কেরানীগঞ্জও রাসায়নিকের ঝুঁকিতে

শিল্পপার্ক তৈরি হয়নি। অস্থায়ী গুদাম উদ্বোধনের পর খালি। পুরান ঢাকার মতো রাসায়নিকের গুদাম গড়ে উঠছে কেরানীগঞ্জে।

বাড়ির পাশের রাসায়নিক গুদামে বিস্ফোরণে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে ঘরের সবকিছু। পুড়ে যাওয়া ধ্বংসস্তূপ থেকে বেঁচে যাওয়া মালামাল সরিয়ে নিচ্ছেন নিহতদের স্বজনেরা। গতকাল সকালে ঢাকার কেরানীগঞ্জের কালিন্দীর গদারবাগ আবাসিক এলাকায়
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

পুরান ঢাকার পর এখন রাসায়নিকের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে কেরানীগঞ্জে। সেখানে দাহ্য রাসায়নিকের কয়েক শ ছোট-বড় গুদাম করা হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি।

সে রকম একটি গুদামেই সোমবার দিবাগত রাতের আগুনে পাঁচজন নিহত হয়েছেন, যাঁদের মধ্যে দুটি শিশু। নিহত ব্যক্তিরা পরস্পরের স্বজন।

অথচ ২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলীতে ভয়াবহ আগুনের পর রাসায়নিকের গুদাম সরিয়ে রাসায়নিক শিল্পপার্কে নেওয়ার কথা বলা হয়। নিমতলীর আগুনে মারা গিয়েছিলেন ১২৩ জন। এরপর ২০১৯ সালে পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় আগুনে ৭১ জন মারা যান। তখন দ্রুত রাসায়নিকের ব্যবসা সরিয়ে নিতে অস্থায়ী গুদাম করার প্রকল্প নেওয়া হয়।

এখন অস্থায়ী গুদাম খালি পড়ে আছে। আর রাসায়নিক শিল্পপার্ক এত বছরেও তৈরি হয়নি। বিপরীতে রাসায়নিকের গুদাম ছড়িয়ে পড়ছে কেরানীগঞ্জ এলাকায়।

কেরানীগঞ্জের কালিন্দী গদারবাগের বাসিন্দা রিয়াজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এখন ভয়ের মধ্যে আছি। চারদিকে অনেক গোডাউন (গুদাম)। কোথায় কখন আগুন লাগবে, কেউ বলতে পারে না।’ তিনি বলেন, গুদাম করা ঠেকাতে প্রতিবাদ জানানোর কোনো সুযোগ নেই। কারণ, প্রভাবশালীদের সঙ্গে মিলে ব্যবসায়ীরা গুদাম করছেন।

সকালে আবার আগুন

কেরানীগঞ্জে গত সোমবার দিবাগত রাতে আগুন লেগেছিল গদারবাগ এলাকায় আবুল হাসনাতের স্বাদ গ্লাস অ্যান্ড পলিমার কারখানার রাসায়নিক গুদামে।

সরেজমিনে গতকাল বুধবার সকালে দেখা যায়, গুদামটির একটি কক্ষে বস্তাভরা রাসায়নিক স্তূপ করে রাখা। আশপাশের এলাকার বাতাস ধোঁয়া আর রাসায়নিকের গন্ধে ভারী হয়ে আছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গতকাল সকালে গুদামটিতে আবার আগুন ধরেছিল। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা গিয়ে তা নেভান।

স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে মো. রায়হান, মুক্তা বেগমসহ কয়েকজন অবশিষ্ট রাসায়নিক দ্রুত সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করার আবেদন জানান।

সোমবারের আগুনে মারা গেছেন গুদামটির কর্মচারী সোহাগ মিয়া (৩০), সোহাগের স্ত্রী মিনা আক্তার (২০) ও দেড় বছর বয়সী মেয়ে তাইয়েবা আক্তার এবং সোহাগের বড় ভাই সৌদিপ্রবাসী মিলন মিয়ার স্ত্রী জেসমিন আক্তার (৩২) ও তাঁর মেয়ে ইশা আক্তার (১৪)।

আগুন লাগার পর স্থানীয় বাসিন্দারা গুদামের এক পাশের ইটের দেয়াল ভেঙে সোহাগের বাবা বৃদ্ধ হানিফ মিয়া ও মা পারুল বেগমকে বের করে আনেন। তাঁদের গুদামের পাশেই একটি বাড়িতে রাখা হয়েছে। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, আত্মীয়স্বজনেরা তাঁদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন। শোকে কাতর ও অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

স্থানীয় বাসিন্দারা ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের গুদাম এখান কেরানীগঞ্জে চলে এসেছে। অগ্নিকাণ্ডে মানুষের প্রাণ যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

কয়েক শ গুদাম

কেরানীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আগানগর ইউনিয়নের পূর্ব আগানগর, আগানগর ছোট মসজিদ, নাগরমহল, শুভাঢ্যা ইউনিয়নের চুনকুটিয়া, কালীগঞ্জ, খেজুরবাগ, চরকালীগঞ্জ এবং কালিন্দী ইউনিয়নের আতাশুর ও গদারবাগ, বাগবাড়ি, বালুরমাঠ, কোনাখোলাসহ বিভিন্ন এলাকায় কয়েক শ ছোট-বড় রাসায়নিকের গুদাম ও ঝুঁকিপূর্ণ কারখানা গড়ে উঠেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন বাসিন্দা প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকায় এসব রাসায়নিকের গুদাম গড়ে তোলা এবং এখান থেকে মালামাল আনা-নেওয়ার কাজ চলছে। রাসায়নিক ব্যবসায়ীরা জমি কিনে প্রথমে চারপাশে উঁচু করে ইটের প্রাচীর দেন। পরে ভেতরে রাসায়নিকের গুদাম তৈরি করেন। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালীদের যোগসাজশ রয়েছে। তাঁরা এলাকার মাস্তানদের টাকা দিয়ে হাত করে রাখেন। ফলে কেউ কিছু বলার সাহস পান না।

