দেশ স্বাধীন হয়েছে, মানুষ স্বাধীন হয়নি

পাকিস্তানের নৃশংস সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করে একাত্তরের এই দিনে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল এ দেশের সাধারণ মানুষ। তাদের বুকে ছিল মৃত্যুকে উপেক্ষা করার সাহস, অন্তরে মুক্তির স্বপ্ন। স্বাধীন দেশে বারবার পরাহত হয়েছে সেই স্বপ্ন। খোলা চোখে মুক্তিযুদ্ধের অবলোকন নিয়ে এই লেখা।

মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়োল্লাস, ১৯৭১ছবি: অমিয় তরফদার

১৯৭১ সালে একটি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম। ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছে ৫৩ বছর। মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম এখন বিলীয়মান প্রায়। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধ কেবলই ইতিহাস। সেই ইতিহাসের চর্চায় আছে নানান ধারা।

একাত্তর নিয়ে এ দেশের মানুষের মধ্যে আবেগ আছে, রাজনীতিও আছে। আছে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ। সব ছাপিয়ে সত্যটা তুলে আনা একটা বড়সড় চ্যালেঞ্জ।

একাত্তরের যুদ্ধ নিয়ে আছে নানান ব্যাখ্যা, ভাষ্য, উপলব্ধি। নানান দৃষ্টিকোণ থেকে এর বিচার-বিশ্লেষণ হতে পারে। যতই সময় পেরোবে, আবেগ থিতিয়ে আসবে, দৃষ্টিভঙ্গি স্বচ্ছ হবে, জানার আগ্রহ বাড়বে, আমরা ততই সত্যের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারব।

একাত্তর নিয়ে আলোচনা করতে গেলে কয়েকটি প্রশ্ন ভেসে ওঠে: এক. একাত্তর কি অনিবার্য ছিল, নাকি এটি চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ? দুই. ওই সময় মানুষ আসলে কী চেয়েছিল? কী ছিল জন-আকাঙ্ক্ষা? তিন. মানুষের কি স্বপ্ন পূরণ হয়েছে?

যুদ্ধের পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে জন-আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন ঘটাতে পারেনি। মোটাদাগে যদি সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথাই বলি, তারা সেই প্রতিশ্রুতি রাখেনি। তারা গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠিয়ে তিন বছরের মাথায় একদলীয় স্বৈরশাসন চালু করেছিল।

এ দেশের বেশির ভাগ মানুষ মুসলমান। ১৯৪০-এর দশকে ভারতে মুসলমানের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনের দাবি উঠেছিল। মানুষ দলে দলে মুসলিম লীগে যোগ দিয়েছিল। মূল দাবি একটাই, মুসলমানের দেশ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এরপর অনেক মানুষ খুন হলো। অনেকেই এক কাপড়ে দেশত্যাগ করল। আমরা পাকিস্তান পেলাম।

পাকিস্তান রাষ্ট্রটি শুরুতেই হোঁচট খায়। রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের উঠতি বাঙালি মধ্যবিত্তের মধ্যে দ্রোহের সূচনা হয়। এই একটি প্রশ্নে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয় ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে।

১৯৫০ সাল থেকেই পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে বাঙালি মধ্যবিত্ত মুখর ছিল। মানুষের মনে একটা ধারণা গেঁথে গিয়েছিল, পাকিস্তানের শাসকেরা বাঙালির প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করছে। দেশে দুই অর্থনীতির জন্ম হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্পায়ন ও নগরায়ণ হচ্ছে, আর পূর্ব পাকিস্তান অনুন্নতই থেকে যাচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে সম্পদ পাচার হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে যাচ্ছে। এই ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য আমলানির্ভর একটা রাজনৈতিক ‘অলিগার্কি’ বা গোষ্ঠী কাজ করে যাচ্ছে। অলিগার্কিতে গণতন্ত্র বিকশিত হয় না।

এ দেশে ১৯৬০–এর দশকে দুটি নির্বাচন হলেও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে দেশের মানুষ যথাযোগ্য সুযোগ পায়নি। রাজনীতিবিদেরা বোঝালেন, একটা সত্যিকারের প্রতিনিধিত্বমূলক সংসদীয় ব্যবস্থা চালু হলে গণতন্ত্র আসবে। মানুষ খেয়েপরে বাঁচবে। ১৯৬০–এর দশকজুড়ে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন–সংবলিত একটা ফেডারেল কাঠামোর ভেতরে সংসদীয় গণতন্ত্রের চর্চা করতে চেয়েছে। সেটি হয়নি।

শহরের মধ্যবিত্ত, বিশেষ করে ছাত্র, বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীরা ছিলেন স্বায়ত্তশাসন ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কেন্দ্রে। তাঁরাই ছিলেন ‘অপিনিয়ন মেকার’। তাঁরা জনমত তৈরি করেছিলেন। তাঁরা যা চান, মানুষ তাঁদেরকেই অনুসরণ করে। এটাই হয়ে আসছে। সেটি প্রতিফলিত হয়েছিল আওয়ামী লীগের রাজনীতির মধ্যে। কিছু ‘ক্ল্যান্ডেস্টাইন গ্রুপ’ বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবিতে তৎপরতা চালালেও এ দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতরেই যতটুকু পারা যায় একটা যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার অধীনে স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিল।

