‘বাঘের মুখ থেকি লাশ কাড়ি আনছি, এখন আর ভয়ে বনে যাই না’

ষাটোর্ধ্ব দেবেন মণ্ডল এখন গান গেয়ে দিন পার করেনছবি: প্রথম আলো

‘হায় রে সুন্দরবন/ সে যে মায়েরই মতন/ বিধাতা করেছে নিজেই সৃষ্টি রে!’ ষাটোর্ধ্ব দেবেন মণ্ডলকে একটি গান গাইতে বললে তিনি দরদ দিয়ে এই গান গাইলেন।

গানটির প্রতিটি লাইনে সুন্দরবনের প্রতি ভালোবাসা, জীবিকার কথা। দেবেন মণ্ডল একসময় কাঠুরিয়া ছিলেন। সুন্দরবনের গভীরে ছিল তাঁর নিত্য আনাগোনা। তবে ১৩ বছর ধরে সুন্দরবনের ভেতরে আর যান না দেবেন মণ্ডল। তিনি বলেন, ‘এখন গান-বাদ্য করি, কাজ করি, মাছ ধরি।’

২৫ বছরের বনজীবী জীবনে চারবার খুব কাছ থেকে বাঘ দেখেছেন বলে জানালেন দেবেন মণ্ডল। একবার বাঘের মুখ থেকে লাশ কেড়ে এনেছিলেন বলে দাবি তাঁর। দেবেন মণ্ডল বলেন, ‘বাঘের মুখ থেকি লাশ কাড়ি আনছি, এখন আর ভয়ে বনে যাই না।’

দেবেন মণ্ডলের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের দেখা হয় গত ২২ ডিসেম্বর খুলনার দাকোপ উপজেলার বানিশান্তা ইউনিয়নের খেজুরিয়া গ্রামে।

সুন্দরবনের ভেতরে যাওয়া ছাড়লেও বন নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই দেবেন মণ্ডলের। তাঁর ভাষায়, ‘আমার পরিবার জঙ্গলের পরেই বাঁচিয়াছি’ (জঙ্গলই তাঁর পরিবারকে বাঁচিয়ে রেখেছে)। তাই সুন্দরবনের গুণকীর্তন করে কণ্ঠে গান তোলেন দেবেন মণ্ডল, ‘গাছে গাছে নানান পাখি দেখিতে যে পাই/বাঘ, হরিণ, জাতিসর্প রয়েছে সেথায়। হায় রে সুন্দরবন/সে যে মায়েরই মতন...’

সুন্দরবনের একদম কাছঘেঁষা গ্রাম খেজুরিয়া। গ্রামবাসীই খোঁজ দিলেন ৬৩ বছর বয়সী দেবেন মণ্ডলের।

সরু রাস্তা ধরে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় করে যেতে যেতে এর-ওর সঙ্গে কথা বলার পর সন্ধ্যা নামার মুখে দেবেন মণ্ডলকে পাওয়া গেল।

গ্রামের বাজারে একটি বন্ধ দোকানের সামনের বেঞ্চে বসে ছিলেন দেবেন মণ্ডল। পরিচয় দেওয়ার পর তিনি কথা বলতে বেশ আগ্রহ দেখালেন।

অভিজ্ঞতার ঝাঁপি খুললেন দেবেন মণ্ডল। আলাপে সুন্দরবন, বাঘ, নিজের জীবন-জীবিকাসহ নানা প্রসঙ্গ উঠে এল। তবে বাঘের কথা এল একটু বেশিই।

সুন্দরবনকে ‘অন্নদাতা’ হিসেবে বারবার তুলে ধরেন দেবেন মণ্ডল। জীবিকার উৎস হিসেবে সুন্দরবনের মর্যাদা তাঁর কাছে ‘মাতৃতুল্য’। তিনি বলেন, এই জীবনে যা কিছু যতটুকু পেয়েছেন, তা সুন্দরবনই তাঁকে দিয়েছে।

পাঁচ মেয়ে ও এক ছেলের বিয়ে দিয়েছেন দেবেন মণ্ডল। স্ত্রী, ছেলে আর পুত্রবধূ নিয়ে এখন তাঁর সংসার। আলাপের শুরুতে একটি বাঘের মুখ থেকে এক অপরিচিত যুবকের লাশ কেড়ে আনার গল্প বললেন তিনি।

