চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন
প্রকল্প পরিচালককে মারধরের ঘটনায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আড়াই হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালককে ঠিকাদারদের মারধরের ঘটনায় সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মারধরের ঘটনায় সিটি করপোরেশন তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠনের পর এই প্রশ্ন সামনে এসেছে।
ঘটনার সঙ্গে সংস্থার কেউ জড়িত আছেন কি না, তা খুঁজে বের করতে তদন্ত কমিটিকে নির্দেশ দিয়েছেন সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম।
গত রোববার রাতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির প্রধান সিটি করপোরেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা সৈয়দ শামসুল তাবরীজ। কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা জোনায়েদ কবীর ও ভারপ্রাপ্ত আইন কর্মকর্তা মনীষা মহাজন।
কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
কাজ না পেয়ে প্রকল্প পরিচালক গোলাম ইয়াজদানীকে রোববার বিকেলে নগরের টাইগারপাসে সিটি করপোরেশনের প্রধান কার্যালয়ে তাঁর কক্ষে ঢুকে মারধর করেন একদল ঠিকাদার।
মারধরের ঘটনায় সেদিন রাতে নগরের খুলশী থানায় মামলা হয়। সিটি করপোরেশনের নিরাপত্তা কর্মকর্তা মো. কামাল উদ্দিন বাদী হয়ে মামলাটি করেন। মামলায় আসামি হিসেবে ১০ জন ঠিকাদারের নাম উল্লেখ করা হয়। ৫ থেকে ১০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়।
মামলার এজাহারভুক্ত আসামিরা হলেন—এসজে ট্রেডার্সের সাহাবুদ্দিন, শাহ আমানত ট্রেডার্সের সঞ্জয় ভৌমিক ওরফে কঙ্কন, মাসুদ এন্টারপ্রাইজের মো. ফেরদৌস, শাহ আমানত ট্রেডার্সের সুভাষ, মেসার্স খান করপোরেশনের হাবিব উল্ল্যাহ খান, মেসার্স নাজিম অ্যান্ড ব্রাদার্সের মো. নাজিম, মেসার্স রাকিব এন্টারপ্রাইজের মো. ফিরোজ, মো. ফরহাদ, ইফতেখার অ্যান্ড ব্রাদার্সের মো. ইউসুফ ও জ্যোতি এন্টারপ্রাইজের আশীষ। তাঁদের মধ্যে কঙ্কন, ফেরদৌস, সুভাষ ও জনৈক মাহমুদুল্লাহকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গতকাল সোমবার তাঁদের কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত।
সিটি করপোরেশনের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এই প্রকল্পটি হলো ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আওতায় বিমানবন্দর সড়কসহ বিভিন্ন সড়ক উন্নয়ন ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন’।
প্রকল্পের তৃতীয় পরিচালক গোলাম ইয়াজদানী। তিনি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্বে ছিলেন। তাঁকে গত বছরের ১৪ আগস্ট প্রেষণে প্রকল্পটি পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
গোলাম ইয়াজদানীর আগে সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম ও নির্বাহী প্রকৌশলী আবু সাদাত মোহাম্মদ তৈয়ব এই প্রকল্পের পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন।
গোলাম ইয়াজদানী আসার পর ২২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩৭টি ভাগের (লট) উন্নয়নকাজে ঠিকাদার নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেন। বর্তমানে এই ঠিকাদার নিয়োগপ্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এই কাজ না পাওয়া ঠিকাদারেরা গত রোববার দল বেঁধে গোলাম ইয়াজদানীর কক্ষে প্রবেশ করে তাঁকে মারধর করেন।
সিটি করপোরেশনের এক নির্বাহী প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণত ই-জিপি প্রক্রিয়ায় ঠিকাদারদের উন্নয়নকাজের প্রাক্কলিত ব্যয় জানার কথা না। কিন্তু সিটি করপোরেশনে তা আগেই ফাঁস হয়ে যায়। দর জেনে যাওয়ায় ঠিকাদারেরা প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে ১০ শতাংশ কম দরে দরপত্র জমা দেন। এতে সবার দর একই হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে পিপিআর (গণখাতে ক্রয়বিধি) অনুযায়ী, ম্যাট্রিক্স পদ্ধতিতে মূল্যায়ন করার নিয়ম। আগে সিটি করপোরেশনে এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হতো না। কিন্তু এবার গোলাম ইয়াজদানী এই পদ্ধতিতে মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নেন। এতে একই প্রতিষ্ঠান একাধিক কাজ পেয়েছে। ফলে বঞ্চিত ঠিকাদারেরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন।
