২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

বাবা–মায়ের কটাক্ষে হতাশ মেয়েটি ফোন করেন ১০৯৮ নম্বরে

মেয়েটির অভিযোগ ছিল পরিবারের বিরুদ্ধে। জন্মগত ত্রুটির কারণে হাঁটাচলা করতে পারেন না তিনি। তাঁর জন্মের ১২ বছর পর ভাই জন্ম নেয়, এর পর থেকে তাঁর প্রতি মা–বাবার মনোযোগ কমে যায়। এমনকি তাঁর প্রতিবন্ধিতা নিয়েও কটাক্ষ করা হয়। প্রচণ্ড মানসিক হতাশা নিয়ে মেয়েটি ফোন করেন শিশুদের সহায়তায় স্থাপিত চাইল্ড হেল্পলাইন ১০৯৮ নম্বরে।

২০১৬ সাল থেকে পুরোপুরি সরকারি ব্যবস্থাপনায় হেল্পলাইনের কার্যক্রম শুরু হয়। ২৪ ঘণ্টায় পালা করে কল ধরেন ২৯ জন কল এজেন্ট।

পাঁচ বছর আগের সেই ঘটনার কথা তুলে ধরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মেয়েটি  গত ২৮ মার্চ প্রথম আলোকে জানান, সেদিন কল করার পর চাইল্ড হেল্পলাইন থেকে এক প্রতিনিধি এসে তাঁর মা–বাবার সঙ্গে কথা বলেন। পরিস্থিতি আমূল বদলে না গেলেও অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। তিনি নিজেও এখন খাপ খাইয়ে নিতে শিখে গেছেন। এ বছর উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর স্নাতকে ভর্তির অপেক্ষায় আছেন।

চাইল্ড হেল্পলাইনের তথ্য অনুসারে, বিপদগ্রস্ত শিশুদের প্রয়োজনে মোট ১১টি ক্যাটাগরির মধ্যে ৮টিতে ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে সহায়তা ও অভিযোগ জানিয়ে কলের সংখ্যা বেড়েছে। এই নম্বরে যে শুধু শিশুরাই কল করে এমনটা নয়, অনেক অভিভাবকও শিশুদের হয়ে কল করেন। গত এক বছরে মনোসামাজিক সহায়তা, নির্যাতন-সহিংসতা, ঝুঁকিতে থাকা শিশু—এ ধরনের কল এক বছরে ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। সেই সঙ্গে স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম, শিখন সমস্যা ও স্কুল থেকে ঝরে পড়া—এ–সংক্রান্ত অভিযোগ বেড়েছে ৭২ শতাংশ। বরাবরের মধ্যে তথ্য চেয়ে কল এসেছে সবচেয়ে বেশি। গত বছর মোট কলের ৬৫ শতাংশই ছিল তথ্য সহায়তাবিষয়ক।

স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন পাবলিক স্থানে বিনা মূল্যে কল সেন্টার করা উচিত, যাতে রাস্তায় বসবাসকারী শিশুরাও ১০৯৮–এ ফোন করে সহায়তা চাইতে পারে।
ওয়াহিদা বানু, নির্বাহী পরিচালক, অপরাজেয় বাংলাদেশ  

তবে করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির সময় শারীরিক স্বাস্থ্য বিষয়ে আসা কলের সংখ্যা গত দুই বছরে ধাপে ধাপে কমেছে।

২৪ ঘণ্টাই খোলা ‘১০৯৮’

ইউনিসেফ বাংলাদেশের আর্থিক সহায়তায় সমাজসেবা অধিদপ্তরের চাইল্ড সেনসিটিভ সোশ্যাল প্রটেকশন ইন বাংলাদেশ প্রকল্পের (সিএসপিবি) আওতায় চাইল্ড হেল্পলাইন ১০৯৮ পরিচালিত হয়। ২০১০ সালে বেসরকারি সংস্থা অপরাজেয় বাংলাদেশের সঙ্গে পাইলট প্রকল্প আকারে এবং ২০১৬ সাল থেকে পুরোপুরি সরকারি ব্যবস্থাপনায় হেল্পলাইনের কার্যক্রম শুরু হয়। ২৪ ঘণ্টায় পালা করে কল ধরেন ২৯ জন কল এজেন্ট।