কেরানীগঞ্জের এসব গুদাম ও কারখানায় প্রায়ই ছোট–বড় অগ্নিকাণ্ড বা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ২০১৯ সাল থেকে গত সোমবার পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য পাঁচটি দুর্ঘটনায় ১৯ জন নিহত হয়েছেন। যেমন ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর প্রাইম পেট অ্যান্ড প্লাস্টিক লিমিটেড কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ১৩ জন নিহত হন।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের কেরানীগঞ্জ স্টেশনের ওয়্যারহাউস পরিদর্শক মোহাম্মদ হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, গদাবাড়ির যে গুদামে সোমবার রাতে আগুন লেগেছে, সেটিতে জুতা ও কলমের কালি তৈরিতে ব্যবহৃত হয় এমন রাসায়নিক পেয়েছেন তাঁরা। তবে গুদামের অনুমোদন ছিল না। গুদামটির মালিক আবুল হাসনাত অবৈধভাবে সেখানে রাসায়নিক মজুত করেছিলেন।

আবুল হাসনাতের সঙ্গে কথা বলতে তাঁর মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। পরে গতকাল দুপুরে পুরান ঢাকায় তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ে গেলে কর্মচারী মো. আলমগীর বলেন, আবুল হাসনাত কয়েক দিন অফিসে আসেন না। কোথায় আছেন তিনি জানেন না।

নতুন গুদাম খালি, পার্ক তৈরি হয়নি

২০১০ সালে নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর যে রাসায়নিক শিল্পপার্ক করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, সেটির প্রকল্প তৈরি করতে করতেই লেগে যায় ২০১৮ সাল পর্যন্ত। ২০১৯ সালে আবার চুড়িহাট্টায় আগুনের ঘটনা ঘটে। তখন আগের প্রকল্প বাতিল করে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে ৩১০ একর জায়গায় রাসায়নিক শিল্পপার্ক তৈরির প্রকল্প নেওয়া হয়।

২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। ব্যয় ধরা হয় প্রায় ১ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা। প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২২ সালের জুনে। তবে শেষ হয়নি। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে।

রাসায়নিক শিল্পপার্ক প্রকল্পের পরিচালক হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হবে বলে তিনি আশাবাদী।

রাসায়নিক শিল্পপার্ক নির্মাণে কয়েক বছর লাগার কারণ দেখিয়ে ২০১৯ সালেই বাংলাদেশ রাসায়নিক শিল্প সংস্থার (বিসিআইসি) মালিকানাধীন শ্যামপুরের উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরির জমি এবং টঙ্গীতে বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনের (বিএসইসি) জমিতে অস্থায়ী গুদাম নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। শ্যামপুরের গুদাম গত ৪ জুন উদ্বোধন করা হয়েছে। টঙ্গীতে গুদামের নির্মাণকাজ ৬০ ভাগ হয়েছে।

১৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি জায়গায় নির্মিত স্থাপনায় ১০৭টি রাসায়নিকের গুদামের স্থান হবে। সেখানে ব্যবসায়ীরা যেতে রাজি নন। তাঁরা বলছেন, গুদামের ভাড়া ধরা হয়েছে প্রতি বর্গফুট ৭০ টাকা। এটা অত্যন্ত বেশি। আর পুরান ঢাকায় রাসায়নিক ব্যবসায়ীর সংখ্যা অনেক বেশি। ১০৭টি গুদাম দিয়ে কোনো কাজ হবে না। সবাই পুরান ঢাকায় থাকলে যাঁরা শ্যামপুর বা টঙ্গীতে যাবেন, তাঁদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে।

রাসায়নিক ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সদ্যবিদায়ী সভাপতি নূরুল মোস্তফা গতকাল আরমানিটোলায় তাঁর কার্যালয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাসায়নিক শিল্পপার্কে আজকে জায়গা দিলে কালই আমরা চলে যাব।’

 ‘গ্রহণযোগ্য নয়’

পুরান ঢাকা ও কেরানীগঞ্জের আবাসিক এলাকায় ঝুঁকি বাড়াচ্ছে প্লাস্টিক পণ্যের কারখানাগুলোও। ২০০৬ সালে পুরান ঢাকা থেকে প্লাস্টিকের কারখানা সরিয়ে নিতে উদ্যোগ নেওয়া হয়, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সমঝোতা স্মারক সই হয়। সেই প্লাস্টিক শিল্পনগর এখনো হয়নি।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দা সুলতানা রাজিয়া প্রথম আলোকে বলেন, পুরান ঢাকা থেকে কেরানীগঞ্জ বা আশপাশের এলাকায় রাসায়নিকের গুদাম এমন অপরিকল্পিতভাবে ছড়িয়ে দেওয়া গ্রহণযোগ্য নয়। এর মাধ্যমে ঝুঁকি এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় নেওয়া হলো। সমস্যার কোনো সমাধান হলো না। তিনি বলেন, ঝুঁকি কমাতে হলে পরিকল্পিতভাবে রাসায়নিকের গুদাম ও কারখানা লোকালয় থেকে সরিয়ে নিতে হবে।