এই দোকানের সামনে বসেই কথা হয় দেবেন মণ্ডলের সঙ্গে
ছবি: প্রথম আলো

‘বাঘটি সরছিল না’

দেবেন মণ্ডলের বাবা গৃহস্থালির কাজ করতেন। আর তিনি নিজে কাঠুরে হিসেবে জীবিকা শুরু করেন ২৫ বছর বয়সে। তখন বিবাহিত ছিলেন। তিনি বললেন, ২৫-৩০ জনের দল নিয়ে কাঠ কাটতে যেতেন। দলের নেতা ছিলেন তিনি। ৩৫ বছর বয়সে একবার বনে কাঠ কাটতে যান তিনি। দলে ছিলেন ৭ জন। একই সময়ে দুটি নৌকায় করে আরও দুটি দল এসেছিল।

দেবেন মণ্ডল বলেন, বেলা তিনটার দিকে বন থেকে কাঠ নিয়ে নৌকার কাছে আসেন। দেখেন, অন্য একটি নৌকার কাঠুরেরা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছেন। দেবেন মণ্ডলের দলটির কাছে এসে তাঁরা বলেন, তাঁদের দলের এক কাঠুরেকে বাঘ টেনে নিয়ে গেছে। টেনে নেওয়া কাঠুরেকে বাঘ এতক্ষণে মেরে ফেলেছে, তা নিশ্চিত। কিন্তু তাঁর লাশ ফেলে তাঁরা কীভাবে চলে যাবেন! পরিবারটির জন্য শেষ চিহ্ন হিসেবে লাশ তো নেওয়া দরকার। লাশ উদ্ধারে দেবেন মণ্ডলরা কোনো সাহায্য করতে পারেন কি না?

তখন দেবেন মণ্ডল বলেছিলেন, বাঘ সামনে দেখার পর যদি দলের কেউ পিছু না হটেন, তাহলে তিনি চেষ্টা করতে রাজি আছেন। সবাই সম্মতি জানানোর পর তাঁরা অগ্রসর হন। সবাইকে বলা হলো, ‘হইহই’ শব্দ করে ‘জাকদ’ (চিৎকার) দিতে। তাঁরা সুন্দরীগাছের পাতায় বাড়ি দিয়ে শব্দ করতে করতে এগোচ্ছিলেন, যাতে বাঘ ভয় পেয়ে লাশ ছেড়ে পালায়। মাটিতে পায়ের ছাপ দেখে দেবেন নিশ্চিত হয়েছিলেন, বাঘ দক্ষিণ দিকে গেছে। কিছুটা এগোতে রক্ত, গাছের গোড়ায় আটকে থাকা গেঞ্জির অংশ দেখে নিশ্চিত হন, ঠিক পথেই এগোচ্ছেন। আরও কিছুটা এগোতে দেখতে পান, বাঘটি লাশ খাচ্ছে। শব্দ পেয়ে বাঘটি তাকায়। তিনি ‘মন্তর’ পড়া শুরু করেন।

বাড়ি খেয়ে বাঘ আমাকে ছাড়ি দিল। আমাকে ওরা নৌকায় করে আনল। গ্রাম্য ডাক্তার অশোক বৈদ্য ট্রিটমেন্ট (চিকিৎসা) দিল। ঘাড়-গলা ভাগ হয়ে গেছিল। চোখ ঝুলে গেছিল। ৫১টা সেলাই লাগছিল। মুখ বাঁকা হয়ে গেছিল।
দেবেন মণ্ডল

কী মন্ত্র পড়েছিলেন, কেন পড়েছিলেন—এই প্রশ্নে দেবেন মণ্ডল বলেন, ‘চাখান, খিলান বহু মন্তর আছে। মন্তর না পড়লে তো বাঘ উঠবে না। আমি মন্তর পড়ি, বাঘ একবার উঠে, আবার বইসে যায়। আমার গা দিয়ে পানি পড়ছিল (ঘাম)। তিনবারের বার বাঘ লাশ ছেড়ে চলে গেল।’