প্রত্যন্ত এলাকার কল পেয়ে শিশুদের জন্য সাড়া দিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) নেতৃত্বে পুলিশ, সমাজসেবা কর্মকর্তা, সমাজকর্মী ও স্থানীয় এনজিও নিয়ে ভ্রাম্যমাণ দল রয়েছে।

তাৎক্ষণিক সাড়ায় ঘাটতি রয়েছে

১০৯৮ সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, জনবল ও যানবাহনের ঘাটতির কারণে রাতে যখন-তখন একটি শিশুর সহায়তায় এই দলটি সব সময় কাজ করতে পারে না। ৫০ শতাংশ এলাকায় কোনো সমাজকর্মী নেই। ১০৯৮ নম্বরটিকে ততটা জনপ্রিয় করা যায়নি। ফলে শিশুর সহায়তায় যত কল আসার কথা, তত আসছে না।

ইউনিসেফের শিশু সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ জামিলা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, জনবল–সংকটের কারণে চাহিদার তুলনায় তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া দেওয়ার বিষয়ে ঘাটতি রয়েছে। একই কারণে নম্বরটিকে জনপ্রিয় করতে বড় আকারের প্রচারাভিযান হচ্ছে না। কারণ, কলের সংখ্যা অনেক বাড়লে বর্তমান কাঠামো থেকে সবাইকে সহায়তা দেওয়া সম্ভব হবে না। সরকার বরাদ্দ বাড়ালে ১০৯৮ নম্বরটির কার্যক্রম আরও ব্যাপকভাবে প্রসারিত করতে ইউনিসেফ সহায়তা করবে। তিনি বলেন, যত বেশিসংখ্যক কলের বিষয়ে সাড়া দেওয়া যাবে, তত বেশিসংখ্যক শিশু সহায়তা পাবে।

১০৯৮–এর সহায়তার উদাহরণ

চাইল্ড হেল্পলাইন ১০৯৮–এর নিজস্ব তথ্য এবং অন্য মাধ্যম থেকে পাওয়া বিভিন্ন ঘটনা থেকেও বোঝা যায় শিশুদের সহায়তায় কার্যকরভাবে একটি পৃথক হেল্পলাইন থাকার প্রয়োজনীয়তা কতখানি। জন্মগতভাবে পায়ুপথে ত্রুটি থাকা এক শিশুকে সরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের সুযোগ পাচ্ছিলেন না মা। ওই মা পরে ১০৯৮–এর দ্বারস্থ হয়ে কর্তৃপক্ষের মনোযোগ কাড়তে সক্ষম হন। শিশুটির অস্ত্রোপচার হয়। অপহরণের পর ধর্ষণের শিকার নাতনিকে খুঁজে পেতে সহায়তা চেয়ে কল করেছিলেন এক নানা। পরে মেয়েটিকে উদ্ধার ও অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হয়।

২০২১ সালে মোট কল এসেছিল ১ লাখ ৬১ হাজার ৯৪০টি। ২০২২ সালে মোট কল এসেছে ১ লাখ ৮৫ হাজার ৭৬১টি। ২০২৩ সালের ২১ মার্চ পর্যন্ত মোট কল এসেছে ৪৭ হাজার ৯৭৭টি।

রাজধানীর দনিয়া এলাকার এক মা প্রথম আলোকে জানান, তাঁর মানসিকভাবে অসুস্থ মেয়ে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় স্কুল কর্তৃপক্ষ এসএসসির ফরম পূরণ করতে দিচ্ছিল না। ১০৯৮–এ ফোন করার পর মেয়েকে ফরম পূরণ করতে দেওয়া হয়েছে। দক্ষিণখান এলাকার এক বাবা তাঁর প্রতিবন্ধী শিশুর জন্য সরকারের ভাতাসহায়তা সুবর্ণ নাগরিক কার্ড কোথায় গেলে করতে পারবেন, জানতেন না। তিনি ১০৯৮–এর সহায়তা নিয়ে কার্ডটি করেন। ওই শিশুটির বিষয়ে কাজ করা সমাজকর্মী সাজ্জাদ হুসাইন প্রথম আলোকে বলেন, ওই বাবা তাঁর সন্তানের পড়াশোনাসহ ভবিষ্যতে যেন আরও সহায়তা পেতে পারেন, সে উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। স্কুলের বেতনের জন্য এক শিশু নিজেও কল করেছিল।

