পরিবর্তনের পথে এগিয়ে যেতে শেখায় ‘কবর’ নাটক
মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটক মহান ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিকে ধারণ করে আছে। আবার নির্দিষ্ট সময়কে ছাপিয়ে তা চিরকালীন প্রতিরোধের শিল্প স্বর হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘কবর’ জাতীয়তাবাদী বয়ানের পক্ষে এবং বিপক্ষে পাঠ করা যায়।
শিক্ষাবিদ, সাহিত্য সমালোচক, বুদ্ধিজীবী, নাট্যকার মুনীর চৌধুরীর ৯৯তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা অনুষ্ঠানে উঠে আসে এসব মন্তব্য। আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে বাংলা একাডেমির শামসুর রাহমান মিলনায়তনে আয়োজিত হয় এই স্মরণ আলোচনা।
‘সাহিত্য শাস্ত্রবাদী ও জাতীয়তাবাদী নাট্য সমালোচনার অধিপতিশীল ধারার বিপরীতে মুনীর চৌধুরীর কবর নাট্যের অন্য পাঠ: স্মৃতির রাজনীতি ও রাজনৈতিক অজ্ঞান মনের বিবিধ রূপরেখা’ শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শাহমান মৈশান। তিনি তাঁর প্রবন্ধে মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটকের লিখিত রূপ নিয়ে আলোচনা করেন। শাহমান মৈশান বলেন, পঞ্চাশের দশকে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে বিতর্কের সুযোগ তৈরি করেছিল। ‘কবর’ নাটকটি জাতীয়তাবাদী বয়ানের পক্ষে এবং বিপক্ষে পাঠ করা যায়। মুখ্য ও গৌণ দুই রকম টেক্সট দিয়েই ‘কবর’ নাটক রচিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, মুনীর চৌধুরীর নাটক লেখার কৌশল ইউরোপীয় আধুনিকতা থেকে আসা। নাটকটি শুধু ভাষা আন্দোলন নয়, যেকোনো আন্দোলনের সঙ্গেই সম্পৃক্ত। শাহমান মৈশান বলেন, কবরের মতো বড় সাহিত্যের শক্তিটাই এখানে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ফারহানা আখতার বলেন, ‘কবর’ নাটকটি শুধু ভাষা আন্দোলনের সময়কাল নিয়ে নয়, বরং বাঙালির আত্মপরিচয়ের লড়াইকে মঞ্চে তুলে ধরেছে। শাহমান মৈশানের বক্তব্যে সাংস্কৃতিক বস্তুবাদ তত্ত্বটি উঠে এসেছে বলে উল্লেখ করেন ফারহানা আখতার। তিনি বলেন, শুধু অতীতের স্মৃতিকে স্মরণ করলেই হয় না। পাশাপাশি পরিবর্তনের পথে এগোতে হয়, তা–ই শেখায় ‘কবর’ নাটক।
ইউল্যাবের মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগের অধ্যাপক সুমন রহমানের আলোচনাতেও গুরুত্ব পায় প্রবন্ধ আলোচনা। তিনি বলেন, তত্ত্বের কাজ বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা করা। কিছু ছায়ামূর্তি আর লাশ পরাবাস্তব হলেও একে যখন আলোচনা করা হয়, তখন এটি বাস্তবই হয়ে ওঠে। তাত্ত্বিকেরা অবশ্য একটি আর্ট থেকে ততটুকুই তুলে আনেন, যেটুকু তাঁদের প্রয়োজন। এতে কোনো কোনো সময় আর্টকে পুরোপুরি নিরপেক্ষভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয় না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সভাপতির বক্তব্যে বাংলা একাডেমির সভাপতি মোহাম্মদ আজম বলেন, ‘“কবর” নাট্যের একমাত্রিক পাঠ বিপজ্জনক এবং যথাবিচারপূর্ণ নয়, যদিও আমাদের জাতীয়তাবাদী ও সাহিত্যশাস্ত্রবাদী পাঠ—পরিসরে এটি নিয়মিত ঘটে চলেছে। মুনীর চৌধুরীর এই রচনাসহ তাঁর সামগ্রিক সাহিত্যকর্ম বিভিন্ন পাঠের দাবি রাখে, কারণ নির্দিষ্ট সময় এবং প্রপঞ্চকে ধারণ করেও তিনি সৃষ্টিশীলতার নানামাত্রিক ও চিরায়ত জ্যোতি বহন করে চলেন।” তিনি বলেন, কবর নাটকের মুনশিয়ানা হচ্ছে এর প্রথম শব্দ থেকে শেষ শব্দ পর্যন্ত ভাষা আন্দোলন নিয়ে লেখা। অথচ তা ন্যারেটিভ হিসেবে নয়।
স্বাগত বক্তব্যে বাংলা একাডেমির পরিচালক সরকার আমিন বলেন, সাহিত্যের দূরদর্শিতায় ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা ‘কবর’ নাটকের রচয়িতা মুনীর চৌধুরী এখনো সমকালীন। তিনি ‘কবর’ নাটক থেকে একটি উক্তি পাঠ করে জুলাই–আগস্টের আন্দোলনের সময় ঘটে যাওয়া ঘটনার সম্পর্কের যোগসূত্র দেখান।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের অন্যতম একজন শিকার মুনীর চৌধুরী। শিক্ষাবিদ, সাহিত্য সমালোচক, বুদ্ধিজীবী, নাট্যকার মুনীর চৌধুরীর জন্ম ২৭ নভেম্বর ১৯২৫ সালে।