পানি–স্যানিটেশনে সুবিধা দিয়ে যেভাবে লাভবান হলো তিন কারখানা
রোকসানা খাতুন নারায়ণগঞ্জের ফকির ফ্যাশন লিমিটেড নামের একটি পোশাক কারখানার কর্মী। কারখানার কাছাকাছি একটা এলাকায় থাকেন। কারখানা এবং তাঁর বাসার কাছে পানি ও স্যানিটেশনের সুযোগ খুব বেশি ছিল না। বাসার একমাত্র শৌচাগারটি ব্যবহার করত একাধিক মানুষ। তাই বেশির ভাগ সময় সেটি নোংরা থাকত।
শৌচাগারে যাওয়ার জন্য দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। কর্মস্থলে মাসিকে ব্যবস্থাপনার দিনগুলোতে সমস্যা ছিল। বছর তিনেক হলো সেসব সমস্যা দূর হয়েছে। কর্মস্থলে পানি ও স্যানিটেশনের জন্য নতুন ব্যবস্থা হয়েছে। যে এলাকায় তিনি থাকেন, সেখানে নতুন শৌচাগার হয়েছে। মাসিকের ব্যবস্থাপনার জন্য কর্মস্থলে হাতের নাগালে প্যাড মিলছে। শৌচাগার ব্যবহার করতেও বাধা নেই।
রোকসানা বলছিলেন, তিনি যেখানে থাকেন, সেখানে একটি টয়লেট এবং তাঁদের কারখানায় চলমান পানি ও একটি হাত ধোয়ার নতুন ব্যবস্থা পেয়েছেন। এটা তাঁদের জন্য বড় স্বস্তির বিষয়। এখন আর দীর্ঘ সময় ধরে লাইনে দাঁড়াতে হবে না।
পানি ও স্যানিটেশনের জন্য নতুন স্থাপনা তৈরিই শুধু হয়নি, কীভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হয়, এর প্রশিক্ষণও পেয়েছেন এক পোশাককর্মী। এসব বিষয়ে স্থানীয় মানুষ এবং কারখানার কর্মীদেরও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। রোকসানা বলছিলেন, ‘উন্নত স্বাস্থ্যবিধি এবং আমাদের মাসিকের সময় যত্ন নিতে শিখেছি। এটি এমন একটি বিষয়, যা নিয়ে আমরা কারও সঙ্গে কথা বলতে পারিনি। এখন আর লজ্জা নেই।’
এই ফকির ফ্যাশনসহ দেশের তিনটি পোশাক কারখানা ও কারখানার কর্মীদের বাসস্থানের এলাকায় পানি ও স্যানিটেশন খাতে নতুন ব্যবস্থাপনা তৈরি ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ দুই বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ‘বুস্টিং বিজনেস: হোয়াই ইনভেস্টিং ইন ওয়াটার, স্যানিটেশন অ্যান্ড হাইজিন পেইস অব’ (ব্যবসায় উন্নয়ন: কেন পানি, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধিতে বিনিয়োগ করলে লাভ হয়) শীর্ষক গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে।
পানি ও স্যানিটেশন–সংক্রান্ত একটি প্রকল্পের আওতায় এ গবেষণা হয়েছে। প্রকল্পের কাজ শুরু ২০১৮ সালে এবং শেষ হয়েছে ২০২১ সালে। প্রকল্প চলার সময়ই করা হয়েছে এ গবেষণা। ফকির ফ্যাশন ছাড়া অন্য দুই প্রতিষ্ঠান হলো নেক্সট অ্যাকসেসরিজ এবং এসকোয়্যার নিট কম্পোজিট লিমিটেড। তিন কারখানার অবস্থান নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ ও রূপগঞ্জ উপজেলায়। এইচএসবিসির সহায়তায় এ প্রকল্প পরিচালনা করেছে আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াটারএইড।
গবেষণায় দেখা গেছে, পানি ও স্যানিটেশন খাতে মান বাড়ালে ব্যবসার সামগ্রিক উন্নতি ঘটে, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়, স্বাস্থ্য, মনোবল এবং আনুগত্যের উন্নতি হয়। শেষ পর্যন্ত ব্যবসায়িক মুনাফা বৃদ্ধি পায়।
প্রকল্প কীভাবে পরিচালিত হয়েছে
এই তিন প্রতিষ্ঠানে কর্মীর সংখ্যা ২৬ হাজারের বেশি। এর মধ্যে ৮০০ কর্মীর ওপর এই প্রকল্প পরিচালিত হয়েছে। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই নারী। ২০২১ সালে গবেষণা শেষের পর ফলাফলে দেখা গেছে, তিনটি প্রতিষ্ঠানের পানি ও স্যানিটেশন–সংক্রান্ত অভিন্ন সমস্যা ছিল। কর্মীদের জন্য ট্যাপের বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় কম। কারখানার নারী কর্মীরা একই কাপড় ধুয়ে মাসিকের জন্য ব্যবহার করতেন।
নেক্সট অ্যাকসেসরিজ কারখানায় হাত ধোয়ার প্রাথমিক সুবিধা থাকলেও অন্য দুটিতে প্রয়োজনের তুলনায় তা কম ছিল।
আবার কর্মীরা যেসব এলাকায় থাকতেন, সেখানে ৬০ ভাগ ক্ষেত্রে স্যানিটেশনের ক্ষেত্রে উন্নত ব্যবস্থার সুযোগ ছিল না। হাত ধোয়া ও মাসিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ধারণা ছিল একেবারেই কম। ৮১ শতাংশ ক্ষেত্রে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা ছিল না।
