ক্ষমতাচ্যুৎ শেখ হাসিনা সরকারের ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী (জাভেদ) শুধু যুক্তরাজ্যেই ৩৬০টি বাড়ির মালিক। এর বেশির ভাগই বার্কলি গ্রুপের মতো শীর্ষস্থানীয় নির্মাতা প্রতিষ্ঠান থেকে কেনা। বাড়িগুলোর বর্তমান বাজারমূল্য ৩২ কোটি ডলার। বাংলাদেশি টাকায় এই অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ হাজার ৮২৪ কোটি টাকার বেশি। এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্র ও দুবাইয়েও তাঁর সম্পদ রয়েছে।
কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক সম্প্রচারমাধ্যম আল–জাজিরার এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। আজ বুধবার রাতে ‘দ্য মিনিস্টার্স মিলিয়নস’ শিরোনামের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে আল–জাজিরা। অনুসন্ধান করেছে আল–জাজিরার অনুসন্ধানী দল ‘আই ইউনিট’।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান লন্ডনের বাইরে দুবাইয়ে ২০২০ সালের মধ্যে অন্তত ৫৪টি সম্পদের মালিক হন। যুক্তরাষ্ট্রেও তাঁর সম্পত্তি আছে। সেখানে তিনি নয়টি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন। এর মধ্যে পাঁচটি ম্যানহাটানসহ নিউইয়র্কের প্রধান এলাকায় এবং চারটি নদীর ওপারে নিউ জার্সিতে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সাইফুজ্জামান দেশের বাইরের এত পরিমাণ সম্পদ তাঁর নির্বাচনী হলফনামা ও ট্যাক্স ফাইলে গোপন করেছেন।
আল–জাজিরা অনুসন্ধান বলছে, লন্ডনে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর হয়ে সব সম্পদ দেখাশোনা করেন চট্টগ্রামের রিপন মাহমুদ। সাইফুজ্জামান সিঙ্গাপুরের ব্যাংক ডিবিএস থেকে ঋণ নিয়েছেন। ওই ব্যাংকের কর্মী রাহুল মার্টের বর্ণনায়ও সাইফুজ্জামানের সম্পদের বর্ণনা উঠে এসেছে। কীভাবে তিনি বিদেশে এত সম্পদ গড়েছেন, সেই ধারণাও পাওয়া গেছে।
এ ছাড়া সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বর্ণনায়ও তাঁর সম্পদ ও ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেছে। শেখ হাসিনা দেশের বাইরে তাঁর ব্যবসার কথা জানতেন উল্লেখ করে সাইফুজ্জামান আল-জাজিরার অনুসন্ধানী দলকে বলেছেন, ‘আমার এখানে ব্যবসা আছে, সেটা তিনি জানতেন।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, সাইফুজ্জামান ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার খুবই কাছের ও বিশ্বস্ত। তিনি ২০১৪ সালে সংসদ সদস্য ও প্রতিমন্ত্রী হন। ২০১৯ সালে শেখ হাসিনা তাঁকে পদোন্নতি দিয়ে ভূমিমন্ত্রী করেন। সাইফুজ্জামানও আল–জাজিরাকে বলেছেন, ‘আমার বাবা প্রধানমন্ত্রীর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সত্যি বলতে আমিও।’
