বিপিসির অঙ্গপ্রতিষ্ঠান
পরিবেশক জানেন না, তাঁদের নামে খালাস হয় এলপি গ্যাস
এসএওসিএল থেকে ডি ভি গ্যাসের নামে সর্বশেষ চালানটি খালাস হয়েছে ১৯ সেপ্টেম্বর।
এসএওসিএলে এলপি গ্যাস সরবরাহ নিয়ে আগেও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল।
স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের (এসএওসিএল) কাছ থেকে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম (এলপি) গ্যাস কিনে ব্যবসা করে মেসার্স ডি ভি গ্যাস সাপ্লাই ও মেসার্স সাগরিকা এজেন্সি নামের দুটি প্রতিষ্ঠান। এই দুই প্রতিষ্ঠানেরই বিস্ফোরক অধিদপ্তর থেকে নেওয়া লাইসেন্সের মেয়াদ নেই। কিন্তু তাদের অজান্তেই প্রতিষ্ঠানের নামে গ্যাস সিলিন্ডার খালাস হচ্ছে।
জানা গেছে, ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর বিস্ফোরক পরিদপ্তর থেকে নেওয়া মেসার্স ডি ভি গ্যাসের লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়। আর মেসার্স সাগরিকা এজেন্সির লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়েছে গত বছরের মার্চে। নিয়ম অনুযায়ী, লাইসেন্সের মেয়াদ না থাকলে কোনো প্রতিষ্ঠানের নামে এলপি গ্যাস বিক্রি করা যায় না।
কত দিন ধরে কার কাছে সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে, তা তদন্ত করে বের করতে হবে। পাশাপাশি এ ঘটনায় জড়িত কোম্পানির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।ইসলাম মিয়া, শিক্ষক, পেট্রোলিয়াম ও মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রযুক্তি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
ডি ভি গ্যাস সাপ্লাইয়ের কার্যালয় চট্টগ্রাম নগরের কদমতলী এলাকায়। আর মেসার্স সাগরিকা এজেন্সির কার্যালয় নগরের উত্তর হালিশহরের ফইল্যাতলী বাজার এলাকায়।
স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেড বা এসএওসিএল হলো বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। ১৯৬৫ সালে এটি চালু হয়। শুরুতে যানবাহনের ইঞ্জিন অয়েল উৎপাদিত হতো এ প্রতিষ্ঠানে। পরবর্তী সময়ে বিটুমিন, এলপিজি, ফার্নেস তেল, ডিজেল বিপণনের দায়িত্বও দেওয়া হয়। পাশাপাশি কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আগত বিমানের ফুয়েল সরবরাহ করছে এই কোম্পানি।
সূত্র জানায়, এসএওসিএল থেকে ডি ভি গ্যাসের নামে সর্বশেষ চালানটি খালাস হয়েছে গত ১৯ সেপ্টেম্বর। এদিন ২৫টি এলপি সিলিন্ডার বের হয়। তবে ডি ভি গ্যাসের নামে সিলিন্ডার বের হলেও প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী পঙ্কজ মালাকার বিষয়টি জানেন না। তিনি সিলিন্ডার নেওয়ার জন্য আবেদনও করেননি। সম্প্রতি বিষয়টি জানার পর তিনি ২ ডিসেম্বর এসএওসিএলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফেরদৌসী মাসুম হিমেল বরাবর একটি আবেদন করেছেন। এতে তিনি গত দুই বছরে তাঁর প্রতিষ্ঠানের নামে কয়টি সিলিন্ডার দেওয়া হয়েছে, সে হিসাব চেয়েছেন।
বিষয়টি তদন্তের অনুরোধ জানিয়ে স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেডকে চিঠি দিয়েছে দুই পরিবেশক।
