ঈদের আগে দোকান পুড়ে নিঃস্ব তাঁরা

  • বঙ্গবাজার পোশাকের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসাকেন্দ্র।

  • ব্যবসায়ীরা বলছেন, ক্ষতি প্রাথমিক হিসাবে ১ হাজার কোটি টাকার বেশি।

  • আগুনে পুড়েছে পুলিশ সদর দপ্তরের ব্যারাকও।

  • জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ বন্ধ ছিল প্রায় ৭ ঘণ্টা।

পবিত্র ঈদুল ফিতর সামনে রেখে কেনাবেচার সবচেয়ে ভালো সময় এখন। ঠিক সেই সময়ে ভয়াবহ আগুনে পুড়ে গেল রাজধানীর বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের পোশাকের দোকান, দোকানে বিক্রির জন্য রাখা পোশাক ও নগদ টাকা।

ব্যবসায়ীদের প্রাথমিক হিসাবে, আগুনে পাঁচ হাজারের মতো দোকান পুড়েছে। ক্ষতির পরিমাণ ১ হাজার কোটি টাকার বেশি। এই আগুনে কারও মৃত্যু হয়নি। তবে আগুন নেভাতে যাওয়া ফায়ার সার্ভিসের ৮ জন কর্মীসহ অন্তত ১১ জন আহত হয়েছেন। এঁদের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের দুজন কর্মীর অবস্থা গুরুতর।

আরও পড়ুন

বঙ্গবাজারের পোশাকের দোকানগুলোতে গতকাল মঙ্গলবার ভোর ছয়টার কিছু পরে আগুন লাগে। খবর পেয়েই সেখানে ছুটে যান ব্যবসায়ী ও দোকানের কর্মীরা। তাঁদের কেউ কেউ ঝুঁকি নিয়ে দোকানের মালপত্র সরানোর চেষ্টা করছিলেন, কেউ কেউ কিছু করার নেই জেনে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন, কেউ কেউ স্বজনদের ফোন করে বলছিলেন, ‘আমার সব শেষ, আমি নিঃস্ব’।

প্রত্যক্ষদর্শী ও ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের আদর্শ মার্কেট থেকে। তবে আগুনের কারণ এখনো জানা যায়নি। একটা পর্যায়ে আগুন পূর্ব দিকের পুলিশ সদর দপ্তরের ব্যারাকে লেগে যায়। পুড়ে যায় বঙ্গবাজারের উত্তর পাশের বিপণিবিতান এনেক্সকো টাওয়ারের একাংশ ও মহানগর শপিং কমপ্লেক্স। বঙ্গবাজারের পশ্চিম দিকের রাস্তা পেরিয়ে আগুন লেগে যায় বঙ্গ হোমিও কমপ্লেক্স ও বঙ্গ ইসলামিয়া মার্কেটে। তবে বঙ্গবাজারের দক্ষিণ পাশে রাস্তার ওপাশে থাকা ফায়ার সার্ভিসের সদর দপ্তর রক্ষা পায়।

আরও পড়ুন

সকালে আগুন লাগার খবরটি জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোনের মাধ্যমে ফায়ার সার্ভিসকে জানান এক ব্যক্তি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফায়ার সার্ভিস গিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা শুরু করে। কিন্তু আগুন ছড়িয়ে পড়তে থাকে। একটা সময় তা আশপাশের ভবনেও লেগে যায়। ফায়ার সার্ভিস জানায়, ঢাকা ও আশপাশের তিন জেলার ২২টি স্টেশন থেকে ৪৮টি ইউনিট এবং ৬৫০ জন সদস্য আগুন নেভাতে কাজ করেছেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, র‍্যাব ও আনসার আগুন নেভানো ও শৃঙ্খলার কাজে নানাভাবে সহায়তা করে।

আরও পড়ুন

সাড়ে ছয় ঘণ্টা চেষ্টার পর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। ততক্ষণে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের পুরোটাই পুড়ে গেছে। আশপাশের বিপণিবিতানগুলোর দোকানও পুড়েছে। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে দেখা যায়, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের আশপাশের ভবন ও বিপণিবিতান থেকে আধপোড়া ও রক্ষা পাওয়া মালামাল বের করছেন ব্যবসায়ীরা। রাত নয়টায় পাওয়া খবর অনুযায়ী, এনেক্সকো টাওয়ারে আগুন নেভানোর কাজ করছিলেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।

ফায়ার সার্ভিস বলছে, আগুন নিয়ন্ত্রণে দেরি হওয়ার কারণ তিনটি: ১. উৎসুক জনতার কারণে আগুন নেভানোর কাজে বিঘ্ন। ২. পানির অভাব। ৩. বাতাসের বেগ।

