শিব নারায়ণের কর্নিয়ায় আলো দেখবেন কালাম ও মশিউর
শর্তহীনভাবে যাঁরা দেশকে ভালোবাসেন, তাঁরা সময়ের বরপুত্র। তেমনই একজন শিব নারায়ণ দাশ। বাংলাদেশের প্রথম পতাকার অন্যতম নকশাকার ছিলেন তিনি। মৃত্যুর পরও উজাড় করে দিলেন নিজের সবটুকু। মরণোত্তর চক্ষু ও দেহ দান করে গিয়েছেন। তাঁর দুই চোখের দুটি কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করা হয়েছে চাঁদপুরের আবুল কালাম ও রংপুরের মশিউর রহমান নামের দুই ব্যক্তির চোখে। গত শনিবার তাঁদের চোখের কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করা হয়। গতকাল রোববার খুলে দেওয়া হয়েছে দুজনেরই চোখের ব্যান্ডেজ। চিকিৎসকেরা বলেন, তাঁদের পুরোপুরি স্বাভাবিক অবস্থায় আসতে আরও কয়েকটা দিন লাগবে।
চাঁদপুরের আবুল কালাম অবশ্য চোখের ব্যান্ডেজ খোলার পরপরই চলে গেছেন বাড়িতে। তাঁর সঙ্গে কথা হয় গতকাল রাতে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্যারেজে কাজ করার সময় আগুনের ফুলকি ঢুকে আমার চোখ নষ্ট হয়, তাও ১৩–১৪ বছর আগের কথা। শনিবার অপারেশন হইছে। সন্ধানীতে অনেক দিন আগে আবেদন করে রাখছিলাম।’
৩৫ বছর বয়সী আবুল কালামের চোখে কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করা হয়েছে রাজধানীর সন্ধানী চক্ষু হাসপাতালে। আবুল কালামের স্ত্রী মরিয়ম বেগম জানান, সাত দিন পর চিকিৎসক আবার চোখ পরীক্ষা করবেন। চোখের সমস্যার জন্য তাঁর স্বামী অনেক দিন আগেই গ্যারেজের কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। এরপর ব্যবসা করতেন। তাতেও বাদ সাধে দৃষ্টির সীমাবদ্ধতা।
কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করা অপর ব্যক্তি রংপুরের মশিউর রহমান আছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ)। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি গণমাধ্যমের কথা শুনে ফোন কেটে দেন। এরপর যোগাযোগ করা হয় তাঁর চিকিৎসকের সঙ্গে। কর্নিয়া বিশেষজ্ঞ রাজশ্রী দাস শনিবার বিএসএমএমইউতে মশিউরের চোখে কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করেন।
রাজশ্রী দাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘২১ বছর বয়সী মশিউর রহমান জন্ম থেকেই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। তাঁর সমস্যা “কনজেনিটাল কর্নিয়াল অপাসিটি ডিউ টু পিটারস অ্যানোমালি”। মশিউর রহমানের ডান চোখে কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। যেহেতু তাঁর জন্মগতভাবেই সমস্যা ছিল, তাই একেবারে স্বাভাবিক মানুষের মতো সব স্পষ্ট দেখবেন এমন নয়। তবে যেটুকু দেখতে পাবেন, তাতে তিনি নিজের কাজগুলো করতে পারবেন বলে আশা করি।’
