কলকাতায় সংসদ সদস্য খুন
তৃতীয় চেষ্টায় হত্যা, লাশ পাওয়া যায়নি ১৩ দিনেও
কলকাতার খালে জাল ফেলে তৃতীয় দিনের মতো তল্লাশি। লাশ পাওয়া নিয়ে স্থানীয়দের সংশয়। কলকাতা যাচ্ছে ডিবির তিন সদস্যের দল।
সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমকে (আনার) এর আগে দুবার খুনের পরিকল্পনা করা হয়। তৃতীয়বারের চেষ্টায় সফল হয় খুনিরা। খুনের আগে আনোয়ারুলকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ডেকে নেওয়া হয় কলকাতার সঞ্জিভা গার্ডেন্সে। সেখানে তাঁর ওপর চেতনানাশক ক্লোরোফর্ম ব্যবহার করা হয়।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে। খুনের ঘটনায় আট দিনের রিমান্ডে থাকা তিন আসামিকে লাশ গুমসহ নানা বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ডিবি। তবে গতকাল শনিবার রাত পর্যন্ত লাশের কোনো অংশ উদ্ধার হয়নি। মরদেহ বা মরদেহের কোনো অংশ পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
অপর দিকে কলকাতায় সিআইডির হেফাজতে থাকা জিহাদ হাওলাদারের দেওয়া তথ্যে শুক্রবার জিরানগাছা বাগজোলা খালে ডুবুরি নামিয়ে তল্লাশি করা হয়। তবে লাশের কোনো চিহ্নও পাওয়া না যাওয়ায় গতকাল জাল ফেলে আবার তল্লাশি করা হয়।
ঘটনা তদন্তে ঢাকায় আসা ভারতের ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর (আইবি) চার সদস্য গতকালও মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে তদন্ত–সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এদিকে ঢাকা থেকে ডিবি পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনারের নেতৃত্বে পুলিশের তিন সদস্যের একটি দল ঘটনা তদন্তে কলকাতায় যাচ্ছে। লাশ উদ্ধার এবং বাংলাদেশে গ্রেপ্তার আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য নিয়ে সেখানকার পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলবে। তবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের ওয়ারী বিভাগের সহকারী কমিশনার মাহফুজুর রহমান এই দলে নেই বলে জানা গেছে।
আট দিনের রিমান্ডে থাকা আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে ডিবি জানতে পেরেছে, আনোয়ারুলকে মিথ্যা কথা বলে ওই ফ্ল্যাটে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু তিনি সেখানে পৌঁছার আগেই হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান ভারত ছেড়ে পালিয়ে যান। যাওয়ার আগে হত্যার চূড়ান্ত পরিকল্পনা করেন তিনি। খুনিদের প্রাথমিক চিন্তা ছিল, দুদিন ফ্ল্যাটে আটকে রেখে ‘ব্ল্যাকমেল’ করে ভারতে থাকা আনোয়ারুলের বন্ধু বা দেশে পরিবারের কাছ থেকে কিছু টাকা আদায় করা।
ডিবির দাবি, খুনের আগে চেতনানাশক ক্লোরোফর্ম প্রয়োগ করে আনোয়ারুলের সঙ্গে এক নারীর আপত্তিকর ছবিও তোলা হয়। চেতনানাশক প্রয়োগের পর জ্ঞান না ফেরায় খুনিরা টাকা আদায়ের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে তাঁকে হত্যা করে। এরপর লাশ টুকরা টুকরা করে দূরে কোথাও ফেলে দেওয়া হয়। পরে সবাইকে বিভ্রান্ত করতে সংসদ সদস্যের ব্যবহার করা চারটি মুঠোফোন নিয়ে বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে থাকে খুনিরা। যাতে মুঠোফোনের অবস্থান দেখে খুনের ঘটনাস্থল চিহ্নিত করা না যায়।