যত কল এসেছে

চাইল্ড হেল্পলাইন ১০৯৮–এর তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালে মোট কল এসেছে ১ লাখ ৮৫ হাজার ৭৬১টি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি তথ্যসহায়তা বিষয়ে কল এসেছে ১ লাখ ২০ হাজার ৭৯৩টি। এ ছাড়া নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার শিশুর বিষয়ে ৮ হাজার ২১টি, শারীরিক স্বাস্থ্য বিষয়ে ৬ হাজার ৭৫১টি, মনোসামাজিক সহায়তা চেয়ে ৬ হাজার ৬৮টি, স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম, শিখন অক্ষমতা ও স্কুল থেকে ঝরে পড়া বিষয়ে কল এসেছে ৫ হাজার ৮৫৬টি, বিভিন্ন কারণে ঝুঁকিতে থাকা শিশুর বিষয়ে ৪ হাজার ৫৯০টি, আইনি সহায়তা চেয়ে ১ হাজার ৬২১টি, প্রেম–সম্পর্কিত বিষয়ে ৮৬৪টি, মাদক বিষয়ে ১২৯টি, প্র্যাংক কল বা মজা করে কল ১২ হাজার ৭৮৮টি এবং অন্যান্য কল এসেছে ১৮ হাজার ২৯০টি।

২০২৩ সালের ২১ মার্চ পর্যন্ত মোট কল এসেছে ৪৭ হাজার ৯৭৭টি। ২০২১ সালে মোট কল এসেছিল ১ লাখ ৬১ হাজার ৯৪০টি।

চাইল্ড হেল্পলাইন ১০৯৮–এর সমন্বয়ক চৌধুরী মোহাম্মদ মোহাইমেন প্রথম আলোকে বলেন, ১০৯৮–এ শিশুরা এবং শিশুদের জন্য বড়রা ফোন করে কখনো কাউকে পাননি, এমন রেকর্ড নেই। প্রতিটি কলকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, ফলোআপ করা হয় এবং কলের প্রয়োজন অনুসারে স্থানীয় সমাজসেবা কর্মকর্তা বা সমাজকর্মী ঘটনাস্থলে যান, কাউন্সিলরেরা ফোনে মনোসামাজিক সহায়তা দেন। এমনকি প্র্যাংক কল বা মজা করে কল করা শিশুকেও ফোনে সঙ্গ দেওয়া হয়। কারণ, অনেক শিশু মা–বাবার মনোযোগ পায় না। তারা নিজেদের কথা, আনন্দ ভাগাভাগি করতে চায়। জনবলের ঘাটতি বিষয়ে তিনি বলেন, জনবল কম থাকলেও কাজে কোনো অবহেলা করা হয় না। অনেকে একই সঙ্গে একাধিক এলাকার দায়িত্ব পালন করেন।

কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি ১০৯৮

১০৯৮ মনোযোগ ও প্রতিশ্রুতির অভাবে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি বলে মনে করেন অপরাজেয় বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ওয়াহিদা বানু। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ১০৯৮ বাংলাদেশের প্রথম হেল্পলাইন নম্বর। এটির মূল উদ্দেশ্য ছিল বিপদগ্রস্ত শিশুকে সহায়তা দিয়ে তার সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা ও তা নিয়মিত পর্যবেক্ষণের জন্য ব্যাপক পরিসরের সমন্বিত কার্যক্রম রাখা। নম্বরটি যেন সবার মুখে মুখে থাকে। কিন্তু সে আস্থার জায়গা তৈরি করতে পারেনি ১০৯৮। এর অনেক পরে এসে পুলিশের হেল্পলাইন ৯৯৯ আজ জনপ্রিয়। তিনি বলেন, স্কুল–কলেজসহ বিভিন্ন পাবলিক স্থানে বিনা মূল্যে কল সেন্টার করা উচিত, যাতে রাস্তায় বসবাসকারী শিশুরাও ১০৯৮–এ ফোন করে সহায়তা চাইতে পারে।