শিব নারায়ণ দাশের কর্নিয়া প্রতিস্থাপনের জন্য এই দুই ব্যক্তিকে নির্বাচন করা হয়েছে সন্ধানী জাতীয় চক্ষু দান সমিতি ও সন্ধানী আন্তর্জাতিক চক্ষু ব্যাংক বাংলাদেশের মাধ্যমে। নির্বাচনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে সমিতির সমন্বয়ক মো. সাইফুল ইসলাম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘কর্নিয়ার জন্য হাজার হাজার আবেদনপত্র জমা পড়ে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিশু বা অল্পবয়স্ক মানুষ অথবা যাঁরা দৃষ্টিহীন হয়ে কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন, এসব বিষয় বিবেচনা করে তাঁদের আগে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ দুজনের আবেদন এসেছে অনেক দিন আগে। ফলে শিব নারায়ণ দাশের পরিবারের পক্ষ থেকে আমাদের জানানোর পরপরই আমরা সংগ্রহ করি ও প্রতিস্থাপনের উদ্যোগ নিই।’
শিব নারায়ণ দাশ গত শুক্রবার সকালে ৭৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। সন্ধানী আন্তর্জাতিক চক্ষু ব্যাংকের দল সেদিনই দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তাঁর দুটি কর্নিয়া সংগ্রহ করে।
শিব নারায়ণ দাশের ছেলে অর্ণব আদিত্য দাশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাবা অনেক দিন আগেই তাঁর চোখ ও দেহ দান করার ইচ্ছা জানিয়ে রেখেছিলেন। আমি তাঁর ইচ্ছাটা পূরণ করতে বাবার মৃত্যুর পরপরই সন্ধানীকে চক্ষু দানের জন্য এবং বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষকে দেহ দানের জন্য খবর দিই। তাঁরা এসে আনুষ্ঠানিকভাবে বুঝে নিয়েছেন আমাদের কাছ থেকে। বাবা চেয়েছেন, তাঁর শরীরটিও মানুষের, চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনে কাজে আসুক। তিনি সব সময়ই নিজেকে বিলিয়ে দিতে চেয়েছেন। একইভাবে আমার মা মুক্তিযোদ্ধা গ্রীতশ্রী চৌধুরীও নিজের কর্নিয়া ও দেহ দান করার কথা জানিয়ে রেখেছেন। আমিও সম্ভবত তা–ই করব।’
বাবার দেশপ্রেমের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে অর্ণব আরও বলেন, প্রথম পতাকার নকশাকার প্রতিবেদনের সঙ্গে যে সাদাকালো ছবিটি প্রকাশিত হয়, ওখানে বাবা (শিব নারায়ণ দাশ) নেই। তখন যাঁরা পতাকার নকশার জন্য কাজ করেছিলেন, তাঁদের পক্ষে দেশের ও রকম একটা পরিস্থিতিতে জনসম্মুখে দাঁড়িয়ে এভাবে কাজটি করা সম্ভব ছিল না। তবে বাবা বলতেন, ‘পতাকা করেছি দেশের জন্য সম্মিলিতভাবে। এখানে কৃতিত্ব নেবার কিছু নেই।’
ষাটের দশক থেকে ছাত্ররাজনীতি করা, মুক্তিযুদ্ধ, ক্যাম্প পরিকল্পনা করা শিব নারায়ণ দাশের অবদান শুধু ‘পতাকার নকশাকার’ পরিচয়ের কাছে হারিয়ে যায় বলে মন্তব্য করেন তাঁর সন্তান।
১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে ছাত্রদের পক্ষে পতাকা উড়িয়েছিলেন ছাত্রনেতা তৎকালীন ডাকসুর ভিপি আ স ম আবদুর রবসহ অন্য নেতারা। দেশ স্বাধীনের আগে এই পতাকার নকশাকারদের অন্যতম ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাশ। জাতীয় পতাকার সবুজ জমিনে বাংলাদেশের যে হলুদ মানচিত্র ছিল, তা অঙ্কন করেছিলেন তিনি।
শিব নারায়ণ দাশের চোখের কর্নিয়া এখন দুজন মানুষের চোখে। যাঁরা তাঁর আত্মীয় নন, পরিচিতও নন। তাঁর এই দানকে ছেলে অর্ণব লড়াই বলেই মনে করেন। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর শেষ লড়াই করেছেন মৃত্যুর পর এই দানের মধ্য দিয়ে।’