আনোয়ারুল আজীমকে হত্যার জন্য আগেও দুবার পরিকল্পনা হয় বলে জানান ঢাকা মহানগর ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন–অর–রশীদ। গতকাল তিনি সাংবাদিকদের বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশেই তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা হয়েছিল। তখন তারা ব্যর্থ হয়। দ্বিতীয়বার পরিকল্পনা হয় কলকাতায়। গত ১৭ ও ১৮ জানুয়ারি আনোয়ারুল কলাকাতায় ছিলেন। সেই সময় হত্যাকারীরা তাঁকে খুনের উদ্দেশ্যে কলকাতায় যায়। কিন্তু হোটেলে থাকার কারণে সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। তৃতীয় ধাপে তারা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারে।
এই হত্যার পেছনে ব্যক্তিগত শত্রুতা, টাকাপয়সা লেনদেন ও রাজনৈতিক বিষয় থাকতে পারে বলে মনে করছেন ডিবিপ্রধান। খুনের পেছনে স্বর্ণ চোরাচালান চক্রের কোনো সম্পৃক্ততা আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, নির্দিষ্ট করে কোনো কিছুই বলা যাবে না। তবে অনেকগুলো বিষয় আছে।
ঝিনাইদহ–৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম ১২ মে দর্শনা সীমান্ত হয়ে কলকাতায় যান। পরদিন কলকাতার নিউ টাউনের সঞ্জিভা গার্ডেন্সের একটি ফ্ল্যাটে তিনি খুন হন। ২২ মে তাঁর খুন হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে দুই দেশের পুলিশ। এ ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান ওরফে শাহীন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। তিনি খুনের পর নেপালের কাঠমান্ডু হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যান বলে পুলিশ বলছে। আরেক অভিযুক্ত সিয়ামের অবস্থানও নেপালে। তাঁকে ধরতে দুই দেশের পুলিশ কাজ করছে।
খালে জাল ফেলে তল্লাশি
আনোয়ারুল আজীমের লাশের সন্ধানে বৃহস্পতিবার থেকে অভিযান চালাচ্ছে কলকাতার পুলিশ। ভারতে গ্রেপ্তার ‘কসাই’ জিহাদ হাওলাদারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ভাঙরের বাগজোলা খালে অভিযান চালানো হয়। শুক্রবার ডুবুরি নামিয়ে এবং ড্রোন উড়িয়েও লাশের কোনো অংশ উদ্ধার করা যায়নি। এ জন্য শনিবার আবার অভিযান শুরু হয়।
প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি জানান, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তত্ত্বাবধানে খালটিতে সেখানকার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের কর্মীরা জাল ফেলে তল্লাশি করেছেন। স্থানীয় জেলেদেরও তল্লাশি অভিযানে সম্পৃক্ত করা হয়।
তবে স্থানীয় লোকজন জানান, জিরানগাছা বাগজোলা খালে পানির স্রোত রয়েছে। তা ছাড়া সেখানে শিয়াল ও কুকুরের উৎপাত রয়েছে। এ জন্য মাছ বা মাংসের উচ্ছিষ্ট ফেললেও কিছুক্ষণ পর আর তা পাওয়া যায় না। ফলে সংসদ সদস্যের লাশের টুকরা সেখানে ফেললেও খুঁজে পাওয়া কঠিন।
খুনিদের শাস্তি দাবি
প্রথম আলোর ঝিনাইদহের নিজস্ব প্রতিবেদক জানিয়েছেন, আনোয়ারুল আজীম হত্যার ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি ও মৃতদেহ শনাক্তের দাবিতে কালীগঞ্জ শহরে তাঁর বাড়ির সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালিত হয়। গতকাল বেলা ১১টা থেকে ১২টা পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা।
এদিকে গতকাল আনোয়ারুলের কন্যা মুমতারিন ফেরদৌসের (ডরিন) সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিমসহ (মিন্টু) অন্য নেতা–কর্মীরা।
মুমতারিন ফেরদৌস বলেন, হত্যার পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান শাহীনকে গ্রেপ্তার করে দ্রুত আইনের আওতায় আনা হোক। তাঁর পরিবারের সদস্যদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হোক। তাহলে হয়তো অনেক তথ্য বেরিয়ে আসবে।