জরুরি বহির্গমন, অগ্নিনির্বাপক পরিকল্পনা—কিছুই ছিল না সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত অক্সিজেন প্ল্যান্ট

পাঁচ মাস আগে সীতাকুণ্ডের সীমা অক্সিজেন লিমিটেড প্ল্যান্টকে জরুরি বহির্গমন নকশা অনুমোদন এবং প্রধান বিদ্যুৎ পরিদর্শকের দপ্তর থেকে বৈদ্যুতিক অনুমোদনপত্র গ্রহণ করার তাগিদ দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তারা তা করেনি। বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির কোনো অগ্নিনিরাপত্তার পরিকল্পনা (ফায়ার সেফটি প্ল্যান) ছিল না তাদের। এ ছাড়া চীন থেকে আমদানি করা প্ল্যান্টটি চালানোর জন্য অপারেটরদের কোনো আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়নি। রক্ষণাবেক্ষণের শর্তও মানেনি তারা।

বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত অক্সিজেন পরিবহনের একটি ট্রাক। শনিবার সন্ধ্যা সাতটায় সীতাকুণ্ডের কদমরসুল এলাকায়
ছবি: সৌরভ দাশ

এসব কারণে ৪ মার্চ প্ল্যান্টটিতে বড় ধরনের বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করছে জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি। ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে বিদেশ থেকে আমদানি করা সব ধরনের মেশিনারিজ যথাযথ পরীক্ষার পর দেশে ঢোকার অনুমতি দানের পাশাপাশি নির্দিষ্ট সময় পরপর সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কার্যকারিতা ও গুণগত মান পরীক্ষার সুপারিশ করছে।

৪ মার্চের এ বিস্ফোরণে ৭ জন নিহত ও ২৫ জন আহত হন। এ ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ১৪ মার্চ তদন্ত কমিটি তাদের আট পৃষ্ঠার প্রতিবেদন জমা দেয়। সাত সদস্যের কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাকিব হাসান। এর বাইরে বিশেষজ্ঞ হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সুমন বড়ুয়া ও চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মামুনুর রশিদকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান প্রতিবেদনটি মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সেখান থেকে নির্দেশনা আসার পর প্রতিবেদন অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলে জানানো হয়।
জানতে চাইলে এডিএম রাকিব হাসান বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনে ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য ৯টি সুপারিশ দেওয়া হয়েছে। এগুলো মেনে চলা সম্ভব হলে ঝুঁকি এড়ানো যাবে।

বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত অক্সিজেন পরিবহনের একটি ট্রাক। শনিবার সন্ধ্যা সাতটায় সীতাকুণ্ডের কদমরসুল এলাকায়
ছবি: সৌরভ দাশ

ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বিস্ফোরণের সম্ভাব্য কারণ, বিস্ফোরণের উৎস, কমিটির পর্যবেক্ষণ, বিশেষজ্ঞ মতামত, দায়দায়িত্ব এবং ভবিষ্যতের জন্য সুপারিশমালা আকারে তদন্ত প্রতিবেদনটি সাজানো হয়। এ ছাড়া তদন্ত কমিটির কিছু সীমাবদ্ধতার কথাও তাতে উল্লেখ করা হয়।

দায়দায়িত্বের মধ্যে সীমার রক্ষণাবেক্ষণ না করার বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, যদিও কারিগরি ত্রুটির কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে, তবে এসব ত্রুটির পেছনে সীমা অক্সিজেনের যথেষ্ট অবহেলা রয়েছে।

যত ঘাটতি

তদন্তে বলা হয়, জরুরি প্রয়োজনে প্ল্যান্ট থেকে বের হওয়ার জন্য বহির্গমনের জন্য কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তর থেকে গত বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টকে বহির্গমন নকশা অনুমোদন এবং প্রধান বিদ্যুৎ পরিদর্শকের মতামত নিতে বলা হয়েছিল। তখন তারা তিন মাস সময় চেয়ে নিয়েছিল। কিন্তু তিন মাস সময় পার হওয়ার পরও এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা অধিদপ্তর থেকে নেওয়া হয়নি।

একইভাবে বিস্ফোরক পরিদপ্তরের লাইসেন্সের মেয়াদও শেষ হয়েছিল ডিসেম্বরে। তা নবায়নের জন্য কোনো ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠানটি নেয়নি। বিস্ফোরক পরিদপ্তরও এ বিষয়ে তাদের কোনো ধরনের নোটিশ করেনি।

