সাইবার নিরাপত্তা আইন সংস্কারের কাজ ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। সব স্তরের অংশীজনের অভিমত নিয়েই সংস্কারের কাজটি করা হবে বলে জানিয়েছেন আইসিটি সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী। তবে সাংবাদিক ও এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিদ্যমান আইনটি নিবর্তনমূলক। এটি বাদ নিয়ে নতুন করে জনবান্ধব আইন করতে হবে।
আজ মঙ্গলবার সকালে ব্র্যাক সেন্টার ইনে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন: নিরাপত্তা ও বাক্স্বাধীনতার ভারসাম্য কেমন?’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তাদের আলোচনায় এ কথাগুলো উঠে আসে। টেলিকম অ্যান্ড টেকনোলজি রিপোর্টার্স নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ (টিআরএনবি) এই গোলটেবিলের আয়োজন করে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে আইসিটিসচিব শীষ হায়দার চৌধুরী বলেন, সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রয়োজন, তবে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও বাক্স্বাধীনতাও থাকতে হবে। সংবিধানে বাক্স্বাধীনতা দেওয়া আছে। কিন্তু বিভিন্ন আইন ও বিধিতে তা খর্ব করা হয়েছে। ২০২৩ সালের সাইবার নিরাপত্তা আইনটি ছিল নিবর্তনমূলক। এর ভাষা ছিল নেতিবাচক। এখন সব অংশীজনের মতামত নিয়েই আইনটিকে জনবান্ধব করা হবে।
আরেক বিশেষ অতিথি বিটিআরসির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মো. এমদাদ উল বারী বলেন, সাইবার সিকিউরিটি আইন নিয়ে দুটি পক্ষের ভিন্ন অভিমত রয়েছে। একটি পক্ষের ভাষ্য, অর্থনৈতিক উন্নতি ও মতপ্রকাশের জন্য প্রযুক্তিগত দিকে অবাধ পরিবেশ থাকা প্রয়োজন। অপর দিকে যাঁরা এর কারিগরি দিক নিয়ে কাজ করেন, তাঁরা নিরাপত্তার দিকটি নিয়ে উদ্বিগ্ন। তাঁরা নিরাপত্তা নিশ্চিতের ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে চান। উভয় পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক সংযোগ জরুরি।
বিটিআরসির চেয়ারম্যান বলেন, বিভিন্ন দেশে নিরাপত্তা, বাক্স্বাধীনতা ও মুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে কেমন করে কাজ হয়েছে, সেসব দৃষ্টান্ত পর্যবেক্ষণ করে একটি নীতিকৌশল গ্রহণ করা যেতে পারে। তবে দণ্ডবিধির আইন দিয়ে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে প্রণয়নের উপযোগিতা নেই। তাঁর ভাষায়, ‘ডাঙার আইন জলে প্রয়োগ না করাই ভালো।’
প্যানেল আলোচকদের মধ্যে অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস বাংলাদেশের (এমটব) মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ জুলফিকার বলেন, বিদ্যমান সাইবার নিরাপত্তা আইনে মানুষকে শাস্তি দেওয়ার দিকেই অধিকতর ঝোঁক রয়েছে। কিন্তু আইনে মানুষকে সংশোধিত হওয়ার সুযোগ থাকতে হবে। বিদ্যমান আইনি কাঠামো বজায় রেখে তা সম্ভব নয়। ইতিমধ্যেই এআইসহ অনেক নতুন বিষয় এসেছে। এগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে এমন আইন করতে হবে, যেন অপপ্রয়োগের সুযোগ না থাকে।
মোবাইল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান রবির কোম্পানি সেক্রেটারি ও চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাহেদুল আলম বলেন, সাইবার নিরাপত্তা আইনটি করাই হয়েছিল মূলত বাক্স্বাধীনতা বা মতপ্রকাশের মুক্ত পরিবেশ নিয়ন্ত্রণের জন্য। এই আইনের ৬০টি বিধানের মধ্যে ৩৭টি বিধান অপরাধসংক্রান্ত এবং ১৮টি বিধানে আছে শুধু কী করলে অপরাধ হবে। ডেটা, ডিজিটাল কনটেন্ট প্রভৃতির সুরক্ষার জন্য মাত্র চারটি ধারা রয়েছে। এমন একটা আইন সংশোধন করে কিছু হবে না। নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে।
আলোচকেরা বলেন, অপরাধ দমনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োজন। বর্তমান আইনের ভালো দিকগুলো রাখা যেতে পারে, তবে তা যেন মতপ্রকাশে বাধা না হয়ে ওঠে। পাশাপাশি নতুন আইন করার সময় অনলাইনে আর্থিক লেনদেন, তথ্যের নিরাপত্তার মতো বিষয়গুলোর প্রতিও যথাযথ গুরুত্ব নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে ‘মানহানিকর তথ্য’, ‘ভুল তথ্য’, ‘আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী বক্তব্য’, ‘ভাবমূর্তি’, ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ ও ‘অশ্লীলতা’র মতো যে বিষয়গুলো আইনে সাজার আওতাভুক্ত রয়েছে, তার সুস্পষ্ট সংজ্ঞা দিতে হবে। যেন এই বিষয়গুলো অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে ভবিষ্যতে দমন–পীড়ন না করা যায়।
প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ফাইন্যান্সের এমডি ও সিইও কায়সার হামিদ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি সদস্য নাবিল বি আরিফ, আনোয়ার টেকনোলজিসের সহপ্রতিষ্ঠাতা ওয়াইজ আর হোসেন, বেসিসের সাবেক সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবির ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ সুমন আহমেদ।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন টিআরএনবির সাবেক সভাপতি রাশেদ মেহেদী। প্রবন্ধে তিনি আইনটিকে যুগোপযোগী করার পাশাপাশি ৪২ ধারা (পরোয়ানা ছাড়াই তল্লাশি, জব্দ, গ্রেপ্তার) সম্পূর্ণ বাতিল ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য ২১, ২৫, ২৮, ২৯ ও ৩২ নম্বর ধারায় বর্ণিত সংজ্ঞা আরও সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট করার সুপারিশ করেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সংগঠনের সভাপতি সমীর কুমার দে।