লাশের কাছে যাওয়ার পর দলের অন্যদের সতর্ক করেছিলেন বলে জানান দেবেন মণ্ডল। বলেছিলেন, ‘বাঘ কিন্তু বেশি দূর যাবে না। লাশ বেঁধে (কাঠের তক্তার সঙ্গে) তোমরা সামনে যেতে থাকো (নদীর দিকে)। আমরা কয়েকজন পিছন ফিরি (বনের দিকে মুখ করে) হাঁটব।’

লাশ নিয়ে বারবার পেছন ফিরে ‘হইহই’ শব্দ করে হাঁটছিলেন বলে জানান দেবেন মণ্ডল। সেই সময়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে দেবেন বলেন, লাশ নৌকায় তোলা হয়েছে, এই সংকেত পেয়ে তাঁরা নৌকার দিকে ছুটতে ছুটতে দেখলেন, মুখের গ্রাস হারিয়ে ক্ষুধার্ত বাঘটি তাঁদের দিকেই আসছে। তাঁরা নৌকায় ওঠার পর বাঘটি পিছু পিছু নদীতে নেমে এসেছিল। কিন্তু গলাপানি অবধি এসে বাঘটি থেমে যেতে বাধ্য হয়। বাঘটি তাকিয়ে ছিল তাঁদের নৌকার দিকে।

‘বাঘের কবলে’

সুন্দরবনে কয়বার বাঘ দেখেছেন—এ প্রশ্নের উত্তরে দেবেন মণ্ডল বললেন, ‘চারবার।’

সরু রাস্তার ওপারে একটি গাছ দেখিয়ে দেবেন মণ্ডল বললেন, একবার এতটুকু দূরত্বে একটি বাঘ দেখেছিলেন তিনি। শেষবার তিনি নিজে বাঘের হামলার শিকার হয়েছিলেন। মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন। সেই ভয় এখনো তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তার পর থেকে তিনি আর বনে যান না।

দেবেন মণ্ডল যখন তাঁর বাঘের কবলে পড়ার গল্প শুরু করলেন, তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে অন্ধকার নেমে এসেছে। দোকান ঘিরে বেশ জটলা। সবাই গল্প শুনতে আগ্রহী।

বাংলা-ইংরেজি সাল-তারিখের মিশেলে সময়কাল ধরে বাঘের কবলে পড়ার গল্প বলতে থাকেন দেবেন মণ্ডল: তখন তাঁর বয়স ৫০ বছর। ২০১১ সালের ডিসেম্বর মাস। দিনটি বাংলা ৬ পৌষ। মঙ্গলবার। বেলা ১১টা।

সকালে বাড়ি থেকে বের হন। উত্তুরে বাতাস। বেশ ঠান্ডা, কুয়াশা। এখন বনের যে প্রান্তগুলো ঘেঁষে ইকো রিসোর্ট তৈরি হয়েছে, সেই বরাবর কুলতলীর খালের ভেতরে নৌকায় দলবল নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। খালের ভেতর দুই দিকে দুটি বাঁক। এর মধ্যে ডানদিকের বাঁকে উঠলেন তাঁরা। অন্যদের কাজে লাগিয়ে তিনি একটু ভেতরের দিকে যান।

বেলা ১১টার দিকে ফিরে এসে দেবেন মণ্ডল দেখেন বেশ অনেকখানি কাঠ কাটা হয়ে গেছে। তিনি আরেকটি গাছের গোড়ায় কুড়াল দিয়ে কোপ দিতেই বাঘ তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

দেবেন মণ্ডলের ডান চোখে থাবা মারে বাঘ। সঙ্গে সঙ্গে তিনি মাটিতে পড়ে যান। তাঁর ঘাড়ে কামড় দিয়ে বাঘ তাঁকে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করে। সে সময় তাঁর দলের একজন সর্বশক্তি দিয়ে বাঘের মাথায় কুড়াল দিয়ে আঘাত করেন।

মাছ ও কাঁকড়া ধরতে সুন্দরবনে যেতে নৌকায় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সাজিয়ে রাখছেন জেলেরা। সুন্দরবনের কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশনের সামনের শাকবাড়িয়া নদীর পাড়ে
ফাইল ছবি

