।