উদ্যোক্তা হওয়ার প্রশিক্ষণ নিয়েও কিছু করতে পারছেন না ৪৪ শতাংশ নারী

রাজধানীর শেওড়াপাড়ার প্রশিক্ষণকেন্দ্রে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন নারীরা। গত ১৬ জুলাই তোলাছবি: প্রথম আলো

কর্মসংস্থান তৈরির লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর পাঁচজন নারীকে সরকারি অনুদান দিয়ে একটি খাবারের দোকান (ফুড কর্নার) করে দেওয়া হয়। রাজধানীর পূর্ব শেওড়াপাড়ায় সেই দোকান। গত ১৬ জুলাই দোকানে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে খাবার বিক্রির কোনো বন্দোবস্ত নেই। শোকেস পুরো ফাঁকা। জানা গেল, পাঁচজন উদ্যোক্তার সবাই সমানভাবে দায়িত্ব পালন করেননি। দুজন এরই মধ্যে প্রকল্পের অর্থ ফেরত দিয়েছেন। আর পাঁচজনের একজন খোদেজা বেগম দোকানটি কোনোরকমে টিকিয়ে রেখেছেন।

একই এলাকার আরেকজন নারী উদ্যোক্তা এ বছরের শুরুতে ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের ওপর প্রশিক্ষণ নেন। কিন্তু স্ত্রীর আয় করার ক্ষেত্রে স্বামীর আপত্তি থাকায় তিনি আর কিছু করতে পারেননি। আর সাতক্ষীরা শ্যামনগর উপজেলার আরেক নারী রেক্সোনা পারভীন সংসারের অনটন ঘোচাতে ২০২২ সালে ক্যাটারিংয়ের প্রশিক্ষণ নেন। কিন্তু অর্থাভাবে এখনো প্রশিক্ষণকে কাজে লাগিয়ে নিয়মিত আয়ের বন্দোবস্ত করতে পারেননি।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিষ্ঠান জাতীয় মহিলা সংস্থার ‘তৃণমূল পর্যায়ে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে নারী উদ্যোক্তাদের বিকাশ সাধন’ প্রকল্পে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন ওই নারীরা। প্রকল্পটির উদ্দেশ্য হলো কর্মসংস্থান তৈরি করা। ৮০ দিন মেয়াদের এই প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষণার্থীদের প্রতিদিন ১৫০ টাকা করে ভাতা দেওয়া হয়।

প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর শতভাগ প্রশিক্ষণার্থী উদ্যোক্তা হবেন, এমনটা আশা করা যায় না। তবে সবাই কাজ শিখে উপকৃত হয়েছেন।
—প্রভাষ চন্দ্র রায়, প্রকল্প পরিচালক

প্রকল্পটি নিয়ে গত জুনে সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ণ বিভাগ (আইএমইডি)। সেখানে বলা হয়, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা অর্জনের ৬ মাস পার হওয়ার পরও ৪৪ শতাংশের বেশি প্রশিক্ষিত নারী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারেননি। এর অন্যতম কারণ অর্থের সংকট।

আইএমইডির সমীক্ষা প্রতিবেদনের জন্য ১৬টি জেলার ১৬টি প্রশিক্ষণকেন্দ্রের ২ হাজার নারীর কাছ থেকে তথ্য নেওয়া হয়। প্রশিক্ষক ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বেশ কয়েকজন নারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কেউ অর্থসংকটের কারণে, কারও আগ্রহ কম থাকার কারণে, কেউ আবার পরিবারের আপত্তির কারণে কোনো কাজে যুক্ত হননি।

৪২৭ কোটি ৯৭ লাখ টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটি শুরু হয়েছে ২০২১ সালে, যা শেষ হবে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ২ লাখ ৫৬ হাজার নারীর দক্ষতা উন্নয়নের লক্ষ্য রয়েছে। এর আগে ‘অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে নারী উদ্যোক্তাদের বিকাশ সাধন’ নামের প্রকল্পের ১ম, ২য় ও ৩য় পর্যায় বাস্তবায়ন হয়েছে। সেই প্রকল্পের আদলে নতুন আকারে এ প্রকল্প নেওয়া হয়। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে এসব প্রশিক্ষণ পরিচালিত হয়।

প্রশিক্ষক ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোনো নারী অর্থসংকটে, কেউবা আগ্রহ কম থাকায়, আবার অনেকে পরিবারের সদস্যদের আপত্তির কারণে (বিশেষত বিবাহিত নারীদের স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের) কাজে যুক্ত হতে পারেননি।