ঘটনার বর্ণনা দেওয়ার সময় দেবেন মণ্ডলের চোখে-মুখে ভয়ের ছাপ ফুটে উঠেছিল। তিনি বলেন, ‘বাড়ি খেয়ে বাঘ আমাকে ছাড়ি দিল। আমাকে ওরা নৌকায় করে আনল। গ্রাম্য ডাক্তার অশোক বৈদ্য ট্রিটমেন্ট (চিকিৎসা) দিল। ঘাড়-গলা ভাগ হয়ে গেছিল। চোখ ঝুলে গেছিল। ৫১টা সেলাই লাগছিল। মুখ বাঁকা হয়ে গেছিল।’

তারপর প্রায় দুই মাস ভারতে চিকিৎসা নেন বলে জানান দেবেন মণ্ডল। বলেন, দেশে-বিদেশে চার মাসের চিকিৎসায় তাঁর প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকা খরচ হয়েছিল।

দেবেন মণ্ডল বলেন, বাঘের ঝপ করে লাফ দেওয়ার শব্দটা এখনো তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায়। একদিন একটা গুইসাপ গাছ থেকে লাফিয়ে পড়েছিল। তিনি আঁতকে উঠেছিলেন। নিজে বাঘের কবলে পড়ার পর থেকে তিনি আর বনে যান না।

দেবেন মণ্ডল বলেন, ‘ওই সাবজেক্ট (প্রসঙ্গ) বাদ। সেই থেকে জঙ্গলে যাই না। গান-বাদ্য করি।’

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ২৫ বছর ধরে কেন সুন্দরবনে গিয়েছিলেন, জানতে চাইলে দেবেন মণ্ডল বলেন, বনের কাজে দ্বিগুণ আয়। ভালো খাওয়া-পরার জন্যই বনে যেতেন তিনি।

২০০৭ সাল থেকে সুন্দরবনে সব ধরনের কাঠ সংগ্রহ নিষিদ্ধ। তবে এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে গোপনে অবৈধভাবে কাঠ সংগ্রহের অভিযোগ আছে। এ বিষয়ে খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো আজ প্রথম আলোকে বলেন, এখন সুন্দরবন থেকে অবৈধভাবে কাঠ সংগ্রহ বলতে গেলে শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। কেউ এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে তাঁরা আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন।

আরও পড়ুন

দেবেন মণ্ডল তাঁর ছেলেকে বনজীবী বানাননি। তিনি বলেন, ‘ছেলে রিসোর্টে কাজ করে। ওকে পড়াশোনা শিখাইছি। ওদিক (বনে) দিতাম না। জমি নাই, জমা নাই। জঙ্গলে খাটিয়া মানুষ করেছি।’

নিজের জীবনে যা ঘটেছে, তাকে ‘ভাগ্যের লিখন’ বলে বিশ্বাস করেন দেবেন মণ্ডল। তিনি বলেন, ২৫ বছর বয়সে তাঁকে এক জ্যোতিষী বলেছিলেন, ৫০ বছর বয়সে দন্তাঘাতে তাঁর মৃত্যু হবে। জ্যোতিষীর এই ভবিষ্যদ্বাণী তিনি বিশ্বাস করেছিলেন। সাপ বা বাঘের কামড়ে তাঁর মৃত্যু লেখা ভেবে ভাগ্যের হাতে নিজেকে সঁপেছিলেন।

সুন্দরবনের ভেতরে যাওয়া ছাড়লেও বন নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই দেবেন মণ্ডলের। তাঁর ভাষায়, ‘আমার পরিবার জঙ্গলের পরেই বাঁচিয়াছি’ (জঙ্গলই তাঁর পরিবারকে বাঁচিয়ে রেখেছে)। তাই সুন্দরবনের গুণকীর্তন করে কণ্ঠে গান তোলেন দেবেন মণ্ডল, ‘গাছে গাছে নানান পাখি দেখিতে যে পাই/বাঘ, হরিণ, জাতিসর্প রয়েছে সেথায়। হায় রে সুন্দরবন/সে যে মায়েরই মতন...।’