ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কথা বেশি, কাজ কম

সংক্রমণ ও মৃত্যু দুই–ই বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি আছে। ঠিক সময়ে ঠিক পদক্ষেপ নিতে দেখা গেল না।

দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কথা বেশি হচ্ছে; কিন্তু ডেঙ্গু সংক্রমণ কমছে না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে লাগাতার জোরালো কোনো কাজও দেখা যাচ্ছে না।

এই চিত্র ঢাকার দুই করপোরেশনসহ সারা দেশে। সর্বশেষ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস ডেঙ্গু নিয়ে যে তথ্য দিয়েছেন, তাতে মানুষ বিভ্রান্তিতে পড়েছেন। গত বুধবার তিনি বলেছেন, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে ঢাকা শহরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ৪২ হাজার কম ছিল।

যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, গত ২২ বছরের মধ্যে ২০২৩ সালে ঢাকা শহরে ডেঙ্গু রোগী ছিল সবচেয়ে বেশি, ১ লাখ ১০ হাজার ৮ জন। আর ২০১৯ সালে ছিল ৫১ হাজার ৮১০ জন।

আরও পড়ুন

দেশের ডেঙ্গু সংক্রমণ ও নিয়ন্ত্রণ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে জনস্বাস্থ্যবিদেরা মনে করেন, গত বছরের ভয়াবহ ডেঙ্গু পরিস্থিতি থেকে সরকারি কর্মকর্তারা বিশেষ কোনো শিক্ষা নেননি। ডেঙ্গু প্রতিরোধের মূল দায়িত্ব স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের। আর ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার মূল দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু মন্ত্রণালয় দুটি বিষয়ের গুরুত্ব বুঝে ঠিকমতো কাজ করছে না।

গত বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি ছিল সবচেয়ে খারাপ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে গত বছর সারা দেশে প্রথম সাড়ে পাঁচ মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন ১ হাজার ২৯২ জন, মারা যান ১২ জন। একই সময়ে এ বছর আক্রান্ত হয়েছেন দ্বিগুণের বেশি। মারা গেছেন প্রায় তিন গুণ বেশি।

১ জানুয়ারি থেকে গতকাল ১৬ মে পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ৫৬৯ জন। মারা গেছেন ৩২ জন।

দেশের তাপমাত্রা কিছুদিন ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি ছিল। ওই তাপমাত্রায় ডেঙ্গুর মশা বাঁচতে পারে না। তাই কমিটিগুলো কিছুটা নিষ্ক্রিয় ছিল। তবে তাপমাত্রার পরিবর্তন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কমিটিগুলো সক্রিয় করা হচ্ছে।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. শের আলী

কমিটি আছে, মশাও আছে

এডিস মশা ডেঙ্গুর জীবাণু বহন করে। শহরে এডিস ইজিপটাই ও গ্রামে এডিস অ্যালবোপিকটাস ডেঙ্গু ছড়ায়। গ্রামের ও শহরের মশা নিধন ও নিয়ন্ত্রণের মূল দায়িত্ব স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মশা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ ও আলোচনা দেখা গেছে মূলত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে। মাঝেমধ্যে চট্টগ্রাম ও খুলনা সিটি করপোরেশনের বিষয়ে আলোচনা হয়। এর বাইরে দেশের বাকি অংশে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কী করছে, তা নজরে আসে না।

মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ রাজধানী থেকে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত মোট ৯ স্তরের ‘ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত অন্যান্য রোগ প্রতিরোধ’ কমিটি করেছে।

আরও পড়ুন

গতকাল বৃহস্পতিবার কমিটিগুলোর সক্রিয়তা বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. শের আলী প্রথম আলোকে বলেন, দেশের তাপমাত্রা কিছুদিন ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি ছিল। ওই তাপমাত্রায় ডেঙ্গুর মশা বাঁচতে পারে না। তাই কমিটিগুলো কিছুটা নিষ্ক্রিয় ছিল। তবে তাপমাত্রার পরিবর্তন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কমিটিগুলো সক্রিয় করা হচ্ছে।

চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বরগুনা, গাজীপুর, বরিশাল ও চাঁদপুর জেলায় আমরা কাজ করেছি। গত বছরের চেয়ে এ বছর এসব জেলায় মশার উপস্থিতি বেশি দেখতে পারছি। আমার ধারণা এ বছরও ডেঙ্গুর প্রকোপ বড় আকারে হবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার

চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রাকিব হাসান জানান, এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে ডেঙ্গু প্রতিরোধ কমিটির সভা হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে এ বছর গতকাল পর্যন্ত খুলনা জেলায় ১৮ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ১৭ জন সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন। যদিও খুলনায় এখনো ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়নি দাবি করে খুলনার জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফিন বলেন, ডেঙ্গু বিষয়ে আলাদা কোনো সভা হয়নি। তবে প্রতি মাসের আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকে ডেঙ্গু বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। সচেতনতা বাড়াতে প্রায় এক মাস ধরে খুলনা শহরে মাইকিং করা হচ্ছে।

