মুক্তিযুদ্ধে মায়েদের সাহসিকতার গল্প বললেন সন্তানেরা
মা গায়ে একটি চাদর পেঁচিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তুমি কোথায় যাচ্ছ, আমি জানি না। পেছন ফিরে তাকাবে না। তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে হাসরের ময়দানে।’ নিজের সাহসী মা আমিনা বিল্লাহর কথাগুলো বলতে গিয়ে কান্না আটকাতে পারেননি বীর মুক্তিযোদ্ধা সাংস্কৃতিক কর্মী মিনু হক। অনুষ্ঠানস্থলে তখন অনেকের চোখেই জল। কারণ, তাঁদেরও মায়ের গল্পগুলো প্রায় একই রকম। যে মায়েরা ছেলেমেয়েদের যুদ্ধে পাঠিয়ে বলেছিলেন, ‘দেশ স্বাধীন না হলে ফিরবি না।’
যে মায়েরা মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র–গ্রেনেড লুকিয়ে রেখেছেন, লাল–সবুজ পতাকা বানিয়েছেন, রেশন আর ওষুধ সংগ্রহ করে বিতরণ করেছেন, আশ্রয় দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা আর মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া পরিবারগুলোকে, পাকিস্তানি সৈন্যের পেছন পেছন দৌড়ে ছিনিয়ে এনেছেন কিশোর সন্তানকে, সেই মায়েরাই মুক্তিযুদ্ধের পর পুনর্বাসনের কাজেও সক্রিয় হয়েছেন।
শনিবার বিকেলে ‘মুক্তিযুদ্ধে মায়েদের ভূমিকা’ শিরোনামের আলোচনা অনুষ্ঠানে মায়েদের ভূমিকার কথা গর্বভরে বলেছেন সন্তানেরা। রাজধানীর কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউয়ে অবস্থিত ডেইলি স্টার সেন্টারে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী প্রধান শাহীন আনাম ও সুহৃদরা। অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধে মায়েদের অসাধারণ অবদানকে উদ্যাপন ও সম্মান জানানো। যাঁদের নিঃস্বার্থ সমর্থন ও ত্যাগ ছাড়া স্বাধীনতার সংগ্রাম সফলতা পেত না।
মিনু হক বলেন, তাঁর মা তাঁকে পাঠিয়েছিলেন যুদ্ধে। এমন অনেক মা তাঁর ছেলেমেয়েদের মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে শাহীন আনাম বলেন, মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের অনেক গল্প অগোচরে রয়ে গেছে। অনেক মায়ের ছোট ছোট সহযোগিতা, সাহসিকতার গল্প লোকে জানে না। ছেলের কোমরে মুড়ির পোঁটলা বেঁধে দিয়ে মা বলেছিলেন, ‘দেশ স্বাধীন না হলে ফিরবি না।’ সেই ছেলে মুক্তিযোদ্ধা হলেন। সেই মা কী হলেন?
শাহীন আনাম ও তাঁর ছোট ভাই রিজওয়ান বিন ফারুক তাঁদের মা মুসলেহা ইসলামের ভূমিকার কথা বলে জানান, তাঁদের এক ভাই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। তাঁদের ধানমন্ডির বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্র, গ্রেনেড লুকিয়ে রাখা হতো। আবেগাপ্লুত কণ্ঠে রিজওয়ান বিন ফারুক বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ছিল ১৫ বছর। একদিন ভোরে তাঁকে ঘুম থেকে তুলে পাকিস্তানি সৈন্যরা গাড়িতে তুলতে যাচ্ছিল। ওই সময় মা পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছ থেকে তাঁকে ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হন।
নারীর মুক্তিসংগ্রাম ও সামাজিক আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, জননী সাহসিকা কবি সুফিয়া কামালের দুই মেয়ে সুলতানা কামাল ও সাঈদা কামাল মায়ের কথা স্মরণ করেন গর্বভরে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেন, তাঁদের ধানমন্ডির বাড়িটির (সাঁঝের মায়া) দিকে সব সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নজরদারি রাখত। মা বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের আগে, মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং মুক্তিযুদ্ধের পর পুনর্বাসনকাজে তিনি সক্রিয় ছিলেন।
সাঈদা কামাল বলেন, তাঁদের দুই বোনকে যুদ্ধে পাঠিয়ে মা বলেছিলেন, ‘দেশের কাজে যেন লাগতে পারো।’ মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় মা অক্লান্তভাবে কাজ করতেন। রেশনের খাবার, ওষুধ জমিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য পাঠাতেন।
