ঈদ করতে টাঙ্গাইল থেকে মা-বাবার সঙ্গে ঢাকার মহাখালীতে নানির বাসায় এসেছিল আট বছরের শিশু আহনাফ রাফান। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে তাঁর এই আনন্দভ্রমণ ভরে ওঠে কষ্টে। এক সপ্তাহ হাসপাতালের শয্যায় জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে আসা শিশুটি আজ বৃহস্পতিবার সকালে চিরবিদায় নিয়েছে পৃথিবী থেকে।
সন্তানের লাশ নিয়ে গ্রামে ফিরেছেন আহনাফের মা–বাবা। বিকেলে মুঠোফোনে বাবা মো. মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছেলেটা মঙ্গলবারও হাসপাতালে হাসল, খেলল আর এখন তার জানাজা হবে। বাড়ি ফেরার জন্য ছেলে চিৎকার চেঁচামেচি করল। বাড়ি ফিরেছে, তবে...।’
মনিরুজ্জামান টাঙ্গাইলে ঠিকাদারি করেন। তিনি জানান, নানির বাসায় ঈদ করতে আহনাফ ২৩ জুন ঢাকায় এসেছিল। ২৯ জুন বৃহস্পতিবার ঈদুল আজহার রাতে তার জ্বর আসে। জ্বর ছিল ১০৫ ডিগ্রি। রাত একটায় চিকিৎসকের কাছে নেওয়া হলে তিনি ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে দেন।
শনিবার রক্ত পরীক্ষায় আহনাফের ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। ওই দিনই শ্যামলীতে ঢাকা শিশু হাসপাতালে ভর্তি করা হয় আহনাফকে। কিন্তু বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার জন্য সোমবার শিশু হাসপাতাল থেকে আহনাফকে ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।
মনিরুজ্জামান জানান, মঙ্গলবার আহনাফ বেশ সুস্থ ছিল। সে হেসেছে, খেলেছে, খেয়েছে। বুধবার অবস্থা খারাপ হলে বেলা আড়াইটার দিকে তাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়া হয়। আর আজ সকালে তাঁর মৃত্যু হয়।
মনিরুজ্জামান আগে ঢাকায় একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে কাজ করতেন। পরে টাঙ্গাইলে ফিরে গিয়ে ঠিকাদারি শুরু করেন। মনিরুজ্জামান ও তানজিদা মুমু দম্পতির একমাত্র ছেলে ছিল আহনাফ। একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে তানজিদা মুমু দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
মনিরুজ্জামানেরও আক্ষেপ কমছেই না। ঢাকা শিশু হাসপাতালের বিভিন্ন অব্যবস্থাপনা নিয়ে ক্ষোভ জানালেন তিনি। তাঁর মতে, ছেলেকে এ হাসপাতালে ভর্তি করে সময় নষ্ট না করলে হয়তো ছেলেটা বেঁচে যেত। তিনি বলেন, ‘একটি হাসপাতালের অবস্থা যে এত খারাপ হতে পারে, তা চিন্তাও করতে পারছি না। ১০ থেকে ১২ হাজার টাকার পরীক্ষা করাল, এর বাইরে আমার ছেলের শরীরের কী অবস্থা তা নিয়ে তাদের আর কোনো মাথাব্যথা ছিল না।’
শিশু হাসপাতালে সোমবারও আহনাফের কিছু পরীক্ষা করানো হয় জানিয়ে মনিরুজ্জামান বলেন, ‘আমার ছেলে আগে থেকেই নোংরা সহ্য করতে পারত না। হাসপাতালের নোংরা পরিবেশ দেখে সে বাসায় চলে যেতে চেয়েছিল। এই হাসপাতালে ছেলেকে নেওয়াটাই আমার ভুল ছিল।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এ বছর ডেঙ্গুতে ৬২ জনের মৃত্যু হয়েছে, আক্রান্ত হয়েছেন ১০ হাজার ৪৫৫ জন। দেশে কোনো বছরের জুলাই মাসের শুরুতেই ডেঙ্গুর এমন ভয়াবহ রূপ আর কখনো দেখা যায়নি।