তিনটি প্রতিষ্ঠানে পানি ও স্যানিটেশনের উন্নতিতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে আছে পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে ভূগর্ভস্থ পানির বিপরীতে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা, সেই পানির সরবরাহ করা, নতুন টয়লেট স্থাপন, হাত ধোয়ার জন্য নতুন জায়গার বন্দোবস্ত, নারীদের মাসিক ব্যবস্থাপনার সামগ্রী হাতের নাগালে পৌঁছানো। এসব স্থাপনা নির্মাণের পাশাপাশি পানি ও স্যানিটেশন নিয়ে কর্মী ও ব্যবস্থাপকদের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হয়।
ওয়াটারএইডের বাংলাদেশের প্রধান হাসিন জাহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বুঝিয়েছি পানি ও স্যানিটেশনের ব্যবস্থা উন্নত করলে আখেরে প্রতিষ্ঠানের লাভ হবে। দেশের তৈরি পোশাক খাতে বেশির ভাগই নারী কর্মী। তাঁদের স্বাস্থ্য পরিস্থিতির উন্নতি হলে কর্মোদ্যম যে বাড়বে, সেটাও আমরা তুলে ধরেছি। এর ফলাফলও পাওয়া গেছে।’
তিনটি প্রতিষ্ঠানই কিন্তু স্থাপনা নির্মাণ এবং সচেতনতামূলক কাজগুলোতে অর্থ ব্যয় করেছে। এখানে সহায়তা দিয়েছে ওয়াটারএইড।
গবেষণার ফল
গবেষণায় দেখা গেছে, এখন ৯৯ শতাংশ কর্মী হাত ধোয়ার বিষয়ে ধারণা পেয়েছে। ৮৮ শতাংশ নারী কর্মী কারখানায় খাবার খাওয়ার সময় হাত ধোয়। প্রকল্প শুরুর আগে এ হার ছিল ১ শতাংশ। পুরুষ কর্মীদের মধ্যে এ হার ৫২ শতাংশ, আগে ছিল ২ শতাংশ। এখন ৮২ শতাংশ নারী মাসিকের সময় স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করছেন। আগের চেয়ে ৫৬ শতাংশ বেড়েছে এ হার।
সমীক্ষার ফল অনুসারে, কর্মীদের বসবাসের এলাকায় এখন নিরাপদে পানির ব্যবস্থা ৩১ শতাংশ বেড়েছে। নতুন করে ২৬ শতাংশ পরিবারের এখন উন্নত টয়লেট রয়েছে। পানিবাহিত রোগের পরিমাণ কমে গেছে ৪ শতাংশ।
পানি ও স্যানিটেশন বিনিয়োগ করে এর মান উন্নত করার পর কর্মচারীদের অনুপস্থিতি ১৫ শতাংশ কমেছে, সময়মতো কর্মস্থলে আসার হার ৫ শতাংশ বেড়েছে। কর্মীদের কাজজনিত ক্ষতি কমেছে ২ শতাংশ।
প্রকল্প শুরুর পর দেখা গেছে, পরিবারের কোনো না কোনো সদস্যের অসুস্থতার হার ৪৬ থেকে ৩৫ শতাংশে কমে এসেছে।
ফকির ফ্যাশনের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ফকির কামরুজ্জামান নাহিদ বলেন, ‘পরিষ্কার পানি, উন্নত টয়লেট এবং হাত ধোয়ার সুবিধা থাকায় কারখানায় স্বাস্থ্যবিধির উন্নতি হয়েছে, কর্মীদের স্বাস্থ্যও ভালো হয়েছে। আমাদের কারখানার প্রতিটি কোনায় হাত ধোয়ার সুবিধা রয়েছে।’
কামরুজ্জামান নাহিদ বলেন, স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যবিধি অনুশীলন, টয়লেটের সঠিক ব্যবহার এবং স্যানিটারি প্যাড ব্যবহারের কারণে তাঁদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
উৎপাদনশীলতা বেড়ে যাওয়ার ফলে সার্বিকভাবে প্রতিষ্ঠানগুলোর লাভও বেড়েছে। গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, পানি ও স্যানিটেশনে এক ডলার বিনিয়োগের বিপরীতে ১ দশমিক ৩৩ ডলার লাভ পাওয়া গেছে। আগামী ১০ বছরে প্রতি এক ডলারের বিনিয়োগে ৬ দশমিক ৭৯ ডলারের সমপরিমাণ লাভ হতে পারে। আর এর ফলে তিন কোম্পানির ৬৪ লাখ ডলারের সমপরিমাণ মুনাফার সম্ভাবনা দেখা গেছে।
ফকির কামরুজ্জামান নাহিদ বলেন, ‘আগামী ১০ বছরে এ অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে আমরা কাজ করছি। এটি নিশ্চিত করার জন্য আমাদের একটি পরিকল্পনা রয়েছে। কর্মীরাই আমাদের প্রতিষ্ঠানের প্রাণ। তাঁদের উন্নতিতে আমরা কাজ করে যাব।’
গবেষণার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল পানি ও স্যানিটেশনের উন্নতির দিকে তৈরি পোশাক কারখানার মালিকদের উদ্বুদ্ধ করা। এর মাধ্যমে এই খাতের উন্নতিতে সহায়তা দেওয়া। এ গবেষণাকে ‘খুবই তাৎপর্যপূর্ণ’ বলেছেন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এস এম মান্নান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ গবেষণার ফলাফল পোশাক খাতের মালিকদের জন্য শিক্ষণীয় একটি বিষয় হয়েছে। এখনো যেসব প্রতিষ্ঠান পানি ও স্যানিটেশনের ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে, তারা এ গবেষণা দেখে উদ্বুদ্ধ হতে পারে। কর্মীর উন্নতিতে প্রতিষ্ঠানেরই লাভ, এটা সবাইকে বুঝতে হবে।’