কোন জায়গা দিয়ে আমরা কাজ করব? কোথায়, কীভাবে ফায়ার সার্ভিসের লোক কাজ করবে? আমরা তো আপনাদের জন্যই জীবন দিচ্ছি।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন মহাপরিচালক, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বেলা একটার দিকে করা ব্রিফিংয়ে মানুষের ভিড়ের একটি ভিডিও সাংবাদিকদের দেখান। তিনি বলেন, ‘কোন জায়গা দিয়ে আমরা কাজ করব? কোথায়, কীভাবে ফায়ার সার্ভিসের লোক কাজ করবে? আমরা তো আপনাদের জন্যই জীবন দিচ্ছি।’

অবশ্য ব্যবসায়ীদের কারও কারও অভিযোগ, ফায়ার সার্ভিস নিজেদের সদর দপ্তর ও সরকারি স্থাপনার দিকে যাতে আগুন ছড়িয়ে না পড়ে, সেদিকে মনোযোগী বেশি ছিল। এ অভিযোগ তুলে ব্যবসায়ী ও দোকানকর্মীদের একটি অংশ উত্তেজিত হয়ে ফায়ার সার্ভিসের সদর দপ্তরে হামলা চালায়। অগ্নিনির্বাপণের দায়িত্বে কাজ করা ফায়ার সার্ভিসের কয়েকজন সদস্যকেও মারধর করা হয়। ফায়ার সার্ভিস বলছে, হামলাকারীরা তাদের ১১টি গাড়ি ও অভ্যর্থনাকক্ষ ভাঙচুর করে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা ব্যবসায়ীদের অভিযোগকে অমূলক উল্লেখ করে বলেছেন, হামলার ঘটনা দুঃখজনক। কারণ, ফায়ার সার্ভিস তাঁদের জন্যই কাজ করছিল।

আরও পড়ুন

‘এসে দেখি পুড়ে সব শেষ’

বঙ্গবাজার পোশাকের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসাকেন্দ্র। দেশের বিভিন্ন জেলায় এই বাজার থেকে পোশাক সরবরাহ করা হয়। আবার প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশ থেকে ক্রেতারা এসে বঙ্গবাজার থেকে পোশাক কিনে নেন তাঁদের দেশে বিক্রির জন্য। পুরোনো কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, এই ব্যবসাকেন্দ্র গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে গড়ে উঠেছে।

বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সটি কাঠ ও টিন দিয়ে তৈরি; তিনতলা। এই কমপ্লেক্সেই চারটি বিপণিবিতান রয়েছে—বঙ্গবাজার, গুলিস্তান, মহানগরী ও আদর্শ মার্কেট। বিপণিবিতানগুলোর ভেতরটা ঘিঞ্জি। সরু গলি ও ছোট ছোট দোকানে কেনাবেচা করেন ব্যবসায়ীরা। বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স চার বছর আগে ‘অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে ঘোষণা করেছিল ফায়ার সার্ভিস। জায়গাটির মালিক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন।

বঙ্গবাজার ও পাশের বিপণিবিতানের ব্যবসায়ী মো. তোফাজ্জল, সৈয়দ রাসেল, মো. মনসুর, মো. লালচান, ফয়েজ আহমেদ—সবার গল্প একই। কারও দুটি দোকান ছিল, দুটিই পুড়েছে; কারও পাঁচটি দোকান ছিল, একটির মালপত্র রক্ষা করতে পেরেছেন; কারও একটি দোকান ছিল, সেটির কোনো কিছুই রক্ষা করা যায়নি। তাঁরা বলছেন, আগুনের খবর পেয়ে তাঁরা এসে দেখেন দোকান পুড়ে শেষ।

আরও পড়ুন

দুপুরে পুড়ে যাওয়া পোশাকের স্তূপের মধ্যে নিজের দোকানের মালপত্র খুঁজছিলেন ব্যবসায়ী মো. লালচান। কিছু সময় হাতড়ে মেয়েদের একটি জামা বের করে বললেন, ‘এইডা আমার দোকানের কাপড়’। লালচানের চোখ গড়িয়ে তখন পানি পড়ছিল। তিনি বলেন, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের দ্বিতীয় তলায় তাঁর দোকান ছিল। আগুন লাগার পর মালামাল রাস্তায় ফেলতে পেরেছিলেন। কিন্তু আগুন রাস্তায় রাখা মালামালেও লেগে যায়।

বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে যখন আগুন লাগে, তখন আশপাশের বিপণিবিতানের দোকানমালিকেরা মালামাল বের করে রাস্তায় রাখা শুরু করেন। সেই মালামালের কিছু অংশ যেমন পুড়েছে, তেমনি কিছু চুরিও হয়েছে বলে দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরা।