আল–জাজিরার অনুসন্ধানী দলের কাছে বাংলাদেশের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান তাঁর বিলাসী জীবনের গল্পও করেছেন। সেখানে নিজের জুতার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা টেইলর-মেডের জুতা। আমি হেরডসেও কাস্টম মেড (নির্দিষ্ট গ্রাহকের জন্য বিশেষভাবে তৈরি) জুতা অর্ডার দিয়েছি। এটি তৈরি হতে চার মাস সময় লাগে। আমি কিনেছি প্রতিটি তিন হাজার পাউন্ডের বেশি দিয়ে।’
এই বিশেষ জুতা তৈরির বিষয়ে সাইফুজ্জামান বলেন, এগুলো উটপাখি ও কুমিরের বুকের চামড়া দিয়ে তৈরি জুতা। সম্পূর্ণ বুকের চামড়া দিয়ে তৈরি জুতাগুলোর দাম ছয় হাজার পাউন্ড। আর অর্ধেক কুমিরের বুকের চামড়া ও বাছুরের চামড়ার অর্ধেক দিয়ে তৈরি জুতার দাম তিন হাজার পাউন্ড। এটা খুবই ভালো। চার মাস লাগে তৈরি হতে।
স্যুট পছন্দ করেন জানিয়ে সাইফুজ্জামান বলেন, প্রতিবার তিনি লন্ডনে গেলে ‘সুপার ২০০’ স্যুট কেনেন। এ ধরনের স্যুটের দাম ছয় থেকে আট হাজার পাউন্ড। কেনালি বন্ড স্ট্রিটে গিয়ে কেনেন তিনি। এরপর তারাই বাসায় পৌঁছে দেয়।
চমকে ওঠার মতো সম্পদের সন্ধান
আল–জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগে থেকে সাইফুজ্জামান চৌধুরীকে অনুসরণ করছিল তাদের অনুসন্ধানী দল। তাঁর বেতন (বার্ষিক) ছিল ১৩ হাজার ডলার। অথচ তিনি যুক্তরাজ্যে বিপুল সম্পদের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। আই ইউনিট মন্ত্রীর বৈশ্বিক সম্পদের অনুসন্ধানে নেমে চমকে ওঠার মতো সম্পদের সন্ধান পায়। বাংলাদেশে সাইফুজ্জামানের সম্পদের উৎস তাঁর ব্যবসা ও ইউসিবি ব্যাংকের শেয়ার।
বাংলাদেশর মুদ্রানীতি অনুযায়ী, দেশের নাগরিকেরা বছরে ১২ হাজার ডলারের বেশি বিদেশে নিতে পারেন না। এই মুদ্রানীতি হয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতির সুরক্ষার জন্য।
বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ‘আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যপকহারে কমে গেছে। কেউ বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া বিদেশে টাকা নিয়ে গেলে সেটা মানি লন্ডারিং আইনে অপরাধ।’
লন্ডনে বাড়িগুলো তৈরির বিষয়ে আল–জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, সাইফুজ্জামান ডেভেলপারদের কাছ থেকে বাড়ি কেনার জন্য বেশ কিছু কোম্পানি তৈরি করেন। ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে তিনি যুক্তরাজ্যে ২৬৫টি বাড়ি কেনেন। তাঁর বাড়িগুলোর বেশির ভাগই বার্কলি গ্রুপের মতো শীর্ষ ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কেনা।
সাইফুজ্জামানের কেনাকাটা সেখানেই থেমে থাকেনি। ২০২১ সালে ১ কোটি ৬০ লাখ ডলারে লন্ডনে আরও সম্পদ কেনেন তিনি। তাঁর বেশির ভাগ সম্পদই ভাড়া দিয়ে থাকেন। ২০২০ সালে আরও ৮৯টি বাড়ি কিনলে মোট বাড়ির সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬০টি, যার বাজারমূল্য ৩২ কোটি ডলার।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজনৈতিকভাবে পরিচিত ব্যক্তিদের যুক্তরাজ্যে কঠোর যাচাইয়ের মুখোমুখি হওয়ার কথা। সেখানে সাইফুজ্জামান চৌধুরী কীভাবে এই যাচাইপ্রক্রিয়া অতিক্রম করেছিলেন, তা যাচাইয়ে তার একটি সম্পত্তি দেখতে যায় আল–জাজিরার অনুসন্ধানী দল।
