তৌহিদ–ওয়াং বৈঠক ২১ জানুয়ারি: গুরুত্ব পাবে কোন কোন বিষয়
জিডিআই সই ও গত আমলে আটকে থাকা প্রকল্পে মনোযোগ চীনের। চীনের আর্থিক সহায়তা ও বাংলাদেশে শিল্প স্থানান্তরে আগ্রহী ঢাকা।
বাংলাদেশে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর চীনের সঙ্গে বেইজিংয়ে মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক হতে যাচ্ছে। ২১ জানুয়ারি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বেইজিংয়ে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনায় বসছেন। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এটাই প্রথম কোনো দেশের সঙ্গে পররাষ্ট৶ উপদেষ্টার আনুষ্ঠানিক দ্বিপক্ষীয় বৈঠক।
ঢাকা ও বেইজিংয়ের কূটনৈতিক সূত্রগুলো প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর আমন্ত্রণে তৌহিদ হোসেন ২০ জানুয়ারি চার দিনের সফরে বেইজিং যাচ্ছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে অংশ নেওয়ার ফাঁকে তিনি চীনের গুরুত্বপূর্ণ দুই শহরে সে দেশের কমিউনিস্ট পার্টির জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন। এর পাশাপাশি তিনি বেইজিং ও সাংহাইয়ে দুটি গবেষণাপ্রতিষ্ঠানে বক্তৃতা দেবেন।
জানা গেছে, ডিসেম্বরের শুরুতে তৌহিদ হোসেনকে বেইজিং সফরের আমন্ত্রণ জানিয়ে ওয়াং ই একটি চিঠি পাঠান। চীন সফরের আমন্ত্রণ গ্রহণ করে তৌহিদ হোসেন ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে ওয়াং ইকে চিঠির জবাব দেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, যেহেতু আনুষ্ঠানিক বৈঠকটি বেইজিংয়ে হবে, আলোচ্যসূচির প্রস্তাব চীনের কাছ থেকে আসবে। চীনের প্রস্তাবের বিষয়ে বাংলাদেশ মতামত দেওয়ার পর তা চূড়ান্ত হবে। তবে ব্যবসা, বিনিয়োগ, অবকাঠামো উন্নয়নসহ সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক সম্পর্ক ভবিষ্যতে কতটা জোরালো করা যায়, তা আসন্ন বৈঠকে বিশেষ গুরুত্ব পাবে। এর পাশাপাশি চীন বিগত সরকারের আমলে যেসব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে এগোতে পারেনি, সেগুলো সামনে আনতে পারে। এর পাশাপাশি চীন তাদের বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগে (জিডিআই) বাংলাদেশকে যুক্ত করার জন্য সমঝোতা স্মারক সইয়ের বিষয়ে জোর দেবে।
সংশ্লিষ্ট আরেক কর্মকর্তা জানান, বেইজিং যে আসন্ন সফরে জিডিআই ও ঝুলে থাকা প্রকল্পে জোর দেবে, তা সফরের প্রস্তুতিমূলক আলোচনায় চীনের কর্মকর্তারা আভাস দিয়েছেন।
চলতি বছর বাংলাদেশ ও চীন কূটনৈতিক সম্পর্কের পাঁচ দশক উদ্যাপন করতে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে এ বছর নানা স্তরে সফর বিনিময়সহ বিভিন্ন উদ্যোগের বিষয়ে তাদের মধ্যে আলোচনার কথা রয়েছে।
জানতে চাইলে তৌহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর আমন্ত্রণে ২০ জানুয়ারি বেইজিং যাচ্ছি। তাঁর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করার পাশাপাশি আরও একাধিক আলোচনা হতে পারে। সফরের আলোচ্যসূচি, অনুষ্ঠানসহ আনুষঙ্গিক নানা বিষয় আগামী কয়েক দিনের মধ্যে চূড়ান্ত হওয়ার কথা রয়েছে।’
ভূরাজনীতিতে বিশেষ কৌতূহল থাকবে চীনের
কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দ্বিপক্ষীয় পরিসরে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার জন্য আলোচনার কথা থাকলেও ভূরাজনীতিতে বিশেষ কৌতূহল থাকবে চীনের। বিশেষ করে বাংলাদেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ কাজে লাগিয়ে এখনকার প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার ওপর চীন জোর দিচ্ছে। গণতান্ত্রিক উত্তরণের এই সন্ধিক্ষণকে চীন ফলপ্রসূভাবে কাজে লাগাতে মনোযোগ দিচ্ছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নিকট প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক চরম টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কীভাবে আরও কাছে আসা যায়, সে বিষয়ে চীনের মনোযোগ আছে। কারণ, এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রকে মোকাবিলা করতে বেশ কয়েক বছর ধরেই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় নানা স্তরে বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছে চীন। অধ্যাপক ইউনূসের সরকার আগস্টে দায়িত্ব নেওয়ার পর এ পর্যন্ত চীনের ১২টি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে ২১০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এ বিনিয়োগের মাধ্যমে চীন এ বার্তাই দিতে চাইছে যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি দেশটির সর্বাত্মক সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মতে, চীন যেহেতু ভূরাজনীতিতে জোর দিচ্ছে, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে এগোনোর ক্ষেত্রে সতর্ক থাকাটা বাঞ্ছনীয়। এটা অনস্বীকার্য যে বর্তমান সরকারের প্রতি পাশ্চাত্য, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের বিপুল সমর্থন ও সহযোগিতা রয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বৈরিতার মধ্যে বাংলাদেশের এমন কিছু করাটা ঠিক হবে না, যা আমাদের স্বার্থের পরিপন্থী। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অব্যাহত টানাপোড়েন আর বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অস্বস্তি অজানা নয়। উচ্চপর্যায়ের এক আলোচনায় বিষয়টি উঠে এসেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারের উচ্চপর্যায়ের এক নীতিনির্ধারক এই প্রতিবেদককে বলেন, পররাষ্ট্র উপদেষ্টার চীন সফরে সরকারের বিশেষ মনোযোগ রয়েছে। এ সফর নিয়ে অনেক বন্ধুদেশের বিশেষ কৌতূহলের বিষয়টিও অজানা নয়। ফলে সরকার হুটহাট এমন কিছু করবে না, যা সামগ্রিকভাবে দেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সমীকরণে কোনো জটিলতা সৃষ্টি করে।