আরও পড়ুন

আগুন লাগার পর দুপুরে ঘটনাস্থলে যান বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, অগ্নিকাণ্ডে ১ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পবিত্র ঈদুল ফিতর সামনে রেখে দোকানমালিকেরা অনেক টাকার মালামাল তুলেছিলেন।

দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। প্রতিমন্ত্রী এনামুর ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সহায়তার আশ্বাস দেন।

আরও পড়ুন

পানির অভাব

বঙ্গবাজারের আগুন নেভাতে গিয়ে পানির সংকটে পড়েছিল ফায়ার সার্ভিস। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, আগুন নিয়ন্ত্রণের সময় কয়েকবার পানি শেষ হয়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলসংলগ্ন পুকুর থেকে পানি সংগ্রহ করেন তাঁরা। বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে হাতিরঝিল থেকে পানি নেওয়া হয়। পুলিশ সদর দপ্তর ও ঢাকা ওয়াসার পক্ষ থেকে পানি দেওয়া হয়। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন জানিয়েছেন, সেনাবাহিনী পানির বাউজার (বড় পাত্র) দিয়ে সহায়তা করেছে।

দুর্ঘটনাস্থল ঘুরে দেখা যায়, হাজার হাজার মানুষের কারণে ফায়ার সার্ভিস চলাচল করতে পারছিল না। পানি ছিটানোর কাজেও বিঘ্ন ঘটছিল। উৎসুক জনতা ও যানবাহন নিয়ন্ত্রণে ওই সময় বঙ্গবাজারের চারপাশের সব সড়কেই যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন

ব্যারাকে আগুন

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুপুর ১২টার দিকে পুলিশ সদর দপ্তরের আঙিনার ভেতরে থাকা ব্যারাক থেকে ধোঁয়া উড়তে দেখা যায়। বেলা তিনটার দিকে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন সাংবাদিকদের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে জানান। তিনি বলেন, ‘আমাদের একটি ব্যারাকে আগুন লেগেছে। আমাদের সব সদস্য নিরাপদে বের হতে পেরেছেন, তবে কোনো মালামাল বের করতে পারেননি তাঁরা।’

চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন আরও বলেন, নথিপত্র ও কী কী মালপত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা খতিয়ে দেখতে হবে।

আগুন লাগার পর ওই এলাকার বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেওয়া হয়। রাত সাড়ে নয়টায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত এলাকাটি বিদ্যুৎহীন ছিল। দীর্ঘ সময় ধরে বিদ্যুৎ না থাকায় একসময় বিকল্প ব্যবস্থাও (পাওয়ার ব্যাকআপ) অকার্যকর হয়ে যায়। এতে দুপুর ১২টার পরপর জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ বন্ধ হয়ে যায়, যা সন্ধ্যা সাতটার পরে চালু হয়। উল্লেখ্য, জাতীয় জরুরি সেবা নম্বরটি পরিচালিত হয় পুলিশ সদর দপ্তর থেকে।

আরও পড়ুন

‘আমাদের কী হবে’

বঙ্গবাজারে আগুনের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে জানতে তিনটি কমিটি গঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন একটি করে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তাদের পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি দুর্ঘটনার কারণ ও ক্ষয়ক্ষতি তদন্ত করবে। সিটি করপোরেশনের আট সদস্যের কমিটি তিন দিনের মধ্যে আগুন লাগার কারণ ও ক্ষয়ক্ষতি বের করবে। পুলিশের তদন্ত কমিটি দেখবে এই আগুন দুর্ঘটনা না নাশকতা। উল্লেখ্য, ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বঙ্গবাজারের জায়গায় বহুতল ভবন করা হবে বলে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।

বঙ্গবাজার ও আশপাশের বিপণিবিতানগুলোর দোকানে কত মানুষ কাজ করতেন, তা তাৎক্ষণিকভাবে জানাতে পারেননি ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলছেন, সংখ্যাটি ১৫ হাজারের কম হবে না। দোকানকর্মীরা বলছেন, ঈদের আগে ভালো কেনাবেচার পর বেতন ও উৎসব ভাতা পাবেন, দোকান থেকে পরিবারের সদস্যদের পোশাক পাবেন, নিজেরা কেনাকাটা করবেন—এই আশা ছিল তাঁদের। হঠাৎ আগুনে পরিবারসহ জীবিকাই অনিশ্চয়তায় পড়ে গেল।

বঙ্গবাজারের দোকানকর্মী নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের মো. ইমরান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মালিকের জন্য খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু আমরাও তো শেষ।’