সমীক্ষা প্রতিবেদন ও প্রকল্পের তথ্য অনুসারে, ১ হাজার ৬০০ নারীকে উদ্যোক্তা হিসেবে ব্যবসা পরিচালনার জন্য ৮০টি করে বিক্রয় ও প্রদর্শনী কেন্দ্র, ফুড কর্নার এবং বিউটি পারলার করে দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিটি পারলার ও ফুড কর্নারের দায়িত্ব দেওয়া হবে পাঁচ নারীকে এবং বিক্রয়কেন্দ্র পরিচালনার দায়িত্ব ১০ জন নারী উদ্যোক্তাকে দেওয়া হবে।

বিক্রয় ও প্রদর্শনী কেন্দ্রের জন্য এককালীন মোট আড়াই লাখ টাকা ও প্রথম দুই বছরের ভাড়া (মাসে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা) ও বিদ্যুৎ বিল প্রকল্প থেকে দেওয়া হবে। পারলার ও ফুড কর্নারের জন্য এককালীন দুই লাখ টাকা ও এক বছরের বিদ্যুৎ বিলসহ ভাড়া দেওয়া হবে। মালামাল কেনার জন্য ওই নারীদের প্রত্যেকে ১৫ হাজার টাকা পাবেন।

এ বছরের জুন পর্যন্ত দেড় লাখ নারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। উদ্যোক্তা হিসেবে সহায়তা পেয়েছেন ১ হাজার ২০ জন। চালু হয়েছে দেড় শ কেন্দ্র।

পথটা বেশ বন্ধুর

প্রকল্পের আওতায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় প্রশিক্ষণকেন্দ্র একটি। পূর্ব শেওড়াপাড়ায় সেটি হওয়ায় প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও হয়ে পড়েছে এলাকাকেন্দ্রিক।

গত ১৬ জুলাই প্রশিক্ষণকেন্দ্রটিতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে যাঁরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন, তাঁরা সবাই আশপাশের বাসিন্দা। আর প্রকল্পের আওতায় স্থাপন করা ফুড কর্নার ও বিউটি পারলারও একই এলাকায় প্রশিক্ষণকেন্দ্রের আশপাশে অবস্থিত।

সমীক্ষা প্রতিবেদনে প্রশিক্ষণ নেওয়া নারীরা ঋণসুবিধা, নিয়মিত তদারকি, জাতীয় মহিলা সংস্থার মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত করা, উৎপাদিত পণ্য বিক্রির জন্য দেশে-বিদেশে সরাসরি সহায়তা পাওয়া দরকার বলে মত দিয়েছেন।

খোদেজা বেগমের সঙ্গে গত ২৬ আগস্ট মুঠোফোনে কথা হয়। তিনি বলেন, ফুড কর্নারটি আবারও চালুর চেষ্টা করছেন। তিনি আরও বলেন, গত বছরের মে মাসে ফুড কর্নারটি চালু হয়। কিন্তু পারিবারিক সমস্যার কারণে তিনি একদম সময় দিতে পারেননি। এ বছরের জুন থেকে ফুড কর্নারটি বন্ধ আছে।

প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই ফুড কর্নারের অন্য নারী উদ্যোক্তারা কী করেছেন, জানতে চাইলে খোদেজা বেগম বলেন, ‘তাঁদেরও পারিবারিক সমস্যা ছিল। আর সবার তো একরকম দক্ষতা থাকে না।’

প্রকল্পের সহায়তায় স্থাপিত ‘ওহিজ মেকওভার অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার’ পরিচালনায় মূল দায়িত্বে রয়েছেন উদ্যোক্তা ফারহানা রহমান। তিনি শেওড়াপাড়া কেন্দ্রের বিউটি পারলার-বিষয়ক প্রশিক্ষক। ২০১৭ সালে তাঁর নিজের একটি পারলার ছিল। ২০২১ সালের অক্টোবরে প্রকল্পের সহায়তায় নতুন পারলার করেন।

ফারহানা রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অনেক নারীর কাজে আগ্রহ কম। অনেকে পরিবার থেকে সহায়তা পান না। তবে অনেকেই প্রশিক্ষণ নিয়ে ভালো করছেন।

