ভারী বৃষ্টি ও উজানের পানিতে প্লাবিত ৮ জেলা

পানিতে ডুবে গেছে খাগড়াছড়ির নিচের বাজার এলাকা। সেই এলাকা দিয়ে চলাচল করছে লোকজন।ছবি: প্রথম আলো

বাড়িঘরে হাঁটু থেকে কোমরসমান পানি। গ্রামীণ সব সড়ক, ফসলি জমি তলিয়ে আছে পানিতে। ভেসে গেছে পুকুর ও খামারের মাছ। পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টিতে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যায় এমনই অবস্থা ফেনীর তিন উপজেলা পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়ায়। প্লাবিত হয়েছে এই তিন উপজেলার শতাধিক গ্রাম, পানিবন্দী লক্ষাধিক মানুষ।

নোয়াখালীর নয়টি উপজেলার মধ্যে আটটিতেই জলাবদ্ধতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। তিন দিন ধরে বেশির ভাগ ঘরবাড়ি জলমগ্ন হয়ে আছে। খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ১৮টি ইউনিয়নের সব কটিই বন্যায় প্লাবিত হয়েছে।

টানা বৃষ্টির সঙ্গে পাহাড়ি ছড়া ও নদ-নদী দিয়ে তীব্র বেগে ভারত থেকে আসছে পানি। এতে কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট ও মৌলভীবাজারে বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে।

ফেনীর আনন্দপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য মোহাম্মদ সেলিম বলেন, এর আগে সর্বশেষ ১৯৮৮ সালে ভয়াবহ বন্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন ফেনীর বাসিন্দারা। গত ৩৬ বছরে অনেকবার বন্যা হলেও এ ধরনের ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়নি। এবারের বন্যায় পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়ার ৯০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছে।

বন্যা পরিস্থিতিতে গতকাল মঙ্গলবার রাত থেকে কয়েকটি ডিঙি নৌকায় পানিবন্দী মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা শুরু করেন স্বেচ্ছাসেবীরা। উদ্ধারে নামেন ফায়ার সার্ভিসের লোকজনও।

উজান থেকে নেমে আসা পানিতে বাড়িঘর তলিয়ে গেছে। সেখান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরাচ্ছেন এক ব্যক্তি। আজ সকালে কুমিল্লা সদর উপজেলার চানপুর এলাকায়
ছবি: এম সাদেক

সর্বশেষ আজ বুধবার বিকেল থেকে পানিবন্দী মানুষকে উদ্ধারে নেমেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। ছয়টি স্পিডবোটে করে উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছেন সেনাসদস্যরা। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরাও তিনটি স্পিডবোটে উদ্ধারকাজ শুরু করেছেন।

জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, উদ্ধার তৎপরতায় বাংলাদেশ কোস্টগার্ডও যুক্ত হচ্ছে। বন্যার কারণে ফেনী-পরশুরাম আঞ্চলিক সড়কসহ স্থানীয় সব গ্রামীণ সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।

ফেনীর জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার বলেন, বন্যায় উদ্ধারকাজে সহযোগিতার জন্য সেনাবাহিনী ও কোস্টগার্ডের সহায়তা চাওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে সেনাবাহিনী ছয়টি স্পিডবোট নিয়ে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেছেন। আরও ছয়টি স্পিডবোট ফেনীর পথে রয়েছে। বিজিবির সদস্যরাও কাজ করছেন। কোস্টগার্ডও উদ্ধার তৎপরতায় যুক্ত হচ্ছে।

আরও পড়ুন

আজ সকালে নোয়াখালী শহরের লক্ষ্মীনারায়ণপুর, হরিনারায়ণপুর, কাজি কলোনি, লইয়ার্স কলোনি, রশিদ কলোনি ও কৃষ্ণরামপুর এলাকা ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি বাসাবাড়ির আঙিনায় বৃষ্টির পানি থই থই করছে।

