রাজপথে অভ্যুত্থানের অভিনব অভিনয়
বিকেলের ম্লান আলো গায়ে মেখে টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে বসে ভাবসংগীত গাইছিল সাদাপোশাকের সাধকের দল। ঢোল, খঞ্জনি, খমক বাজিয়ে তাঁরা গাইছিলেন, ‘কত খেলা জানো রে মওলা, কত খেলা জানো/ গলায় দিয়া প্রেমের রশি আস্তে আস্তে টানো...।’ অনেক লোক জমে গেছেন গান শুনতে। আচমকা কালো প্যান্ট, কালো টি-শার্ট, মাথায় হেলমেট, লাঠিসোঁটা হাতে একদল হামলাকারী ঝাঁপিয়ে পড়ল গানে মগ্ন সাধকদের ওপর।
সাধারণ দর্শকেরা প্রথমে বেশ হকচকিত হয়ে গিয়েছিলেন এই আচমকা আক্রমণে। মাথায় হেলমেট চাপানো একটি বাহিনীর এমন মারদাঙ্গার স্মৃতি জনমানসে এখনো বেশ তাজা। সেই ‘হেলমেট বাহিনী’র কার্যকলাপ যে নাটক হিসেবে (উন্মুক্ত রাজপথ গণপরিবেশনা) অভিনীত হচ্ছে, দর্শকেরা অচিরেই তা বুঝলেন। হেলমেট বাহিনীর হামলায় সাধুদের দল নেমে এল রাজপথে, ‘দিয়েছি তো রক্ত/ আরও দেব রক্ত’, ‘রক্তের বন্যায়/ ভেসে যাবে অন্যায়’ স্লোগান নিয়ে। শহীদ ডা. শামসুল হক মিলন চত্বরের কোণে ফুটপাত ঘেঁষে আগে থেকেই চাকা লাগানো তিনটি বড় আকারের ট্রলির ওপর প্রমাণ আকারের ভাস্কর্য তৈরি করে রাখা হয়েছে। এসব ভাস্কর্যের কারও পরনে ছিল শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, পায়জামা-পাঞ্জাবি, ধুতি, শার্ট-প্যান্ট, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক। সেসব দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছিল দেশের ধর্ম-বর্ণ-জাতিনির্বিশেষে সব শ্রেণির প্রতিনিধি রয়েছেন এই ভাস্কর্যের সারিতে। নাট্যকর্মীরা এসব ট্রলি টেনে নিয়ে সাধকদের সঙ্গে মিছিলে যোগ দিলেন। একে একে আরও অনেক নাট্যকর্মী যোগ দিলেন মিছিলে। শাহবাগের দিকে যাত্রা করে মিছিলটি। তাদের ওপর বিশাল একটি লাল কাপড় চাঁদোয়ার মতো করে তুলে ধরা হয়েছিল। আর সামনে ছিল একটি ট্রাক। সেখান ছিল বাদ্যযন্ত্র এবং আরও কয়েক নাট্যশিল্পী। ট্রাক থেকে শব্দ প্রক্ষেপণ করা হচ্ছিল।
প্রতিবাদী মিছিলটি বিশ্ববিদালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের গেটের কাছাকাছি আসতেই হেলমেট বাহিনীর আরেক দফা হামলার শিকার হলো। এবার তারা আরও মারমুখী। পিটিয়ে–কুপিয়ে মেরে ফেলল অনেককে। লাশ পড়ে গেল সড়কে। এরপর করুণ সুরের আবহে সাধুরা লাশের ওপর ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে দিতে থাকলেন। তাঁরা গাইলেন ‘কে বলে মানুষ মরে...।’ গানের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে ভিন্ন আঙ্গিকের পরিবেশনা উপস্থাপন করলেন পথে পড়ে থাকা আহত ও নিহত ব্যক্তিরা।
এরপর মিছিলটি কিছু দূর এগিয়ে যেতেই তাদের আটক করতে ট্রাক থেকে ডাইনির বেশে কেউ একজন তাদের ওপর জাল ছুড়ে দেয়। এবার শুরু হয় জাল থেকে মুক্ত হওয়ার সংগ্রাম। একটা পর্যায়ে বীরদর্পে তারা জাল ছিন্ন করে বেরিয়ে আসে।
মিছিলটি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধি বরাবর যেতে যেতে বদলে যায় স্লোগান। ‘বল বীর বল উন্নত মম শীর’ ধ্বনিত হতে থাকে কণ্ঠ থেকে কণ্ঠে। কালজয়ী কবিতার চরণ ছড়িয়ে যায় স্লোগান হয়ে। একটা পর্যায়ে অভিনয়শিল্পীরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে তাঁদের আঞ্চলিক ভাষায় কবিতাটির চরণ আবৃত্তি করতে থাকেন।