২০১৭ সালে চীন থেকে আমদানি করা বাতাস পৃথকীকরণ ইউনিটটির ব্যবহার বিধিতে চারটি বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে বছরে একবার গ্যাসের প্রেশার ক্যালিব্রেট করতে বলা হয়। এ ছাড়া বছরে একবার সেফটি ভুলত্রুটি রক্ষণাবেক্ষণ করা, তিন বছর পরপর সিলিন্ডার পরীক্ষাসহ নানা পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু সীমা তাতে কর্ণপাত করেনি। এ বিষয়ে বিস্ফোরক পরিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগের পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেনকে ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

বিস্ফোরণের উৎস ও কারণ

বিস্ফোরণের উৎস ছিল প্ল্যান্টের বায়ু পৃথকীকরণ ইউনিট বা এয়ার সেপারেশন ইউনিটের কনডেনসার। এখানে কারিগরি ত্রুটির কারণে বিস্ফোরণ হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, সীতাকুণ্ডে বেশ কয়েকটি ইস্পাত কারখানা ও জাহাজ ভাঙা শিল্পকারখানা রয়েছে। সেখানে বাতাসে প্রচুর হাইড্রোকার্বনের উপস্থিতি রয়েছে। সীমা প্ল্যান্টের ফিল্টারের রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে হাইড্রোকার্বন বা অন্য কোনো দাহ্য পদার্থ কলামের কনডেনসারে জমা হতে পারে। হাইড্রোকার্বন অক্সিজেনের সংস্পর্শে এলে কোনো একটি স্ফুলিঙ্গের মাধ্যমে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হতে পারে।

চুয়েটের অধ্যাপক মামুনুর রশিদ বলেন, হাইড্রোকার্বন দাহ্য পদার্থ। অক্সিজেন নিজে জ্বলে না, কিন্তু অন্যকে জ্বালাতে সাহায্য করে। সে জন্য কোনো স্পার্কের কারণে এ আগুনের সূত্রপাত হতে পারে।

তদন্ত সূত্র জানায়, আগুনের সূত্রপাতের পর ইউনিট কলামের মধ্যে বাতাসের চাপ বাড়তে থাকে। সর্বোচ্চ এক মিনিটের মধ্যেই পুরো তরল অক্সিজেন বাষ্পীভূত হয়ে বিপুল চাপের কারণে এয়ার সেপারেশন ইউনিট কলামটি বিস্ফোরিত হয়। অদক্ষ শ্রমিক দ্বারা প্ল্যান্ট পরিচালনা, যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণ না করাও দুর্ঘটনার অন্যতম সম্ভাব্য কারণ বলে মনে করা হয়।

সুপারিশ

সুপারিশের মধ্যে বলা হয় দেশের বিভিন্ন জেলায় জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে শিল্প পুলিশ, বিস্ফোরক পরিদপ্তর, কলকারখানা প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা যেতে পারে। যারা নিয়মিত শিল্পকারখানাগুলো পরিদর্শন করবে। সীমা প্ল্যান্টের আলোকে দেশের অন্যান্য অক্সিজেন প্ল্যান্টগুলোকে সর্তক করতে বলা হয়। এ ছাড়া তাদের রক্ষণাবেক্ষণসহ যাবতীয় ব্যবস্থা সঠিক রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখার পরামর্শ দেওয়া হয়।
আবাসিক এলাকায় কারখানা নিরূৎসাহিতকরণের কথাও বলা হয়। এ ছাড়া সব শিল্পকারখানা দক্ষ জনবল দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিতের পরামর্শ দেওয়া হয়।

তদন্তের কিছু সীমাবদ্ধতার কথাও উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে দেশে অক্সিজেন প্ল্যান্ট দুর্ঘটনা প্রথমবার সংঘটিত হওয়ায় পূর্ব অভিজ্ঞতার অভাব অন্যতম। এ ছাড়া সীমার যাবতীয় নথিপত্র পুড়ে যাওয়া এবং মূল অপারেটর ও তার দুই সহযোগীর মৃত্যুর কারণে বিস্ফোরণের আগের মুহূর্তের কারিগরি ত্রুটি জানা যায়নি। এ ছাড়া কোনো সিসি ক্যামেরার ফুটেজও পাওয়া যায়নি।