বরিশাল জেলা প্রশাসক মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্রতি মাসে জেলা সমন্বয় কমিটির সভা হয়। সেখানে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তার ভিত্তিতে স্কুলে সচেতনতামূলক সভা, প্রচারপত্র বিতরণ, ভ্রাম্যমাণ আদালত কার্যক্রম, সিটি করপোরেশন ও পৌর এলাকায় মশার ওষুধ ছিটানো হয়।

তবে গবেষকেরা বলছেন, গত বছর গ্রাম এলাকায় যেভাবে ডেঙ্গুর রোগী দেখা গেছে, সেই তুলনায় এ বছর মশা নিয়ন্ত্রণ কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে না। ডেঙ্গু ও মশা নিয়ে গবেষণা করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বরগুনা, গাজীপুর, বরিশাল ও চাঁদপুর জেলায় আমরা কাজ করেছি। গত বছরের চেয়ে এ বছর এসব জেলায় মশার উপস্থিতি বেশি দেখতে পারছি। আমার ধারণা এ বছরও ডেঙ্গুর প্রকোপ বড় আকারে হবে।’

গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, প্রাথমিকভাবে ঢাকা শহরে মানুষ ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হওয়ার পর ডেঙ্গু সারা দেশে ছড়ায়। অনেকেই ধারণা করেন, ঢাকা শহরে ডেঙ্গু কম হলে সারা দেশেই কম হবে।

ঢাকার পরিস্থিতি

এ বছরের শুরু থেকে ঢাকা শহরে ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হচ্ছে। গতকাল পর্যন্ত ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৫০২ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছেন ১৭ জন। আর উত্তর সিটি করপোরেশনে শনাক্ত হয়েছে ৩৬৩ জন রোগী। এর মধ্যে মারা গেছেন ৩ জন।

গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, প্রাথমিকভাবে ঢাকা শহরে মানুষ ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হওয়ার পর ডেঙ্গু সারা দেশে ছড়ায়। অনেকেই ধারণা করেন, ঢাকা শহরে ডেঙ্গু কম হলে সারা দেশেই কম হবে।

তথ্য প্রকাশ করছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

ডেঙ্গু মশা বেশি থাকার অর্থ বেশি মানুষের ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা, বেশি মানুষের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঝুঁকি। স্বাস্থ্য বিভাগ দাবি করছে, হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসামগ্রীর যথেষ্ট মজুত আছে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরের হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসার কোনো তারতম্য নেই। কর্মকর্তারা বলেছেন, ঢাকা শহরের বাইরের ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আসার দরকার নেই।

এ বছর ইতিমধ্যে ৩২ জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যুর খবর দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। বিশেষজ্ঞরা দাবি করছেন, হাসপাতালে বিলম্বে আসার কারণে, ব্যবস্থাপনা ঠিক না হওয়ার কারণে, বয়স্ক রোগীর অন্য রোগ থাকার কারণে রোগীর মৃত্যু হয়। কী কারণে দেশে বেশি মৃত্যু হচ্ছে, তা মৃত্যু পর্যালোচনা থেকে জানা যায়।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসায় সফল হয়েছে এমন প্রমাণভিত্তিক পদক্ষেপ দরকার ছিল। কিন্তু স্থানীয় সরকার ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তা নেয়নি, সেই সক্ষমতা তাদের নেই, সক্ষমতা তৈরির প্রচেষ্টাও নেই।
জনস্বাস্থ্যবিদ বে-নজির আহমেদ

কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মৃত্যুর পর্যালোচনার তথ্য প্রকাশ করছে না। ২০২৩ সালে ঢাকার হাসপাতালে মারা যাওয়া ৯৪ জন রোগীর তথ্য পর্যালোচনা করেছে বিশেষজ্ঞদের একটি কমিটি। তারা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পর্যালোচনা প্রতিবেদন জমাও দিয়েছে। তবে সেই প্রতিবেদন প্রকাশ করছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক শেখ দাউদ আদনান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, খুব শিগগির মৃত্যু পর্যালোচনা প্রতিবেদনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে।

এক দিকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সারা দেশে মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি, অন্যদিকে ডেঙ্গুতে মৃত্যু কমানোর বাড়তি কোনো উদ্যোগ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে দেখা যাচ্ছে না। বৃষ্টি যত ঘনিয়ে আসছে, মানুষের মধ্যে ডেঙ্গু নিয়ে অস্বস্তি, উদ্বেগ তত বাড়ছে।

জনস্বাস্থ্যবিদ বে-নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসায় সফল হয়েছে এমন প্রমাণভিত্তিক পদক্ষেপ দরকার ছিল। কিন্তু স্থানীয় সরকার ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তা নেয়নি, সেই সক্ষমতা তাদের নেই, সক্ষমতা তৈরির প্রচেষ্টাও নেই। ডেঙ্গুকে দুই মন্ত্রণালয় হালকাভাবে নিয়েছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উচিত ছিল বড় শহরসহ সারা দেশে মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার করা। অন্যদিকে ডেঙ্গুতে মৃত্যু কমিয়ে আনার সম্ভাব্য সব ধরনের বিকল্প ব্যবস্থা বেছে নেওয়া।

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রামবরিশাল এবং প্রতিনিধি, খুলনা]