ব্রিটিশ কাউন্সিলের সুদীর্ঘ পদযাত্রার শুরুটা কীভাবে হয়েছিল?
তৌফিক হাসান: ব্রিটিশ কাউন্সিল ১৯৫১ সালে ঢাকায় তাদের প্রথম অফিস স্থাপন করে, যা বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ফুলার রোডে অবস্থিত। ব্রিটিশ কাউন্সিলের মূল লক্ষ্য হলো শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে যুক্তরাজ্য ও পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মানুষের মধে৵ সুসম্পর্ক, আস্থা এবং বোঝাপড়া গড়ে তোলা। ৭০ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে ব্রিটিশ কাউন্সিল বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক আরও জোরদার করতে কাজ করে যাচ্ছে।
অনেক সময় ধারণা করা হয় যে ব্রিটিশ কাউন্সিল হয়তো শুধুই একটা লাইব্রেরি অথবা এখানে মানুষ আইইএলটিএস পরীক্ষা দিতে যায়। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে ব্রিটিশ কাউন্সিলের কাজের ক্ষেত্র অত্যন্ত বিস্তৃত।
শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত মানোন্নয়নে বাংলাদেশ সরকার এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে আমরা শুরু থেকেই কাজ করে আসছি। ব্রিটিশ কাউন্সিলের সুপরিচিত লাইব্রেরিটি প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৫৪ সালে। এই লাইব্রেরিতে তৎকালীন মেধাবী শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করেছেন এবং এখনো তাঁরা এই বিষয়ে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে স্মৃতিচারণা করেন।
১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে ‘কমনওয়েলথ স্কলারশিপ’ ব্যবস্থা চালু করে যুক্তরাজ্য সরকার, যার বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে ব্রিটিশ কাউন্সিল।
এ ছাড়া যুক্তরাজ্য সরকারের আরেকটি স্কলারশিপ প্রোগ্রাম, ম্যানেজিং অ্যাট দ্য টপ (MATT), বাংলাদেশে পরিচালনায় ব্রিটিশ কাউন্সিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, যা সিনিয়র সরকারি কর্মকর্তাদের উন্নত নেতৃত্ব ও ব্যবস্থাপনা দক্ষতা উন্নয়নে সহায়তা করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল।
বর্তমানে কমনওয়েলথ স্কলারশিপের পাশাপাশি ব্রিটিশ কাউন্সিলের জিআরইএটি (GREAT) এবং ওমেন ইন স্টিম (Women in STEM) স্কলারশিপের মাধ্যমে অসংখ্য মেধাবী শিক্ষার্থী নিজের এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে অবদান রাখছেন।
এর পাশাপাশি, ব্রিটিশ কাউন্সিল বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষা শিক্ষা উন্নয়ন, আধুনিক গ্রন্থাগার স্থাপন, শিক্ষক প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষা বিনিময় প্রোগ্রামের মতো কার্যক্রমগুলো চালিয়ে গেছে, যা শিক্ষার মানোন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি এবং কার্যকর প্রভাব ফেলেছে।
আপনি বললেন শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত মানোন্নয়নে বাংলাদেশ সরকার এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আপনারা কাজ করেন। এ বিষয়ে যদি একটু বিস্তারিত বলেন এবং বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে ব্রিটিশ কাউন্সিলের কাজের প্রভাব কীভাবে দেখছেন?
তৌফিক হাসান: ব্রিটিশ কাউন্সিল যুক্তরাজ্য এবং বাংলাদেশের মধ্যে উচ্চশিক্ষা (HE), টেকনিক্যাল ও ভোকেশনাল এডুকেশন অ্যান্ড ট্রেনিং (TVET), বিজ্ঞান এবং স্কুল কার্যক্রমে অংশীদারত্ব তৈরি করে। এর মাধ্যমে আমরা উন্নতমানের, আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং বৈশ্বিকভাবে সংযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক শিক্ষাক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখি।
উদাহরণস্বরূপ, ২০০৯ সালের শুরুর দিকে যুক্তরাজ্যের ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিসের (এফসিডিও) সহযোগিতায় ‘কানেক্টিং ক্লাসরুম’ শীর্ষক প্রোগ্রাম চালু করা হয়, যা পরিচালিত হয় ব্রিটিশ কাউন্সিল ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে ৯ হাজারের বেশি শিক্ষক, ৭ হাজারের বেশি প্রধান শিক্ষক এবং ২৮ লাখ ৮০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী উপকৃত হয়েছেন।
সম্প্রতি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আর্থিক সহযোগিতায় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সঙ্গে যৌথভাবে ‘ট্রেইনিং অব মাস্টার ট্রেইনার ইন ইংলিশ (TMTE)’ শীর্ষক একটি উদ্যোগ নিয়েছিল ব্রিটিশ কাউন্সিল। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ইংরেজি ভাষা ও শিক্ষাদানের দক্ষতা উন্নয়ন করা।
এই প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় দুই হাজারের বেশি প্রাথমিক শিক্ষককে মাস্টার ট্রেইনার হিসেবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, যাঁরা পরবর্তী সময়ে দেশব্যাপী ইংরেজি শিক্ষকের দক্ষতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবেন।