নারীপক্ষের সদস্য ও অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন হক তাঁর মা কবি জাহেদা খানমের কথা বলতে গিয়ে বলেন, ২৫ মার্চ কালরাতের পর ২৬ মার্চ তাঁদের বাড়িতে স্রোতের মতো মানুষ আশ্রয় নিতে এলেন। মা প্রত্যেককে জায়গা দিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন। বিপদের মুখে পড়া অবাঙালিদের আশ্রয় দিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র তাঁদের বাড়ির টয়লেটে লুকিয়ে রাখা হতো।
নৃত্যশিল্পী লুবনা মারিয়াম বলেন, বাবা মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ৭ নম্বর সেক্টর কমান্ডার বীর উত্তম কাজী নুরুজ্জামানের লেখা থেকে তিনি জেনেছেন, একটি এলাকা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা যাওয়ার আগে রেকি করে নিচ্ছিলেন নিরাপত্তার বিষয়ে। এক লোককে জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘না এখানে কোনো পাক সেনা (পাকিস্তানি সৈন্য) নেই।’ ঠিক ওই সময় ঘর থেকে এক মা বেরিয়ে এসে বললেন, ‘আমার স্বামী মিথ্যা কথা বলছে।’ ওই মায়ের পরে কী হয়েছিল তা জানা যায়নি। কোমরে মুড়ির পোঁটলা বেঁধে যুদ্ধে অংশ নেওয়া ১৫–১৬ বছরের ছেলেদের জিজ্ঞেস করলে তারা বলত, ‘মা পাঠিয়েছে।’ লুবনা মারিয়াম বলেন, তাঁর মা অধ্যাপক ইমেরিটাস সুলতানা জামানও ছিলেন ঠিক ওই মায়েদের মতো। তাঁর মা ১৫ বছরের কিশোর সন্তানকে নিজেই যুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন।
প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক সুমনা শারমীন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্যাতনের শিকার নারীদের পুনর্বাসনে কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে পুনর্বাসন কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়। কেন্দ্রটির পরিচালক হিসেবে তাঁর মা মালেকা খান সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা নারীদের পুনর্বাসনে কাজ করেছেন। তাঁদের মানসিক আঘাত দূর করার জন্য সপ্তাহে সপ্তাহে বাড়িতে এনে ঘরের স্বাভাবিক পরিবেশ দেওয়ার চেষ্টা করতেন। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ভাইকে (সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আতিকুর রহমান) খোঁজার লড়াই করছিলেন। ভাইকে খোঁজার তাঁর ওই লড়াইয়ের কারণে কুমিল্লা সেনানিবাসে মাটিতে গভীর গর্ত করে অনেক কর্মকর্তার লাশ পুঁতে রাখার ঘটনা প্রকাশ পায়।
শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. মোহাম্মদ শফী ও মুশতারী শফীর সন্তান শিক্ষক রুমানা শফী জানান তাঁদের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় নেওয়া, যুদ্ধের পরিকল্পনা নেওয়া এবং অস্ত্র লুকিয়ে রাখার কথা। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করার অভিযোগে বাবা মোহাম্মদ শফী ও মামা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র খন্দকার এহসানুল হক আনসারীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর তাঁর মা আরও সক্রিয় হন। মা লিখতেন। পাশাপাশি নার্সিংয়ের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধাহত ব্যক্তিদের সেবায় নিয়োজিত হন।
মা ফাতেমা আলমের কথা স্মরণ করেন মেয়ে রেশমা আমিন ও ছেলে বীর প্রতীক হাবিবুল আলম। তাঁদের মা ছিলেন অকুতোভয়। একবার বাড়িতে শত শত পতাকা বানানোর কাজে হাত দিয়েছিলেন।
বীর প্রতীক হাবিবুল আলম বলেন, ‘যুদ্ধের সময় নারীরা যে নানাভাবে ভূমিকা রেখেছেন, সেসব আলোচনায় আসা দরকার। মায়েরা না থাকলে আমরা যুদ্ধ করতে পারতাম না।’
মা নূরজাহান মুরশিদের কথা বলতে গিয়ে মেয়ে শব্দসৈনিক তাজিন মুরশিদ বলেন, ’৬৯–এর গণ–অভ্যুত্থানেও মা রাস্তায় আন্দোলন করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করার কারণে তাঁর মায়ের বিরুদ্ধে অগ্নিসংযোগ, হত্যার অভিযোগ এনে মামলা করেছিল পাকিস্তান সরকার।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আস্মা নিসার, শহীদ বুদ্ধিজীবীর সন্তান তাহমিনা খান, কলাম লেখক নীমান আহমেদ সোবহান, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম প্রমুখ।