শিক্ষকমাত্রই পরম শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। তবে তাঁদের মধ্যেও কিছু শিক্ষক একেকজন শিক্ষার্থীর জীবন ও মননে গভীর ছাপ রাখেন। কর্মের কারণে তাঁরা শিক্ষার্থীদের কাছে হয়ে ওঠেন অতি প্রিয়। জীবনভর সেই সব প্রিয় শিক্ষকের কথা মনে থাকে। আর সেসব প্রিয় শিক্ষককে চতুর্থবারের মতো সম্মাননা দিচ্ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইপিডিসি ও প্রথম আলো।
আজ সোমবার রাজধানীর একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত হলো ‘আইপিডিসি-প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা ২০২২’–এর উদ্বোধনী পর্ব। অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষেরা উপস্থিত হয়ে তাঁদের প্রিয় শিক্ষকদের স্মরণ করেন। এ ছাড়া সাফ চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের সদস্য মারিয়া মান্দাও অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে তাঁর প্রিয় শিক্ষকের অবদানের কথা তুলে ধরলেন।
অনুষ্ঠানে বক্তাদের কথায় উঠে এল, মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকদের সম্মান ও সম্মানী দুটোই দিতে হবে। তবে তাঁরা এটাও মনে করিয়ে দিলেন, বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থা গভীর সংকটে পতিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদেরও দায় আছে। তাই এর পরিবর্তনের জন্য অন্যদের পাশাপাশি শিক্ষকদের বড় ভূমিকা পালন করতে হবে।
আইপিডিসি ও প্রথম আলো ২০১৯ সাল থেকে এ সম্মাননা দিয়ে আসছে। করোনাকালেও থেমে থাকেনি প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের দেওয়া হয় এ সম্মাননা। মনোনীত শিক্ষকদের মধ্য থেকে বাছাই করে প্রিয় শিক্ষকদের নির্বাচিত করা হয়।
আয়োজকেরা জানিয়েছেন, নিয়মানুযায়ী মনোনীত শিক্ষকের বয়স কমপক্ষে ৪০ হতে হবে। সেই প্রিয় শিক্ষক বর্তমানে কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত হতে পারবেন।
আর প্রিয় শিক্ষক মনোনয়নকারীদের বয়স হতে হবে কমপক্ষে ১৮ বছর। একজন মনোনয়নকারী সর্বোচ্চ তিনটি মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারবেন। অনলাইনে (www.priyoshikkhok.com) নির্ধারিত ফরম পূরণ করে এ মনোনয়ন দেওয়া যাবে। অনলাইনে নির্দিষ্ট ফরমে আবেদন করা যাবে। এ ছাড়া ওই ওয়েবসাইট থেকে পিডিএফ ফরম ডাউনলোড করে তা পূরণের পর ডাকযোগেও মনোনয়ন পাঠানো যাবে। আজ শুরু হওয়া এ মনোনয়ন কার্যক্রম চলবে আগামী ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির (বিইউবিটি) উপাচার্য ফৈয়াজ খান জানালেন, তাঁর অনেক প্রিয় শিক্ষক আছেন। তবে তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষক ছিলেন ঢাকা কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ জালাল উদ্দিন।
প্রিয় শিক্ষকের দায়িত্ববোধের কথা বলতে গিয়ে ফৈয়াজ খান বললেন, তিনি ও তাঁর ছোট ভাই দুজনেই ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলেন। একবার তাঁর প্রিয় শিক্ষক জালাল উদ্দিন ছোট ভাইদের ক্লাসে লুঙ্গি ও শার্ট পরেই ক্লাসে চলে এসেছিলেন। এটির তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তাতে বেরিয়ে আসে অন্যান্য পোশাক চুরি হয়ে যাওয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে তিনি লুঙ্গি-শার্ট পরেই ক্লাসে চলে আসেন, যাতে ক্লাস বাদ না যায়।
কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের উপাচার্য এইচ এম জহিরুল হক নানাভাবে শিক্ষাগ্রহণের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, প্রথম আলোর অ্যাসিড-সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রম জাতিকে সুফল এনে দিয়েছে।
মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুই প্রিয় শিক্ষকের অবদানের কথা তুলে ধরেন ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত উপাচার্য মো. আবুল কাশেম মিয়া। তিনি বলেন, ‘ওই দুই শিক্ষকের অবদানের কথা কখনো ভুলতে পারব না।’
অনুষ্ঠানে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছিল সাফ চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের সদস্য মারিয়া মান্দার উপস্থিতি। মঞ্চে তাঁকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান তাঁরই প্রিয় শিক্ষক ময়মনসিংহের রণসিংহপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ মফিজ উদ্দিন। এ সময় মফিজ উদ্দিন যেমন নিজের গর্বের কথা জানালেন, তেমনি প্রিয় ছাত্রী মারিয়া মান্দা নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করলেন। বললেন, এমন শিক্ষক পাওয়ায় তিনি গর্বিত। তাঁর কারণেই আজ জাতীয় দলে আছেন।
শিক্ষকদের মধ্যে আরও বক্তব্য দেন সেন্ট যোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ব্রাদার লিও প্যারেরা, উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আ ন ম শামসুল আলম খান, ওয়াইডব্লিউসিএ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ফ্লোরেন্স গোমেজ, বংশাল বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সেতারা বেগম, ২০২০ সালে প্রিয় শিক্ষক সম্মাননাপ্রাপ্ত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হাইস্কুলের সাবেক শিক্ষক আফরূজ জাহান বেগম, ২০২১ সালে প্রিয় শিক্ষক সম্মাননাপ্রাপ্ত শরীয়তপুরের ১২৯ নম্বর দক্ষিণ সখীপুর সিকদারবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুস সাত্তার প্রমুখ। অনুষ্ঠানে সানিডেইলের অধ্যক্ষ তাজিন আহমেদসহ বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষকেরাও উপস্থিত ছিলেন।
শুভেচ্ছা বক্তব্য দিতে গিয়ে আইপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মমিনুল ইসলাম বলেন, শিক্ষকদের সম্মান ও সম্মানী দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও কিছু করার আছে। তিনি আশা করেন, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সব শিক্ষক সম্মানের জায়গায় বসতে পারবেন। সবাই মিলে চেষ্টা করতে হবে, যাতে বাংলাদেশ আরও মানবিক এবং সৃজনশীল হিসেবে গড়ে ওঠে।
এ সময় এ ধরনের অনুষ্ঠানে যুক্ত হওয়া এবং নিজ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম তুলে ধরে আইপিডিসির প্রধান মমিনুল ইসলাম বলেন, ভালো কাজ করলে ব্যবসাও ভালো হয়, তার প্রমাণ হলো আইপিডিসি।
প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, ‘হতাশা, দুঃখ ও বেদনার মধ্যেও বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে, বহু ক্ষেত্রেই এগিয়েছে। আমরা সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জয় দেখতে চাই।’
শিক্ষাব্যবস্থার সমস্যার কথা উল্লেখ করে প্রথম আলো সম্পাদক বলেন, ‘শিক্ষকদের কাছে দাবি করতে পারি, সবাই মিলে আরও যত্ন নিই, সজাগ হই। এভাবেই ধীরে ধীরে সমাজে পরিবর্তন আসবে। অন্য কোনো রাস্তা–পথ নেই, এখানে জাদুমন্ত্র নেই। ধীরে ধীরেই এ পরিবর্তন আনতে হবে।’
আইপিডিসি-প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক সম্মাননার প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন প্রথম আলোর ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন ও যুব কার্যক্রমের প্রধান সমন্বয়কারী মুনির হাসান। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা।
শিল্পী ওয়ারদা আশরাফের সংগীতের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া অনুষ্ঠানটি শেষও হয় সংগীতের মধ্য দিয়ে। শেষে সংগীত পরিবেশন করেন ‘গান পোকা ব্যান্ড’–এর সদস্যরা। তার আগে অনুষ্ঠানের মাঝে কবিতা আবৃত্তি করেন প্রথমা প্রকাশনের সমন্বয়ক ও কবি জাভেদ হুসেন।