ডেঙ্গুতে প্রতিদিনই কেউ না কেউ প্রাণ হারাচ্ছে। নানা আক্ষেপ, অসন্তোষ ঝরছে স্বজন হারানো ব্যক্তিদের কণ্ঠে। আহনাফের বাবা মনিরুজ্জামান ভাবছেন, ঢাকা শিশু হাসপাতালে না নিলে হয়তো ছেলেটা বেঁচে যেত। আর ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী ইলমা জাহানের বাবা ইকবাল কবির হুট করে মেয়ে মারা যাওয়ার বিষয়কে ‘কপালে ছিল’ বলে সান্ত্বনা খুঁজছেন। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হওয়ার পাঁচ দিনের মধ্যে মারা যায় ইলমা।
আহনাফের মতো তাঁরও জ্বর এসেছিল ঈদুল আজহার দিনে। আদ্-দ্বীন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার সকালে মেয়েটির মৃত্যু হয়।
ছয় দিন ডেঙ্গুতে ভুগে মঙ্গলবার রাতে মারা যায় চট্টগ্রামের পঞ্চম শ্রেণিপড়ুয়া শ্রাবন্তী সরকার। পরিবারের সবার সঙ্গে ঈদের ছুটিতে বেড়াতে ভারতের ত্রিপুরায় গিয়েছিল মেয়েটি। ঈদের দিনই জ্বর আসে তার। বেড়ানো সংক্ষিপ্ত করে শুক্রবারই দেশে ফিরে আসে আটজনের দলটি। এরপর শ্রাবন্তীকে বাঁচাতে পারেনি পরিবার। তাঁর একমাত্র ভাই কলেজপড়ুয়া সৌভিক সরকারও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। মঙ্গলবার মধ্যরাতে শ্রাবন্তীকে শ্মশানে দাহ করে এই ছেলেকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন তাঁর বাবা–মা।
এবার ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ে উদ্বিগ্ন বিশেষজ্ঞরা। শিশুদের বিশেষ যত্ন নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন তাঁরা। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী অভিভাবকদের উদ্দেশে বলেছেন, এবারের ডেঙ্গুকে কোনোভাবেই অবহেলা করার উপায় নেই। জ্বর হলে দ্রুত ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে হবে এবং হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। সময়ক্ষেপণ করা যাবে না। পরীক্ষায় যদি ডেঙ্গু নেগেটিভও আসে, তারপরও চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে এবং তা মেনে চলতে হবে। আর শিশুদের অসুস্থতায় পরিবারের সদস্যরা অধৈর্য হয়ে পড়েন। কোন হাসপাতালে নেবেন, হাসপাতাল বারবার পরিবর্তন করাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে থাকেন যা রোগীর জন্য ততটা ভালো হয় না। তাই ধৈর্য ধরে যে কোনো এক হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে হবে।
ডেঙ্গু এবার আগের চেয়ে ভয়ংকর রূপ নিয়ে এসেছে জানিয়ে এই চিকিৎসক প্রথম আলোকে বলেন, এবারের ডেঙ্গুতে বিশেষ কিছু লক্ষণ দেখা দিচ্ছে। অনেকের শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে, অনেকের প্রচণ্ড ডায়রিয়া হচ্ছে। জ্বর শুরুর পাঁচ দিন এমনকি তিন দিনের দিনও মারা যাচ্ছে অনেকে। দ্বিতীয়বার যাদের ডেঙ্গু হচ্ছে, তাদের অবস্থাও দ্রুত খারাপ হচ্ছে। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে, এই বিষয়গুলো ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সামনে আরও ক্রাইসিস বা সমস্যা বাড়াবে। আর ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আগের যে চিকিৎসাপদ্ধতি তা অনেক ক্ষেত্রে এবার কার্যকর হচ্ছে না। বিষয়টি বুঝতেও সময় লাগছে। কিন্তু ততক্ষণে ডিজাস্টার বা অঘটন তো ঘটেই যাচ্ছে।