সেখানে রিপন মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের গ্রাহকের (সাইফুজ্জামানের) লন্ডনে ৩০০টি বাড়ি আছে। তিনি লন্ডনে আসেন, কয়েকটি বাড়ি কেনেন, আবার চলে যান। লকডাউনের সময় যুক্তরাজ্যে নতুন বাড়ি কেনার জন্য ২০ কোটি পাউন্ড ব্যয় করেন তিনি।’
এই রিপন মাহমুদ সম্পর্কে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বক্তব্য হলো—লন্ডন ও যুক্তরাজ্যের সব সম্পত্তি রিপনের মাধ্যমেই তিনি কিনেছেন। রিপন তাঁর প্রধান লোক। তিনি তাঁর ভাই।
যেভাবে দেখা করেন আল–জাজিরার সাংবাদিকেরা
আল–জাজিরার অনুসন্ধানী দলের সদস্যরা চীন থেকে ১০ কোটি ডলার যুক্তরাজ্যের বাজারে স্থানান্তর করতে চান, এ কথা বলে প্রকাশ করে সাইফুজ্জামানের ঘনিষ্ঠ রিপনের সঙ্গে কথা এগোতে থাকেন। তাঁরা ধনী বিদেশি বিনিয়োগকারী হিসেবে অভিনয় করে সাইফুজ্জামানের সম্পদের গোপন তথ্য বের করেন।
লন্ডনের একটি হোটেলে রিপন আল–জাজিরার অনুসন্ধানী দলের সঙ্গে দেখা করতে যান। সেখানে আলাপচারিতায় তাঁর বিষয়ে বোঝানোর জন্য সাইফুজ্জামান চৌধুরীর প্রসঙ্গ টানেন। তখন রিপন বলেন, ‘আমার ভালো বন্ধু সাইফুজ্জামান। আপনি যেটা আমার কাছে চাচ্ছেন, সেটাই আমি তাঁর (সাইফুজ্জামান) জন্য করেছি।’ তাঁর পরিচয় সম্পর্কে রিপন বলেন, ‘তিনি একজন ক্ষমতাধর মন্ত্রী। তিনি বুদ্ধিমান। তিনি বড় প্রকল্পে যান না। যখন আপনি বড় প্রকল্পে যান, কর্তৃপক্ষ সতর্ক হয়ে যায়। বড় টাকা, বড় সংখ্যা সবাইকে সতর্ক করে দেয়। আপনি বুঝতেই পারছেন কী বলছি। তিনি এক কোটি আনেন এবং বলেন, আমি নগদে কিনিনি। ব্যাংক আমাকে টাকা দিয়েছে।’
লন্ডনে অনুসন্ধানের মধ্যেই আল–জাজিরা জানতে পারে, যুক্তরাষ্ট্রেও সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সম্পত্তি আছে। সেখানে তিনি নয়টি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন। পাঁচটি ম্যানহাটানসহ নিউইয়র্কের প্রধান এলাকায় এবং চারটি নদীর ওপারে নিউ জার্সিতে।
আরও কয়েক দফা সাক্ষাতের পর রিপন স্বীকার করেন, তাঁর সবচেয়ে বড় গ্রাহক সাইফুজ্জামান চৌধুরী। তিনি বাংলাদেশ থেকে আসছেন। চার বছর আগে তাঁর জন্য সবকিছু ঠিক করেছেন। প্রতিবছর তিনি (সাইফুজ্জামান) তাঁর মাধ্যমে ১০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করেন।
সাইফুজ্জামান চৌধুরী বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার আগে তাঁর সঙ্গে দেখা করে আল–জাজিরার অনুসন্ধানী দল। তার আগে রিপনের পরামর্শে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর পরামর্শকদের সঙ্গে দেখা করে। প্রথমেই সাইফুজ্জামানের আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করে অনুসন্ধানী দল। ওই আইনজীবী একটি কোম্পানির মানি লন্ডারিং রিপোর্টিং কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন। যার কাজ হচ্ছে কোম্পানি পরিচালনায় যুক্তরাজ্যের নিয়ম–নীতি মেনে চলাটা নিশ্চিত করা। ২০২১ সাল থেকে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর প্রতিষ্ঠানের ১০০টির বেশি ঋণের আইনি কাজগুলো করেছেন তিনি।
