ভর্তুকি সমন্বয়ের নামে ভোক্তার ওপর সরাসরি বিদ্যুতের বাড়তি দাম চাপানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে বেসরকারি নীতি-গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। তারা বলছে, মূল্যবৃদ্ধি নয়, বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ (কেন্দ্রভাড়া) সমন্বয় প্রথম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। সরকার সমন্বয় বললেও এটি বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, যা সরাসরি ভোক্তার ঘাড়ে পড়েছে।
‘সাম্প্রতিক সময়ে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি: ভর্তুকি সমন্বয়ের অন্য বিকল্প আছে কি?’ শিরোনামে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আজ বুধবার এসব কথা বলেছে সিপিডি। সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির বক্তব্য উপস্থাপন করেন সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, দ্রব্যমূল্য নিয়ে নাভিশ্বাস চলছে; এর মধ্যে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভোক্তার ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করা হয়েছে। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি গ্রহণযোগ্য নয়, এর বিকল্প করণীয় ছিল।
সিপিডি বলেছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ শর্ত মেনে জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য সমন্বয় চালু করা হয়েছে। তাদের আরেকটি শর্ত হলো, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ভর্তুকি সমন্বয় করা। এটি আগামী তিন বছরে ধাপে ধাপে কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গত বছর তিন দফা ৫ শতাংশ করে দাম বাড়ানো হয়েছে। গত মাসে এক দফায় বাড়ানো হয়েছে সাড়ে ৮ শতাংশ। কিন্তু এভাবে পুরোটা ভোক্তার ওপর না চাপিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ কমাতে পারে সরকার।
সিপিডির চার প্রস্তাব:
১. পরিকল্পনা অনুসারে বিদ্যুৎকেন্দ্র অবসায়নে পাঠানো।
২. ‘বিদ্যুৎ নেই, বিল নেই’ এমন শর্তে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তি করা।
৩. অল্প পরিমাণে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করা।
৪. নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করা।
এতে বলা হয়, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) দাম বাড়ানোর সময় গণশুনানিতে ভোক্তার অংশ নেওয়ার সুযোগ ছিল। এতে সরকারি সংস্থার আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত হতো। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে আইন সংশোধন করে দাম সমন্বয়ের ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়েছে সরকার। এতে নির্বাহী আদেশে মূল্যবৃদ্ধি করায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত হচ্ছে না। এটি আবার বিইআরসির হাতে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত।
খরচ বাড়ছে যে কারণে
সিপিডি বলেছে, ধারাবাহিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়ানো হলেও আনুপাতিক হারে গ্রাহক ও চাহিদা বাড়ছে না। এতে প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত সক্ষমতার পরিমাণ বাড়ছে। ২০১৭-১৮ থেকে প্রতিবছর নতুন গ্রাহক বৃদ্ধির হার কমছে, অথচ বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়ছে। দেশে এখন পর্যন্ত দিনে ১৬ হাজার মেগাওয়াট চাহিদা পাওয়া যায়নি। অথচ উৎপাদন সক্ষমতা ২৬ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে। এতে বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে কেন্দ্রভাড়া দিতে হচ্ছে। প্রতিবছর লোকসান বাড়ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি)। ২০১৮ থেকেও সরকার সচেতন হলে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ সক্ষমতা নির্মাণ কমাতে পারত। ২০১৯-২০ অর্থবছরে অতিরিক্ত উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ৩৫ শতাংশ, গত বছর এটি বেড়ে হয়েছে সাড়ে ৩৭ শতাংশ। গত বছর ৩৯ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা ভর্তুকি বরাদ্দের পরও ১১ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা লোকসান করেছে পিডিবি। এবার মূল্যবৃদ্ধির ফলে বছরে তিন হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি কমবে বলে দাবি করেছে সরকার।
গত কয়েক বছরে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়ার সঙ্গে ভর্তুকির একটি সামঞ্জস্য খুঁজে পেয়েছে সিপিডি। তারা বলেছে, বিদ্যুৎকেন্দ্র ভাড়া সরকারের মাথাব্যথার বড় কারণ হয়েছে। এতে ভোক্তার কোনো দায় নেই। এটা নীতিগত, প্রক্রিয়াগত দুর্বলতা ও বেশি মাত্রায় উৎপাদনের দিকে ঝুঁকে পড়ার দুর্বলতা। শুধু কেন্দ্রভাড়া নয়, উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কেনাও খরচ বাড়ার কারণ। কী ধরনের জ্বালানিচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে কেনা হচ্ছে, সেটিও একটি বড় বিষয়। গ্যাস থেকে এলএনজি বিদ্যুতের দিকে গিয়ে খরচ বেড়েছে, তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানোয় খরচ বেড়েছে। আর সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, এ খাতে প্রতিযোগিতার অভাব। ইচ্ছেমতো সমঝোতা করে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। দরপত্রের মাধ্যমে চুক্তি হলে কম দামে বিদ্যুৎ পেত সরকার।
মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব
গত বছরের নভেম্বরে এক হাজার বাড়িতে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব নিয়ে একটি জরিপ করেছে সিপিডি। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারে জরিপটি চালানো হয়েছিল। এর ভিত্তিতে এবারের মূল্যবৃদ্ধির একটি প্রভাব মূল্যায়ন করেছে তারা। এতে বলা হয়, আবাসিক খাতে গড়ে খরচ বাড়বে সাড়ে ৯ দশমিক ৪ শতাংশ। এতে তাদের বিদ্যুৎ বিল বাড়বে গড়ে ১০৬ থেকে ১১৮ টাকা। তবে কৃষির সেচে খরচ বাড়বে ১১ শতাংশের বেশি। এতে কৃষিপণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে। এ ছাড়া বিদ্যুৎচালিত কারখানার উৎপাদিত পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। সেখানেও ভোক্তার খরচ বাড়বে।
মূল্যবৃদ্ধির বিকল্প
সিপিডি বলেছে, সরকার যদিও ভর্তুকি সমন্বয়ের কোনো নির্দিষ্ট রূপরেখা দেয়নি। তবে দাম না বাড়িয়ে বিকল্প উপায়ে ভর্তুকি সমন্বয়ের সুযোগ আছে। এর জন্য চারটি কাজ করতে হবে সরকারকে। সরকারি পরিকল্পনা অনুসারে যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র অবসায়নে যাওয়ার কথা, সেগুলোকে যথাসময়ে অবসায়নে পাঠানো। ‘বিদ্যুৎ নেই, বিল নেই’ এমন শর্তে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ চুক্তি করা। এতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের কোনো ভাড়া থাকবে না। অল্প পরিমাণে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, যাতে ভোক্তার ওপর বড় প্রভাব না পড়ে। আর যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র অবসায়নে যাবে, সেগুলোর সমান সক্ষমতায় নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করা।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিকল্প প্রস্তাব চারটি বাস্তবায়িত করা হলে ২০২৮-২৯ অর্থবছরে ভর্তুকি তো দূরে থাকুক, উল্টো মুনাফা করতে পারবে পিডিবি। নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়িয়ে প্রতিবছর বড় অঙ্কের টাকা সাশ্রয়ের সুযোগ আছে।
এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন গবেষণা সহযোগী হেলেন মাশিয়াত, মাশফিক আহসান ও ফয়সাল কাইয়ূম।