পঙ্কজ মালাকার প্রথম আলোকে বলেন, লাইসেন্সের মেয়াদ না থাকায় তিনি এত দিন সিলিন্ডার কেনার জন্য আবেদন করেননি। তবে সম্প্রতি তিনি জানতে পেরেছেন, তাঁর প্রতিষ্ঠানের নামে চলছে সিলিন্ডার বেচাকেনা। এ কারণে তিনি সর্বশেষ দুই বছরে কয়টি সিলিন্ডার বিক্রি হয়েছে, সে হিসাব চেয়েছেন।
কোম্পানির হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে প্রতিদিন পাঁচ গাড়ি এলপি গ্যাসের সিলিন্ডার বিক্রি করছে এসএওসিএল। প্রতি গাড়িতে সাড়ে ১২ কেজি ওজনের ২৩৮টি করে সিলিন্ডার থাকে। সে হিসাবে দিনে বিক্রি হয় ১৪ হাজার ৮৭৫ কেজি এলপি গ্যাস। প্রায় ৪০০ পরিবেশক সিলিন্ডার কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত। তাঁরা কোম্পানি থেকে সিলিন্ডার কিনে পাইকারি ও খুচরা বাজারে বিক্রি করেন। কোম্পানি থেকে কিনতে প্রতিটি সিলিন্ডারের জন্য দিতে হয় ৬৫৫ টাকা।
এসএওসিএলে এলপি গ্যাস সরবরাহ নিয়ে আগেও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল। ২০১৮ সালে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে অনিয়মের তথ্য উঠে আসে। ওই বছরের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১২০টি গ্রহণ চালানের মধ্যে কোনোটিতে সিলিন্ডারের সংখ্যা উল্লেখ নেই। কোনোটিতে চালান নম্বর নেই। আবার কোনোটিতে জাল স্বাক্ষর। এ ছাড়া পরিবেশকের নামে ইস্যু হওয়া চালানে গ্রহণকারীর স্বাক্ষরের ভিন্নতা পাওয়া গেছে ওই সময়। আবার কিছু চালানে কোনো পরিবেশক এবং গ্রহণকারীর স্বাক্ষরও ছিল না।
সাগরিকাও জানে না কে নিচ্ছে সিলিন্ডার
মেসার্স সাগরিকা এজেন্সির কর্ণধার মো. শাহাদাত হোসেন প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, সর্বশেষ গত নভেম্বর মাসে তাঁর প্রতিষ্ঠানের নামে ৫০টি সিলিন্ডার খালাস হয়েছে। তবে কে সিলিন্ডার উত্তোলন করেছেন, তা তিনি জানেন না। এ নিয়ে ৪ ডিসেম্বর কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে চিঠি দিয়ে তদন্ত করার আবেদন জানিয়েছেন এই ব্যবসায়ী।
আবেদনপত্রে শাহাদাত বলেছেন, ২০২৩ সালের মার্চে বিস্ফোরক পরিদপ্তর তাঁর প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা লাইসেন্সের অনুমোদন বাতিল করেছে। কিন্তু অন্য পরিবেশকের মাধ্যমে তিনি জানতে পেরেছেন, তাঁর নামে নিয়মিত এলপি গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। তিনি এ ঘটনায় তদন্ত চান।
পরিবেশকের লাইসেন্সের মেয়াদ না থাকার পরও সিলিন্ডার বিক্রির বিষয়ে কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফেরদৌসী মাসুম প্রথম আলোকে বলেন, এখনো চিঠি তাঁর হাতে এসে পৌঁছায়নি। তবে এ বিষয়ে খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেবেন।
তবে মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্সধারী দুই প্রতিষ্ঠানকে না জানিয়ে সিলিন্ডার বিক্রির ঘটনা তদন্ত করতে হবে বলে মনে করেন চট্টগ্রাম প্রযুক্তি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পেট্রোলিয়াম ও মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক ইসলাম মিয়া। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কত দিন ধরে কার কাছে সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে, তা তদন্ত করে বের করতে হবে। পাশাপাশি এ ঘটনায় জড়িত কোম্পানির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।