রশিদ কলোনি এলাকার বাসিন্দা মনু দাশ গুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, টানা বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা দেখা দেওয়ায় তাঁর বসতঘরের ভেতরেও পানি ঢুকে পড়েছে। সাপ ও পোকামাকড়ের আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটছে তাঁর। এ পরিস্থিতিতে রান্নাবান্না করা দুরূহ হয়ে পড়েছে।

বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় নিরাপদ আশ্রয়ে যাচ্ছেন বাসিন্দারা। ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার বসন্তপুর গ্রাম
ছবি: সংগৃহীত

খাগড়াছড়ি সদর ও পানছড়ি উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও আরও অবনতি হয়েছে দীঘিনালা উপজেলায়। দীঘিনালায় এখনো হাজারো মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় আছেন। দীঘিনালার সঙ্গে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলা ও লংগদু উপজেলার সরাসরি যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।

চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ১৮টি ইউনিয়নের সব কটিই বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন উপজেলার প্রায় এক লাখ মানুষ। ঘরবাড়ি, ফসলি জমি প্লাবিত হওয়ার পাশাপাশি পাহাড়ি ঢলে ভাঙন দেখা দিয়েছে ধুরং নদের বেড়িবাঁধের কয়েকটি স্থানে। ফটিকছড়ির ইউএনও মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানিয়েছেন, বন্যায় পাশের রাউজান উপজেলার প্রায় ৮টি ইউনিয়ন এবং হাটহাজারী উপজেলার ৮-১০টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে।

ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার সীমান্ত এলাকায় বন্যাকবলিত বাসিন্দাদের উদ্ধারে কাজ করছেন বিজিবির সদস্যরা
ছবি: সংগৃহীত

এদিকে দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টি হয়েছে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বুধবার সকাল ছয়টা থেকে পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় সীতাকুণ্ডে বৃষ্টির পরিমাণ ১৯৩ মিলিমিটার।

কুমিল্লার গোমতী নদীতে পানি বেড়ে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। গত মঙ্গলবার রাত থেকে বৃষ্টি ও ঢলের পানি ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। গোমতী নদীর আদর্শ সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, গোমতীর তীর ঘেঁষে আছড়ে পড়ছে ঢেউ। চরাঞ্চলের কয়েক হাজার একর সবজিখেত পানিতে তলিয়ে গেছে।

মালাপাড়া এলাকার বাসিন্দা আলাউদ্দিন আজাদ বলেন, তিনি পরিবার নিয়ে চরের ভেতর বসবাস করেন। গত ১০ বছর গোমতী নদীতে এত পানি দেখেননি।

ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর ও আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন পুলিশ চেকপোস্ট প্লাবিত হয়েছে। আজ সকাল ১০টার পর ইমিগ্রেশনের সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। পানির তোড়ে গাজীর বাজার এলাকায় একটি অস্থায়ী সেতু ভেঙে আখাউড়া-আগরতলা সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। উপজেলার অন্তত ৫০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

মনু নদের প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে পাহাড়ি ঢলের পানি ঢুকে তলিয়ে গেছে মানুষের বাড়িঘর। পশ্চিম হাজীপুর এলাকা, টিলাগাঁও, কুলাউড়া, মৌলভীবাজার, ২১ আগস্ট বিকেলে
ছবি. প্রথম আলো

সিলেটে বুধবার বৃষ্টির পরিমাণ কিছুটা কমলেও কমেনি মানুষের ভোগান্তি। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির ফলে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে লোকজন ভোগান্তিতে পড়েন। অনেকেই এমন বৃষ্টির কারণে ঘর থেকে প্রয়োজন ছাড়া বের হননি।

মৌলভীবাজারে মনু নদের পানি বিপৎসীমার ১১৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্য প্রধান তিন নদ-নদী ধলাই, জুড়ী ও কুশিয়ারার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুলাউড়া ও জুড়ী উপজেলার বিভিন্ন স্থানে নদ-নদীর বাঁধ ভেঙে, উপচে ৬২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা]