২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

ধ্বংসস্তূপে আটকে থাকার ভয়াবহ গল্প শোনালেন বাংলাদেশি দুই বন্ধু  

ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধারের পর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন গোলাম সাঈদ। তাঁর পাশে আছেন বন্ধু নূরে আলম
ছবি: সংগৃহীত

তুরস্কের শহর কাহরামানমারাসের সুতসু ইমাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী গোলাম সাঈদ (রিংকু) দেশটির রাজধানী আঙ্কারার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁর পাশে আছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী নূরে আলম। ভূমিকম্পের ৩৭ ঘণ্টা পর ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল গোলাম সাঈদকে। নূরে আলমও কিছুক্ষণ আটকা ছিলেন। দুজনে শুনিয়েছেন সেই ভয়ানক অভিজ্ঞতা।

গোলাম সাঈদ বগুড়ার ছেলে। আর নূরে আলমের বাড়ি চাঁদপুরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ভবনে পাশাপাশি ঘরে থাকতেন তাঁরা।

গত বৃহস্পতিবার হাসপাতাল থেকে হোয়াটসঅ্যাপে গোলাম সাঈদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আর বাঁচব না। ধ্বংসস্তূপের ভেতরে ইশারায় নামাজ পড়তাম। দোয়া–দরুদ পড়তাম। আল্লাহ আর মানুষের সাহায্য চাইতাম। একসময় বাঁচার আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম।’

গোলাম সাঈদ যে ভবনের নিচে চাপা পড়েছিলেন ওই ভবনেই চাপা পড়েছিলেন নূরে আলম। তবে তাঁর ঘরটি রাস্তার দিকে থাকায় চেষ্টা করে একাই বের হতে পেরেছিলেন। নূরে আলম এখন হাসপাতালে গোলাম সাঈদের দেখভাল করছেন। নূরে আলমের মুঠোফোনেই প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন গোলাম সাঈদ।

গত ৬ ফেব্রুয়ারি ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপেছে তুরস্ক ও সিরিয়া। ১২ দিনের মাথায় আজ শনিবার আল–জাজিরার সর্বশেষ তথ্য অনুসারে তুরস্কে নিহতের সংখ্যা ৩৯ হাজার ৬৭২ জন। দুই দেশে ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৪৫ হাজার।

তুরস্কে ভূমিকম্পের ধ্বংসস্তূপ থেকে একজনকে জীবিত উদ্ধার করা হচ্ছে
ছবি: এএফপি

কবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরবেন, জানেন না গোলাম সাঈদ

মুঠোফোনে গোলাম সাঈদ কথা বলছিলেন কাঁপা কাঁপা স্বরে। বললেন, ‘এখন কিছুটা ভালো আছি। হাতে সমস্যা বেশি। অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। জায়গাটি খোলা রেখে দেওয়া হয়েছে। জায়গাটি আস্তে আস্তে সংকুচিত হবে। পায়ের ব্যথার জন্য দীর্ঘ মেয়াদে থেরাপি নিতে হবে। কবে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারব, তা চিকিৎসকেরা কিছু জানাননি।’

আরও পড়ুন

৩৭ ঘণ্টা পর ধ্বংসস্তূপ থেকে গোলাম সাঈদকে যখন উদ্ধার করা হয়, তখন মনের অবস্থা কেমন ছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবেন না গোলাম সাঈদ। তাঁর মনে আছে, ভূমিকম্পের পর হুড়মুড়িয়ে ভবন ধসে পড়ে। সবকিছু অন্ধকার হয়ে যায়। ধীরে ধীরে তিনি ধ্বংসস্তূপের নিচে তলিয়ে যাচ্ছিলেন। ভয়ংকর সে ঘটনাগুলো মনে করতেও চান না গোলাম সাঈদ। তিনি বাংলাদেশে থাকা মায়ের সঙ্গে প্রতিদিন কথা বলেন। ফোন রাখার আগে বললেন, ‘আপনারা আমার জন্য দোয়া করবেন।’

বগুড়ার গাবতলী উপজেলার দেওনাই গ্রামে গোলাম সাঈদের বাড়ি। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর ২০১৫ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য তুরস্কে যান। তাঁর বাবা গোলাম রব্বানী পেশায় কৃষক। আর মা সালমা বেগম গৃহিণী। তিন ভাইবোনের মধ্যে গোলাম সাঈদ মেজ।

নূরে আলম লিখেছেন ‘এটি আমাদের বাসা ছিল’

নূরে আলম হোয়াটসঅ্যাপে প্রায় মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়া ভবনের একটি ভিডিও পাঠিয়ে লিখেছিলেন, ‘এটি আমাদের বাসা।’ একটু পরেই আবার লিখলেন, ‘বাসা ছিল।’
এখন কেমন আছেন, জানতে চাইলে নূরে আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন তো কোথাও দাঁড়িয়ে থাকলেও মনে হয় চারপাশ দুলছে। কেউ পাশে বসতে গেলে সামান্য নড়ে উঠলেও আঁতকে উঠি। ভূমিকম্পের এ ঘটনার আগে আমার ভয়ডর বেশ কম ছিল। আর এখন ভয়ে একা ঘরে থাকতে পারি না।’

নূরে আলম ও গোলাম সাঈদ এখানেই কোনো একটি ভবনে থাকতেন, এখন তা শুধুই ধ্বংসস্তূপ
ছবি: নূরে আলম

ভবনের নিচে চাপা পড়ায় নূরে আলমের হাতের একটি আঙুল ভেঙে গেছে। ডান পা ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে গিয়েছিল। পায়ের মাংস থেঁতলে গেছে। বললেন, ‘শারীরিক যন্ত্রণা তো আছেই, ভবন ধসের সময় যে বিকট শব্দ হয়েছিল, শুধু সেই শব্দের কথা মনে হলেও গায়ের পশম দাঁড়িয়ে যায়।’

ভূমিকম্পের সময়ের অভিজ্ঞতা জানান নূরে আলম। বলেন, ‘ভূমিকম্পে ঘুম ভেঙে যায়। এক সেকেন্ড কিছু না বুঝেই জানালার কাছে দৌড়ে গিয়ে জানালা ধরে দাঁড়াই। বুঝতে পারছিলাম ভবনটা ধসে পড়ছে। আমি মনটাকে শক্ত রেখেছিলাম।’

নূরে আলমের জানালাটি রাস্তার পাশে ছিল। তাই তিনি প্রাণ নিয়ে ভেতর থেকে বের হতে পেরেছিলেন। গোলাম সাঈদের ঘরটি মাঝামাঝিতে থাকায় তিনি কোনোভাবেই একা বের হতে পারেননি।

আরও পড়ুন

নূরে আলম বলেন, ভূমিকম্পে ২০ ফুটের ভবনটি এক ফুটের হয়ে গেছে। ভবনটির এক তলায় (বাংলাদেশে উচ্চতার দিক থেকে দুই তলা) তিনি ও গোলাম সাঈদসহ মোট আটজন ছিলেন। তাঁদের মধ্যে তাঁরা দুই বাংলাদেশিসহ মাত্র তিনজন জীবিত আছেন। তাঁদের ওপরের তলায় দুটি পরিবার ছিল। নৈশপ্রহরী হিসেবে যিনি কাজ করতেন, তিনি বাইরে ছিলেন। তিনি বেঁচে গেলেও দুই পরিবারের আর কেউ বেঁচে নেই।

বের হওয়ার সময় একজন নারীকে ধ্বংসস্তূপে আটকা দেখেছিলেন নূরে আলম। ওই নারী বেঁচেছিলেন। কিন্তু নূরে আলমের কিছুই করার ছিল না। বললেন, আটকা থাকার সময় একটু নড়লেই ভয় লাগত। মনে হতো যেটুকু বের হতে পেরেছেন, তা–ও আবার নতুন করে ধসে পড়বে।

নূরে আলমও ২০১৫ সাল থেকে তুরস্কে আছেন। তাঁরা তিন ভাই, তিন বোন। বাবা ও মা মারা গেছেন। ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড অ্যান্ড লজিস্টিকস বিভাগে স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী তিনি।  

নূরে আলম বললেন, ভূমিকম্পের সময় তিনি ঘুমিয়েছিলেন। তাই ট্রাউজার আর টি–শার্ট ছাড়া গায়ে আর কোনো কাপড় ছিল না। পায়ে জুতা বা স্যান্ডেলও ছিল না। ধ্বংসস্তূপে তিনি যেখানে পড়েছিলেন, সেখানে তাঁর মাথার ওপরেই কিছু ফাঁকা জায়গা ছিল। আটকে যাওয়া পা বের করে তিনি আস্তে আস্তে বাইরে বের হন। তবে সময়ের হিসাব মনে নেই, তাই বলতে পারেন না ঠিক কতক্ষণ পর বের হয়েছিলেন।
যখন বাইরে এসেছিলেন, তখন তুষারপাত হচ্ছিল, এটুকু মনে আছে নূরে আলমের। ডাকাডাকি করে একসময় বুঝতে পারেন সেখানে তাঁকে সহায়তা করার জন্য এগিয়ে আসার মতো কেউ নেই। এর মধ্যে একের পর এক ভূমিকম্প হতে থাকে। ততক্ষণে হাতের আঙুল দিয়ে রক্ত পড়া শুরু হয়েছে।

নিখোঁজ স্বজনদের খবরের অপেক্ষায় ধ্বংসস্তূপের ওপর বসে আছেন কয়েকজন। কিরিখান, তুরস্ক।
ছবি: রয়টার্স

নূরে আলম বলেন, ‘একসময় মনে হয়েছিল ঠান্ডায় মরে যাব। হেঁটে একটি হাসপাতালে যাওয়ার চেষ্টা করি। সেখানে গিয়ে দেখি তা–ও ধসে গেছে। তুরস্কের এক ব্যক্তি কয়েক হাসপাতাল ঘুরে আমাকে একটি হাসপাতালে পৌঁছে দেন। সে হাসপাতালে থাকার সময় আবার ভূমিকম্প হলে সবাই দৌড়ে বাইরে চলে যাই। ভয়ে পরে আর কোনো ভবনেই ঢুকিনি। সেখান থেকে হেঁটে আবার বাংলাদেশি বন্ধু কাতাদা জাকারিয়ার হোস্টেলে গিয়ে দেখি সে ভবনও ফাঁকা, ভবনে ফাটল দেখা দিয়েছে। সেখানে ঢুকেই এক জোড়া জুতা আর পাতলা একটা কম্বল নিয়ে বের হই। এগুলোর মালিক কে, জানি না।’

আরও পড়ুন

মুঠোফোন নিয়ে বের হতে পারেননি নূরে আলম। তাই পরিবার বা অন্য কাউকে কোনো খবরও দিতে পারেননি। পরে এক বন্ধুর মারফত খবর পাঠানোর চেষ্টা করেন তিনি। কিছুটা ধাতস্থ হওয়ার পর গোলামের খবর নেওয়ার জন্য দৌড়াদৌড়ি শুরু করেন নূরে আলম। ভূমিকম্পে ভবনধসের ২৭ ঘণ্টা পর ওই ভবন থেকে অন্য দেশের একজনকে উদ্ধার করা হয়েছিল। তিনিই জানিয়েছিলেন গোলাম সাঈদ বেঁচে আছেন।
গোলাম সাঈদকে উদ্ধারের পর নূরে আলমসহ বাংলাদেশিদের আঙ্কারায় ফিরিয়ে আনে তুরস্কের বাংলাদেশ দূতাবাস। বর্তমানে নূরে আলম আঙ্কারায় বাংলাদেশি মেজবাহ নামের এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে থাকছেন। এক তুর্কি বন্ধু তাঁকে মুঠোফোনটি ব্যবহারের জন্য দিয়েছেন।

নূরে আলম বললেন, ‘আমি এখন বলতে গেলে প্রায় সুস্থ। কিন্তু আমি যে শহরে থাকি, তা কবে স্বাভাবিক হবে বা আমাদের জীবনযাত্রা কবে স্বাভাবিক হবে, তা সবই অনিশ্চিত। দেশটির সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, সবকিছু স্বাভাবিক হতে কম করে হলেও এক বছর লাগবে।’

নূরে আলম তুরস্কে থাকা বাংলাদেশি কমিউনিটির সদস্য এবং তুরস্কের বাংলাদেশ দূতাবাসের সদস্যদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বললেন, বড় বিপদের সময় এই মানুষগুলোকে পাশে পাওয়া গেছে।

আরও পড়ুন