ব্রিটিশ কাউন্সিলের উচ্চশিক্ষা কর্মসূচি, বিশেষত গোয়িং গ্লোবাল পার্টনারশিপ, বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন, আন্তর্জাতিকীকরণ এবং দক্ষতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। সেন্টার অব এক্সিলেন্স ইন টিচিং অ্যান্ড লার্নিং (CETL), টিচিং এক্সিলেন্স প্রোগ্রাম (TEP) এবং রিসার্চ কানেক্ট, যা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সঙ্গে অংশীদারত্বের মাধ্যমে পরিচালিত হয়, শিক্ষকের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি এবং শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে সহায়ক হয়েছে। পাশাপাশি এই কার্যক্রম বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার আন্তর্জাতিকীকরণে ট্রান্সন্যাশনাল এডুকেশন (TNE) প্রসারের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের উচ্চশিক্ষা অংশীদারত্বকে আরও শক্তিশালী করছে।
ব্রিটিশ কাউন্সিলের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা (NFE) কার্যক্রম তরুণদের দক্ষতা উন্নয়ন, নেতৃত্বের ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। অ্যাকটিভ সিটিজেনস, লিড বাংলাদেশ এবং ইয়ুথ কানেক্টের মতো প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে হাজার হাজার তরুণ-তরুণী নেতৃত্বের দক্ষতা অর্জন করে।
বিশেষ করে শিক্ষা, সামাজিক উদ্যোগ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় স্থানীয় ও বৈশ্বিক পর্যায়ে প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করছে। এ ছাড়া নেক্সট জেনারেশন রিসার্চ বাংলাদেশের যুব সমাজের অগ্রাধিকার চাহিদা এবং মনোভাব সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ সরবরাহ করেছে, যা নীতিনির্ধারণ এবং কার্যক্রম পরিকল্পনায় কার্যকরভাবে সহায়ক হয়েছে।
প্রতিবছর ব্রিটিশ কাউন্সিল অসংখ্য পরীক্ষা (আইইএলটিএস, ও-লেভেল, এ-লেভেল ইত্যাদি) পরিচালনা করে। পরীক্ষাগুলো কীভাবে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য সুযোগ এবং সম্ভাবনা তৈরি করছে বলে আপনারা মনে করেন?
জুনায়েদ: প্রতি মাসে কয়েক হাজার তরুণ শিক্ষার্থী ব্রিটিশ কাউন্সিলের মাধ্যমে আইইএলটিএস পরীক্ষা দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক শিক্ষাক্রম অনুসরণ করে বছরে প্রায় ২৫ হাজার শিক্ষার্থী ও লেভেল এবং এ লেভেল পরীক্ষা দেয়। প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে এসব পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা অসামান্য সাফল্য অর্জন করে দেশে বা দেশের বাইরে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করছে, কর্মক্ষেত্রে উৎকর্ষ অর্জন করছে এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে অবদান রাখছে।
ব্রিটিশ কাউন্সিলের কোর্সগুলো কীভাবে বিভিন্ন বয়সী শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও জ্ঞান বিকাশে সহায়তা করে? পাশাপাশি এই দক্ষতা কীভাবে তাদের জীবনকে প্রভাবিত করে?
জুনায়েদ: প্রতিবছর অসংখ্য শিক্ষার্থী ব্রিটিশ কাউন্সিলে ইংরেজি শেখার বিভিন্ন কোর্স করছে। বিভিন্ন কোর্সের মাধ্যমে তারা শুধু ইংরেজি ভাষাতেই দক্ষতা অর্জন করছে না; বরং সামগ্রিকভাবে বিভিন্ন দক্ষতা লাভ করছে। ইংরেজিতে কথা বলা, শোনা ও লেখার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ‘ক্রিটিক্যাল থিংকিংয়ে’র সক্ষমতাও গড়ে ওঠে।
যেহেতু ব্রিটিশ কাউন্সিলের পুরো শিক্ষাব্যবস্থাটা একটা সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা, ইংরেজি শেখার পাশাপাশি বিভিন্ন সফট স্কিলস শিক্ষার্থীদের শেখানো হয়। ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে প্রাপ্ত সার্টিফিকেটের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে যা শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাসও তৈরি করে এবং কর্মজীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রের উন্নয়নে ব্রিটিশ কাউন্সিলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? দুজনের কাছেই জানতে চাই।
জুনায়েদ: বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে এখন ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল আছে। সেই স্কুলগুলো যোগ্য শিক্ষক পাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন হয়। আমরা এই পরিস্থিতির উন্নয়নে টিচার্স ট্রেনিংয়ের সহযোগিতা দিচ্ছি। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, ঢাকার বাইরে আরও বেশি ইংরেজি মাধ্যমের স্বয়ংসম্পূর্ণ স্কুল গড়ে তোলা। এর পাশাপাশি জেলা-পর্যায়ে আইইএলটিএসের পরীক্ষাকেন্দ্র চালুর মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশের সব শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছাতে চাই।
তৌফিক হাসান: বর্তমানে যে কার্যক্রমগুলো চলমান, সেগুলো আমরা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আরও দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারত্বের ভিত্তিতে শিক্ষা উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় কাজে লাগাতে চাই। বিশেষ করে, শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়ন এবং শিক্ষা নেতৃত্বের ক্ষেত্রে আমরা আরও বৃহৎ পরিসরে কাজ করতে আগ্রহী। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে আমরা একটি টেকসই বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য উচ্চশিক্ষা অংশীদারত্বের রূপরেখা তৈরি এবং বাস্তবায়ন করতে চাই, যেখানে শিক্ষক পেশাগত উন্নয়ন, মাননিয়ন্ত্রণ ও স্বীকৃতি এবং আন্তর্জাতিকীকরণের মতো ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে আরও গভীর ও বিস্তৃত অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। আমরা সেই লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছি।