টাঙ্গাইল শাড়িসহ ৩ পণ্যের জিআই স্বীকৃতির আবেদন গেজেট আকারে প্রকাশিত

টাঙ্গাইল শাড়িসহ তিন পণ্যকে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আবেদন গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে। বাকি দুই পণ্য হলো গোপালগঞ্জের রসগোল্লা ও নরসিংদীর অমৃত সাগর কলা। শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) সূত্র আজ বৃহস্পতিবার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এ প্রতিষ্ঠানই জিআইয়ের অনুমোদন দেয়।

এখন থেকে দুই মাস এই গেজেট ডিপিডিটির ওয়েবসাইটে রাখা হবে। কারও যদি কোনো অভিযোগ না থাকে, তবে দুই মাস পর এসব পণ্যকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে।

ভারতের শিল্প মন্ত্রণালয় সম্প্রতি ‘বাংলার টাঙ্গাইল শাড়ি’ বা ‘টাঙ্গাইল শাড়ি অব বেঙ্গল’ নামে একটি শাড়িকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই উদ্যোগ বাংলাদেশে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি করে। টাঙ্গাইল শাড়ির ব্যবসায়ীসহ জিআই বিশেষজ্ঞ, আইনজ্ঞ, অধিকার কর্মীরা বলেন, টাঙ্গাইল শাড়ি বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য। ভারতে ‘টাঙ্গাইল’ নামে কোনো এলাকা নেই। তাই ভারতের উদ্যোগ অন্যায্য।

ভারতে টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই স্বীকৃতি দেওয়ার পরই সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো নড়েচড়ে বসে। এরপর দ্রুততার সঙ্গে টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শাড়ির জিআইয়ের আবেদন হয় গত মঙ্গলবার (৬ ফেব্রুয়ারি)। আর তা গ্রহণ করে সেদিনই অনুমোদন গেজেটের জন্য বিজি প্রেসে পাঠায় ডিপিডিটি।

আজ দুপুরে ডিপিডিটির পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) আলেয়া খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘টাঙ্গাইলের শাড়ি, গোপালগঞ্জের রসগোল্লা ও নরসিংদীর অমৃত সাগর কলার জিআইয়ের আবেদন গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে। এই তিন পণ্য এখন জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে বলেই ধরা যায়। তবে দুই মাস পর আমরা জিআইয়ের সার্টিফিকেট দেব।’

আজ ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’ নামে টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসনের আবেদন জার্নাল আকারে প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে টাঙ্গাইল শাড়ির বিশেষত্ব হিসেবে বলা হয়েছে, এ শাড়ি সম্পূর্ণ হাতে বুনন করা হয়। তবে বর্তমানে মেশিন তাঁতেও বুনন করা হয়ে থাকে। যমুনা, ধলেশ্বরী নদীর পার্শ্ববর্তী টাঙ্গাইল জেলা অবস্থিত হওয়ায় এখানকার জলবায়ু শাড়ি বোনার উপযোগী।

নদীর পানির বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্য সুতার প্রক্রিয়াজাতকরণ (যেমন সুতা রং করা, মাড় দেওয়া) ভালো হয় এবং রঙের স্থায়িত্বের পাশাপাশি কাপড়ের স্থায়িত্ব ও গুণগত মান বৃদ্ধি পায়।

শাড়ির পাড়ের নকশায় বৈচিত্র্য রয়েছে। শাড়ির পুরো বুননের পর পাড়ের ও জমিনের কিছু কিছু নকশা আলাদাভাবে হাতে বুনন করা হয়। এ শাড়ি আরামদায়ক একটি পরিধেয় বস্ত্র যা যেকোনো ঋতুর সময় পরিধান করার উপযোগী। বলা হয়েছে টাঙ্গাইল শাড়ি মার্জিত, রুচিশীল ও আভিজাত্যপূর্ণ।

টাঙ্গাইল শাড়ির ইতিহাস নিয়ে বলা হয়, ‘সনাতন ধর্মের বসাক সম্প্রদায়কে টাঙ্গাইল শাড়ির মূল কারিগর বলা হয়। মোগল আমলে যখন বিশ্বজুড়ে আমাদের মসলিনের জয়জয়কার, ঠিক তখন টাঙ্গাইলের বিভিন্ন অঞ্চলের বসাক তাঁতিদের মাধ্যমে টাঙ্গাইল শাড়ির বিকাশ ঘটেছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই তাঁতি গোষ্ঠীর একটি দল সিন্ধু অববাহিকা হয়ে ভারতের মুর্শিদাবাদ থেকে বাংলাদেশের রাজশাহী অঞ্চলে প্রবেশ করে। সেখানকার আবহাওয়া ততটা কার্যকরী না থাকার কারণে কিছু অংশ চলে আসে ঢাকার ধামরাইয়ে। তাদের নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিলে ভাগ হয়ে একদল চৌহাট্টা চলে আসে। ধামরাই এবং চৌহাট্টা থেকে কিছু তাঁতি আরও ভালো ও উপযুক্ত স্থান খুঁজতে খুঁজতে চলে আসেন এবং টাঙ্গাইল এসে টাঙ্গাইল শাড়ির কারিগরেরা স্থায়ীভাবে টাঙ্গাইল শাড়ি বুনন করেন। সে হিসাবে টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্পের ইতিহাস শত শত বছরের পুরোনো।’

জার্নালে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘পরে টাঙ্গাইলের বিভিন্ন জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় ও আনুকূল্যে তাঁতশিল্পের বিকাশ ঘটে। তাঁদের মধ্যে করটিয়ার জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নি, দেলদুয়ারের জমিদার আবদুল করিম গুজনবী, সন্তোষের জমিদার উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া বেশ কিছু ধনাঢ্য হিন্দু, মুসলিম ব্যবসায়ী এতে সম্পৃক্ত ছিলেন। সনাতন ধর্মের তাঁতিরা বসাক, পাল, নন্দী, বারাস, প্রামাণিক, সাধু, শীল, সরদার বিভিন্ন গোত্রের নামে পরিচিত। টাঙ্গাইলের কালীহাতি উপজেলায় মুসলিম তাঁতিদের সংখ্যাধিক্য দেখা যায়। তারা বসাকদের কাছ থেকেই তাঁতে শাড়ি বুননের কাজ শিখেছেন। দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল গ্রামের চণ্ডী গ্রামের বসাক পাড়া, কর্মকার পাড়া, মণ্ডল পাড়ায় তাঁতের সংখ্যা বেশি।’

কোনো দেশের নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মাটি, পানি, আবহাওয়ার প্রেক্ষাপটে সেখানকার জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলে সেটিকে সেই দেশের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে জিআই স্বীকৃতি খুব তাৎপর্যপূর্ণ।