ম্যাট্রিক্স পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বান করা প্রতিষ্ঠানের মোট কাজ, সবশেষ পাঁচ বছরে প্রতিষ্ঠান কত টাকার কাজ করেছে, সরকারি সব দপ্তরে এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানের কত টাকার কাজ চলমান আছে ইত্যাদি বিবেচনায় নেওয়া হয়।
সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে তদন্ত কমিটির কার্যপরিধি হিসেবে পাঁচটি বিষয় রয়েছে।
প্রথমটি হলো, ঠিকাদার কর্তৃক সংগঠিত ঘটনায় সিটি করপোরেশনের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত আছেন কি না, তা খতিয়ে দেখা। অপর চারটি বিষয় হলো—সংগঠিত ঘটনায় কোন কোন ঠিকাদার জড়িত ছিলেন ও ঘটনার কারণ উদ্ঘাটন। এতে সিটি করপোরেশনের কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, তা খুঁজে বের করা। ভবিষ্যতে যাতে এই ধরনের ঘটনা না ঘটে, তার জন্য কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে। আর সিটি করপোরেশনের নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য প্রয়োজনীয় সুপারিশ দেবে কমিটি।
তদন্ত কমিটির কার্যপরিধির প্রথম বিষয়টি নিয়ে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে।
এগিয়ে আসেননি কেউ
গোলাম ইয়াজদানীকে মারধরের পর সংস্থাটির নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সিটি করপোরেশনের প্রধান কার্যালয়ের চতুর্থ তলায় তাঁর দপ্তর। রোববার বিকেলে ঠিকাদারেরা দলবেঁধে তাঁর কক্ষে প্রবেশ করেন। তাঁকে মারধর করে তাঁরা বের হয়ে যান। কিন্তু তাঁকে রক্ষায় সিটি করপোরেশনের তেমন কেউ এগিয়ে আসেননি। হামলাকারী ঠিকাদারদের কেউ আটকানোরও চেষ্টা করেননি। অথচ, সিটি করপোরেশনের নিচতলায় প্রধান ফটকের সামনে নিরাপত্তারক্ষীরা সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করেন। দোতলায় মেয়রের কার্যালয়ের সামনেও সার্বক্ষণিক নিরাপত্তারক্ষী থাকেন।
সিটি করপোরেশনের অন্তত চার কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গোলাম ইয়াজদানী এসে প্রকল্পের কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রে নিয়মের কড়াকড়ি করেন। তিনি গণখাতে ক্রয়বিধিও (পিপিআর) কঠোরভাবে অনুসরণ করতে থাকেন। তাঁর এসব পদক্ষেপের কারণে যেনতেনভাবে কাজ পাওয়ার উপায় প্রায় বন্ধ হতে যাচ্ছিল। এ জন্য কিছু ঠিকাদার তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন।
একাধিক সূত্র প্রথম আলোকে জানায়, সিটি করপোরেশনের কিছু কর্মকর্তাও গোলাম ইয়াজদানীকে নিয়ে অস্বস্তিতে আছেন। কারণ, তিনি নিয়ম মেনে চলায় পছন্দের ব্যক্তিদের কাজ দেওয়ার সুযোগ থেকে এই কর্মকর্তাদের বঞ্চিত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এ ব্যাপারে গোলাম ইয়াজদানীকে নানাভাবে অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু তিনি অনুরোধে সায় দেননি।
গত রোববার হামলার পর নিজ কক্ষে গোলাম ইয়াজদানী সাংবাদিকদের বলেন, কাজ পেতে কিছু ঠিকাদার তাঁর কাছে বিভিন্ন সময়ে তদবির করতে এসেছিলেন। কিন্তু নিয়মের বাইরে কিছু করা সম্ভব নয় বলে তিনি তাঁদের সাফ জানিয়ে দেন। এ নিয়ে তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ ব্যক্তিরাই হামলা করেছেন।
হামলার ঘটনায় সিটি করপোরেশনের অভ্যন্তরের কারও ইন্ধন আছে কি না, জানতে চাইলে গতকাল রাতে মুঠোফোনে গোলাম ইয়াজদানী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই ব্যাপারে আমি এখন কোনো মন্তব্য করব না। পরে কথা বলব।’
সিটি করপোরেশনের সচিব খালেদ মাহমুদ বলেন, তদন্ত কমিটি অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে এই ঘটনায় সিটি করপোরেশনের কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত আছে কি না, তা খতিয়ে দেখবে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে কারও নাম এলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যত বড় কর্মকর্তাই হোক না কেন, এ ক্ষেত্রে মাফ পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
সিটি করপোরেশনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারে অস্ত্রসহ আনসার বাহিনীর সদস্যদের নিয়োজিত করা হবে বলে জানান সচিব খালেদ মাহমুদ। তিনি বলেন, প্রকল্প পরিচালককে মারধরের ঘটনায় জড়িত ঠিকাদারদের না আটকানোর বিষয়ে দায়িত্বরত নিরাপত্তাকর্মীদের কোনো অবহেলা বা গাফিলতি ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে। যদি এই ধরনের অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তাহলে তাঁদের চাকরিচ্যুত বা শাস্তিমূলক বদলি করা হবে।