চারুকলা অনুষদের সামনে সড়কের ওপর কালো কাপড়ে ঘেরা একটি ঘরের কাঠামো তৈরি করা ছিল। তাতে লেখা ‘রাষ্ট্রীয় আয়নাঘর’। মিছিলের উত্তাল জনতা এবার চুরমার করে ফেলে আয়নাঘর। ভেতরে দেখা যায় অনেক করোটি, কঙ্কাল পড়ে আছে। তাঁরা সেগুলো নিয়ে আহাজারি করতে থাকেন। মহররম মাসে আশুরার তাজিয়া মিছিলের সময় যেমন মাত-মর্সিয়া দেখা যায়, অনেকটা সেই আঙ্গিকে শিল্পীরা স্বজনহারানোর বেদনার হাহাকার ফুটিয়ে তোলেন। এখানেও খানিকটা সময় ধরে অভিনয় চলতে থাকে। সড়ক বিভাজকের সঙ্গে ক্যানভাসে জাতির বিভিন্ন সংগ্রামের দৃশ্য উপস্থাপন করা হয়। সেখানে নবাব সিরাজ উদ্দৌলার সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধ, ফকির বিদ্রোহ, মুক্তিযুদ্ধ থেকে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং সদ্য ছাত্র-জনতার জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের দৃশ্য তুলে ধরা হয়। শিল্পীরা শহীদ আসাদ, বীর তারামন বিবি, আবু সাঈদ, মুগ্ধসহ বিভিন্ন চরিত্রের আদলে বীরত্বের বাণী হিসেবে ‘বিদ্রোহী কবিতা’র বিভিন্ন চরণ আবৃত্তি করেন। মিছিলের আঙ্গিক বদলে যায়। এবার তাঁরা বীরদর্পে শক্তিমত্তা প্রকাশ করে নৃত্য পরিবেশন করেন।
‘চল চল চল/ লাল মজলুম চল’ স্লোগান দিয়ে উদ্দাম নৃত্য করে মিছিলটি চারুকলা অনুষদের মূল প্রবেশপথের সামনে আসতেই সেখানে পুলিশের জলকামানের মতো করে সাজিয়ে রাখা একটি ট্রাক থেকে রঙিন পানি ছুড়ে দেওয়া হয় তাঁদের ওপর। চলে হামলা। পথে পড়ে যান অনেকে। তবে মিছিলটি ক্রমেই দীর্ঘ হয়ে উঠেছিল। সঙ্গীদের মৃত্যুতে তাঁরা আরও ক্ষুব্ধ হয়ে জলকামানের গাড়িটি গুঁড়িয়ে দিয়ে গগনবিদারী ‘লাল মজলুম চল’ স্লোগান দিয়ে এগিয়ে যান জাতীয় জাদুঘরের দিকে।
জাদঘুরের প্রবেশপথের সামনে আগে থেকেই জাতীয় সংসদের অনুকৃতি তৈরি করে রাখা ছিল। তার নাম রাখা হয়েছিল ‘লাল মজলুম গণ সংসদ’। মিছিলটি সংসদের সামনে এসে তাদের যাত্রা শেষ করে। সংসদের সামনে ছিল একটি লাল বাক্স। হ্যাট-কোট-রোদচশমা পরা এক ব্যক্তি সেই লাল বাক্সটি নিয়ে কিছু করার চেষ্টা করছিলেন। মিছিলের এক প্রতিনিধি তাঁকে প্রশ্ন করেন, তিনি এখানে কী করছেন? লোকটি জানান, তিনি ‘রিফর্মিং’ করছেন। মিছিলের সমবেত কণ্ঠ জানায়, তাঁরা কোনো রিফর্মিং চান না। তাঁরা তাঁদের নিজেদের সংসদে নিজেরাই ঠিক করবেন কী করতে হবে। এই পর্যায়ে এসে দর্শকদের মধ্যেই অনেকে এসে তাঁদের কথা বলেন। একজন রিকশাচালক ফয়সল, কারখানাশ্রমিক মেহেদি হাসান বলেন, তাঁরা চান দেশে খেটে খাওয়া মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক।
অভিনয়ে অংশ নিয়েছেন কুর্নিকোভা চাকমা, তাহসান বিন রফিক, শাফিন শেখ, কাদেরুজ্জামান, ঈদুল ফয়সাল, রিমি রফিক, সানজিদা ইয়াসমিন, শিশির রায়, আমিনুল ইসলাম, মীর শাহরিয়ার, শাওন দাস, রিয়াদ ইসলাম, রাজীব শিকদার, ইয়াসিন খান প্রমুখ। গানের দলে ছিলেন বাদল হোসেন, আল মামুন, মীর সাখাওয়াত, রবিউল ইসলাম, মেহেদী হাসান, অভিজিৎ পাল প্রমুখ।
নাটকের অভিনয় শেষে নির্দেশক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শাহমান মৈশান বলেন, এই নাটকে প্রতীকীভাবে এ দেশের মানুষের দীর্ঘদিনের সংগ্রাম, সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, জুলুম–নির্যাতন থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা অভিনয়, সংগীত, ভাস্কর্য, চিত্রকলাসহ বিভিন্ন শিল্প মাধ্যমে সম্মিলিতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এখন মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। জনসাধারণের অভ্যুত্থানের সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তিকে তাঁরা গণপরিসরে ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস পেয়েছেন।
বিকেল চারটায় শুরু হয়ে প্রায় দুই ঘণ্টা চলে ‘লাল মজলুম’ নামে এই উন্মুক্ত রাজপথ গণপরিবেশনা। পথের দুই পাশ দিয়ে চলতে চলতে অনেক দর্শক এই পরিবেশনা উপভোগ করেন। এই ঘটনাগুলো এত দিন অনেকেই চারপাশে ঘটতে দেখেছেন। নাটকে সেসব দৃশ্যের অভিনয় তাঁদের অনুপ্রাণিত করছে এসবের বাস্তব পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে, সেই চেতনায় উদ্দীপ্ত হতে।