এরপর রিপন পরিচয় করিয়ে দেন এশিয়ার বৃহত্তম ব্যাংক ডিবিএসের রাহুল মার্টের সঙ্গে, যিনি ব্যক্তিগত সম্পদ ব্যবস্থাপকদের একজন। রিপন বলেন, সাইফুজ্জামান চৌধুরীকে ব্যাংকের গ্রাহক করতে গিয়ে রাহুল কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছিলেন। সিঙ্গাপুরের ব্যাংকটিতে অত্যন্ত কড়াকড়ি থাকায় তাঁর স্ত্রীকে এর গ্রাহক করা হয়েছিল।
২০২৪ সালের জানুয়ারির মধ্যে ডিবিএস সাইফুজ্জামান চৌধুরীর কোম্পানিগুলোকে ২০টি ঋণ দিয়েছিল, যা তাঁর সাম্রাজ্যকে অর্থায়নে সহায়তা করেছিল। অবশেষে রিপন অনুসন্ধানী দলকে মার্কেট ফাইন্যান্সিয়াল সলিউশনের সিইও পারেশ রাজার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি সাইফুজ্জামানের জন্য শত শত ঋণের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
সাইফুজ্জামান চৌধুরী তাঁর মোট সম্পত্তির এক–চতুর্থাংশ, ৮০টির বেশি যুক্তরাজ্যের শীর্ষ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বার্কলি হোমস থেকে কিনেছেন। বার্কলি হোমসের একটি বিপণন অনুষ্ঠানে আল–জাজিরার একজনকে রিপন বলেন, তাঁর ৩০০–এর বেশি বাড়ি আছে। তিনি দুবাইয়ে এগুলো তাঁর (সাইফুজ্জামান) জন্য কিনেছেন।
দুবাইয়ের সূত্র অনুসরণ করে নতুন আরও অনেক সম্পদের তথ্য পাওয়া যায়। দুবাইয়ে ২০২০ সালের মধ্যে অন্তত ৫৪টি সম্পদের তালিকাভুক্ত মালিক হন সাইফুজ্জামান চৌধুরী।
সাইফুজ্জামান চৌধুরী যা বললেন
এরপর রিপনকে সঙ্গে নিয়ে একদিন সাইফুজ্জামানের সঙ্গে তাঁর লন্ডনের বাড়িতে সাক্ষাৎ করে অনুসন্ধানী দল। সেখানে সাইফুজ্জামান জানান, তিনি ব্যবসা থেকে তাঁর সব লাভ দুবাই ও লন্ডনে বিনিয়োগ করেছেন। তিনি বলেন, ‘দুবাইয়ের ডাউনটাউনে আমি সেরা সম্পত্তি পেয়েছি। দুবাই মলের কাছে অপেরা এলাকায় আমার খুব সুন্দর একটি পেন্ট হাউস আছে। আমি একটি ভিলাও কিনেছি, যার একটায় ব্যক্তিগত হ্রদ আছে। সবকিছু আছে। সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় বাড়ি আছে। ম্যানহাটানে (যুক্তরাষ্ট্র) আমার খুব সুন্দর সম্পত্তি আছে।’
বাংলাদেশ থেকে এত টাকা কীভাবে আনলেন, এ প্রশ্নের জবাবে সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘আমার দুবাইয়ে রিয়েল স্টেট কেনাবেচার ব্যবসা আছে। দুবাই থেকে এখানে টাকা আনি। তারপর এখান থেকে একটা ঋণ নিই।’
আল–জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলোতে লেনদেন স্থগিতের নির্দেশ দিয়েছে। সাইফুজ্জামানের বর্তমান অবস্থান অজানা। তবে বাংলাদেশ ছেড়েছেন বলে সাম্প্রতিক একটি কথোপকথনে তিনি উল্লেখ করেছেন।