ডায়রিয়ার খরচ চোখে কম পড়ে
প্রতিবছর সারা দেশে ১০ লাখের বেশি মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। আক্রান্ত ব্যক্তিদের একটি বড় অংশ শিশু। ডায়রিয়ার চিকিৎসায় বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ হয়ে যায়। যদিও সেই খরচ চোখে পড়ে কম।
ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে সারা বছরই মানুষ আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) মহাখালী হাসপাতালে ভর্তি হয়। এখন শীতকালেও দৈনিক গড়ে ৮৫০ রোগী এই হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। গতকাল শুক্রবার এই হাসপাতালে গিয়ে নানা বয়সী রোগী দেখা গেছে। তবে রোগীদের মধ্যে বড় অংশ ছিল পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু।
ডায়রিয়ার খরচটা চোখে পড়ে না বা কম পড়ে। তাই সরকার এই খাতে বিনিয়োগের তাগিদ অনুভব করে না। সরকারের উচিত বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া, মানুষের সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ জোরদার করা।খায়রুল ইসলাম, জনস্বাস্থ্যবিদ
আইসিডিডিআরবি ৬০ বছরের বেশি সময় ধরে ডায়রিয়া রোগের চিকিৎসা ও গবেষণা করছে। গত নভেম্বরে প্রকাশিত আইসিডিডিআরবির এক গবেষণায় দেখা গেছে, ডায়রিয়া আক্রান্ত একটি শিশু হাসপাতালে আসার আগে তার পরিবার গড়ে ৮১৯ টাকা খরচ করে ফেলে।
তবে এটি খরচের সামগ্রিক চিত্র নয়। আইসিডিডিআরবি হাসপাতালে মূলত ঢাকা শহরের এবং ঢাকার আশপাশ এলাকার রোগীরা চিকিৎসা নিতে আসে। সারা দেশের রোগী আসে না। সাধারণ মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলে উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র, জেলা বা সদর হাসপাতালে এবং মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়। অবস্থাপন্নরা চিকিৎসা নেন বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালে। কিছু মানুষ চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে চিকিৎসা নেন। অনেকে নিজে ব্যবস্থাপনার ঝুঁকি নেন, অর্থাৎ চিকিৎসকের কাছে যান না। গবেষণায় দেখা যায়, এমন রোগীপ্রতি খরচ আট হাজার টাকার বেশি।
দিনে প্রায় ২ হাজার রোগী ভর্তি
গতকাল শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২ জানুয়ারি সারা দেশের সরকারি হাসপাতালে ২ হাজার ৬৪৭ জন ডায়রিয়া রোগী ভর্তি হয়। অন্যদিকে গত ১ নভেম্বর থেকে ২ জানুয়ারি এই ৬৩ দিনে সারা দেশের সরকারি হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৩৩৫ জন। অর্থাৎ প্রতিদিন সারা দেশে গড়ে ১ হাজার ৮০০ মানুষ ডায়রিয়ার চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। তবে কিছু কিছু জেলায় রোগী বেশি দেখা যাচ্ছে। এই ৬৩ দিনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় সবচেয়ে বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এই জেলায় ভর্তি হওয়া রোগী ছিল ৭ হাজার ৩৯০ জন। এই হিসাবের মধ্যে আইসিডিডিআরবির ঢাকা ও মতলব হাসপাতালে ভর্তি রোগী নেই। গতকাল রাত ৮টা পর্যন্ত আইসিডিডিআরবির ঢাকা হাসপাতালে ৫৪০ জন রোগী ভর্তি ছিল।
জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে স্বাস্থ্য নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। ক্যানসার, হৃদ্রোগ, ডায়াবেটিস—এসব রোগনিয়ন্ত্রণে নতুন নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। বছরজুড়ে থাকা ডায়রিয়া প্রতিরোধে সরকার সাম্প্রতিক সময়ে বড় কোনো প্রকল্প বা উদ্যোগ নিয়েছে কি না, তা শোনা যায়নি।