প্রকল্প থেকে রাজধানীর পূর্বাচলে একটি রেস্তোরাঁ বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। গত ১ আগস্ট সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বাঁশ, বেত ও শণ দিয়ে তৈরি সুন্দর একটি রেস্তোরাঁ। ঢোকার মুখেই প্রকল্পের আওতায় রেস্তোরাঁ তৈরির তথ্য জানিয়ে সাইনবোর্ড ঝুলছে। তবে রেস্তোরাঁর নাম একজন উদ্যোক্তা পিয়ারা বেগম শান্তার নামে ‘শান্তা কিচেন ও ফুড কর্নার’।

শান্তা স্থানীয় যুব মহিলা লীগের রাজনীতিতে যুক্ত। তিনি বলেন, এ রেস্তোরাঁয় তিনি একাই ৬০ শতাংশ বিনিয়োগ করেছেন। তিনিই সময় দেন। অন্যরা সেভাবে সময় দিতে পারেন না। ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে এ রেস্তোরাঁ পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মুঠোফোনে এ তথ্য জানানোর সময় ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলেন শান্তা। তিনি বলেন, গত মাসে নতুন করে রেস্তোরাঁটি চালু করেছেন তিনি।

সাতক্ষীরার শ্যামনগরের রেক্সোনা পারভীন বলেন, প্রকল্পের আওতায় পিৎজা, বার্গার, কেকের মতো নানা খাবার বানানো শিখেছেন তিনি। কিন্তু অর্থের অভাবে সেই অভিজ্ঞতা ব্যবসায়িকভাবে কাজে লাগাতে পারছেন না।

রাজধানীর পূর্বাচলে শান্তা কিচেন ও ফুড কর্নার নামের রেস্তোরাঁ। গত ১ আগস্ট তোলা
ছবি: প্রথম আলো

উদ্যোগ বাড়াতে হবে

জাতীয় মহিলা সংস্থার কার্যালয়ে বসে গত ৩০ জুলাই কথা হয় প্রকল্প পরিচালক প্রভাষ চন্দ্র রায়ের সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর শতভাগ প্রশিক্ষণার্থী উদ্যোক্তা হবেন, এমনটা আশা করা যায় না। তবে সবাই কাজ শিখে উপকৃত হয়েছেন।

প্রকল্প বাস্তবায়নে নানা সমস্যা রয়েছে উল্লেখ করে প্রভাষ চন্দ্র বলেন, প্রশিক্ষণার্থীর তুলনায় ব্যবসা পরিচালনার জন্য সহায়তা দেওয়ার পরিমাণ বেশ কম। আবার এমন অনেক জায়গায় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে দেওয়া হয়েছে, যেখানে বেচাকেনা কম হয়। কেননা বেচাকেনা বেশি হয়, এমন জায়গায় দোকান পাওয়া যায় না।

ফ্যাশনপণ্যের ব্যবসায় এ সমস্যা বেশি হয় উল্লেখ করে এই কর্মকর্তা বলেন, এসব সমস্যার সমাধানে উদ্যোক্তাদের পণ্য বিক্রির জন্য হাব তৈরি, প্রশিক্ষণকেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ানোর বিষয়গুলো ভাবা হচ্ছে।

সুপারিশে যা আছে

আইএমইডির সমীক্ষা প্রতিবেদনে প্রকল্প কার্যক্রমকে গতিশীল ও টেকসই করতে বর্তমান চাকরিবাজার বা কর্মসংস্থানের চাহিদা অনুসারে প্রশিক্ষণ ট্রেড নির্ধারণ করা, প্রশিক্ষিত নারীদের ঋণের ব্যবস্থা করা, প্রশিক্ষণার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে উপজেলা ও ইউনিয়নভিত্তিক কোটা নির্ধারণ, প্রশিক্ষণার্থীদের বাড়ি থেকে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের দূরত্ব বিবেচনা করে ভাতা নির্ধারণ, শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র রাখাসহ বেশি কিছু সুপারিশ করা হয়েছে।

প্রকল্পে কী ধরনের সুবিধা থাকলে প্রশিক্ষিত নারীরা তাঁদের প্রশিক্ষণ বাস্তবজীবনে কাজে লাগাতে পারবেন, সে বিষয়ে নারীদের মতামত উঠে এসেছে সমীক্ষা প্রতিবেদনে। নারীরা ঋণসুবিধা, নিয়মিত তদারকি, জাতীয় মহিলা সংস্থার মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত করা, উৎপাদিত পণ্য বিক্রির জন্য দেশে-বিদেশে সরাসরি সহায়তা পাওয়া দরকার বলেও মত দিয়েছেন।