হাসপাতালে আসার আগে খরচ
২০১২ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে আইসিডিডিআরবির হাসপাতালে ভর্তি হওয়া পাঁচ বছরের কম বয়সী ১৪ হাজার ১৭৮টি শিশুর পরিবারের তথ্য যাচাই করেছেন গবেষকেরা। এতে নেতৃত্ব দিয়েছেন আইসিডিডিআরবির পুষ্টি গবেষণা বিভাগের গবেষক মো. ফুয়াদ আল ফিদা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিটি পরিবার হাসপাতালে আসার আগে দুই ধরনের খরচ করে। প্রথমত তাদের চিকিৎসা বাবদ কিছু খরচ হয়। এর মধ্যে আছে ডাক্তার দেখানো, ওষুধ কেনা বা হাসপাতালে থাকা। এটাকে আমরা বলছি সরাসরি চিকিৎসা খরচ। অন্যটা যাতায়াত, একে আমরা বলছি পরোক্ষ চিকিৎসা খরচ। এই দুটি মিলিয়ে আমরা দেখেছি, আমাদের হাসপাতালে আসার আগেই গড়ে প্রতিটি পরিবার ৮১৯ টাকা খরচ করে ফেলেছে।’
আইসিডিডিআরবি হাসপাতালে বছরজুড়ে ডায়রিয়া রোগীর চিকিৎসা হয়। বছরে প্রায় ২ লাখ ৯০ হাজার ডায়রিয়া রোগী এই হাসপাতালে বিনা মূল্যে চিকিৎসা নেয়। আইসিডিডিআরবি কর্তৃপক্ষ প্রথম আলোকে জানিয়েছে, প্রত্যেক রোগীর পেছনে তাদের খরচ হয় গড়ে ২ হাজার ৬০০ টাকা। রোগীটি হাসপাতালে এক দিন বেশি থাকলে আরও প্রায় ২ হাজার টাকা খরচ হয়।
বছরে খরচ প্রায় হাজার কোটি টাকা
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, ২০১৮ সালে সারা দেশের হাসপাতালগুলোতে মোট ১১ লাখ ২২ হাজার ৬৮১ জন রোগী চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। ওই সময়ের উপাত্ত নিয়ে ২০২১ সালে সংক্রামক রোগবিষয়ক সাময়িকী ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ইনফেকশাস ডিজিজেস–এ প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়, একজন ডায়রিয়া রোগীর পেছনে গড়ে ৭১ ডলার বা ৮ হাজার ৫২০ টাকা খরচ হয়। আর বাংলাদেশ ডায়রিয়ার পেছনে বছরে ৭৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৯৪৮ কোটি টাকা খরচ করে।
গবেষকেরা দেখেছেন, ডায়রিয়া আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবার তিনটি পর্যায়ে খরচ করে। সরাসরি চিকিৎসা ব্যয় (চিকিৎসকের ফি, হাসপাতালে শয্যা ভাড়া, ওষুধের দাম ও রোগ পরীক্ষা), সরাসরি অ–চিকিৎসা ব্যয় (খাদ্য, যাতায়াত, সেবাদানকারীর আবাসিক ব্যয় ও অন্যান্য খরচ), পরিবারের পরোক্ষ ব্যয় (সেবাদানকারীর দৈনিক কাজের ক্ষতি)। এ ছাড়া সেবাদানকারী হাসপাতালকে কর্মচারীর বেতন, ওষুধ ও অন্যান্য বিষয়ে খরচ করতে হয়।
খাওয়ার স্যালাইনের ব্যবহার বৃদ্ধি, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ডায়রিয়া রোগের ব্যবস্থাপনার উন্নতি হওয়ার কারণে দেশে এ রোগের মৃত্যু কম হচ্ছে। তবে আক্রান্তের সংখ্যা এখনো উদ্বেগজনক। ডায়রিয়ার রোগী সরকারি হাসপাতালে শয্যার ওপর চাপ ফেলে।
এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্যবিদ ও ওয়াটারএইড দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের আঞ্চলিক প্রধান খায়রুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডায়রিয়ার খরচটা চোখে পড়ে না বা কম পড়ে। তাই সরকার এই খাতে বিনিয়োগের তাগিদ অনুভব করে না। সরকারের উচিত বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া, মানুষের সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ জোরদার করা। তা না হলে ডায়রিয়া কমবে না, মানুষ খরচ করতেই থাকবে।’