আওয়ামী লীগের স্বায়ত্তশাসনের যে ফর্মুলা, তাঁর চূড়ান্ত রূপ ছিল ছয় দফা। ১৯৬৬ সালে ছয় দফার জন্ম হলেও ১৯৭০ সালে এটি পরিমার্জিত হয়। ১৯৪০ সালের ‘লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে’ স্বায়ত্তশাসনের দাবিটি পরিমার্জন করে ছয় দফার এক নম্বর দফা থেকে ‘লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে’ শব্দগুলো বাদ দেওয়া হয়। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ছয় দফার ওপর ম্যান্ডেট চায় এবং পূর্ব পাকিস্তানে একচেটিয়া জয় পায়। ফলে পাকিস্তানের শাসকদের সঙ্গে আলোচনা ও দর-কষাকষির অধিকার পায় আওয়ামী লীগ।

ছয় দফা নিয়ে অচলাবস্থা তৈরি হয়। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার, বিশেষ করে সেনাবাহিনীর খরচ কে জোগাবে—এ নিয়ে সেনাবাহিনী চিন্তায় পড়ে যায়। নির্বাচনে বিপুল জয় পেয়ে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে ওঠেন অনমনীয়। এই পরিস্থিতিতে একাত্তরের ৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করা হলে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ ক্ষুব্ধ হয়। ১ মার্চ জনতা পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। শেখ মুজিব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ দুইভাগে ভাগ করে ‘কনফেডারেশন অব পাকিস্তান’-এর অধীনে প্রতিটি ইউনিটের জন্য আলাদা সংবিধান এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব দেন। শেখ মুজিব আশা করেছিলেন, একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এই প্রস্তাব অনুযায়ী ঘোষণা দেবেন এবং এতে সাংবিধানিক সংকট কেটে যাবে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তাতে সম্মত না হয়ে একটি সীমিত ও প্রচণ্ড সামরিক অভিযানের নির্দেশ দেন।

২৫ মার্চ মাঝরাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর শুরু হয় সামরিক অভিযান। শেখ মুজিব গ্রেপ্তার বরণ করেন (কোর্টেড অ্যারেস্ট)। তিনি স্বাধীনতা ঘোষণার ঝুঁকি নেননি। কিন্তু তাঁর সহকর্মীরা গ্রেপ্তার এড়িয়ে ভারতে চলে যান এবং একটি প্রবাসী সরকার গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের আহ্বান জানান। পাকিস্তানি সৈন্যদের অব্যাহত আক্রমণ, নির্যাতন ও গণহত্যার কারণে মানুষের কাছে স্বাধীনতার আর কোনো বিকল্প থাকল না। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।

বাঙালি যুদ্ধ চায়নি। যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। একই সঙ্গে আরও একটি ঘটনা ঘটে। ভারত সীমান্ত খুলে দেয়। রাজনীতিবিদ ও শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়। বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারকে তৎপরতা চালাতে দেয়, তরুণদের সশস্ত্র যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেয় এবং তাঁদেরকে সীমিত পরিমাণ অস্ত্র দেয়। ফলে মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্যভাবেই ভারতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ভারত বসে যায় চালকের আসনে। ডিসেম্বরের শুরুতে ভারতের সশস্ত্র বাহিনী সরাসরি যুদ্ধে যোগ দেয়। বাংলাদেশের যুদ্ধ হয়ে যায় ভারতেরও যুদ্ধ। একজন ভারতীয় জেনারেলের অধীনে ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের একক কমান্ড প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ভারতীয় জেনারেলরাই ছিলেন পাদপ্রদীপের আলোয়। ভারত–পাকিস্তানসহ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রচারিত হয়, যুদ্ধে পাকিস্তানকে ভারত হারিয়ে দিয়ে বাংলাদেশ তৈরি করে দিয়েছে।

পাকিস্তানের বয়ান ছিল, এটা আসলে একটা গৃহযুদ্ধ। কিছু বিষয়ে মতপার্থক্যের মীমাংসা না হওয়ায় মুসলমান মুসলমান ভাইয়ে ভাইয়ে ভুল–বোঝাবুঝি হয়েছে। এই সুযোগে ভারত হস্তক্ষেপ করে পাকিস্তান ভেঙে দিয়ে একটি তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে।

আসলে কী ঘটেছিল? খোলা মন নিয়ে বিষয়টি খতিয়ে দেখা যাক। একাত্তরে গৃহযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ, ভারতীয় হস্তক্ষেপ—তিনটি উপাদানই কমবেশি ছিল। ভারত সীমান্ত খুলে না দিলে এবং তাজউদ্দীন ও অন্যরা ভারতে গিয়ে একটা সরকার গঠন না করলে এটা গৃহযুদ্ধের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে পারত এবং একটা পর্যায়ে পাকিস্তানের সামরিক চক্র শেখ মুজিবের সঙ্গে আপসরফায় আসতে পারত। ২৫ মার্চ রাতে শেখ মুজিবের ভূমিকা দেখলে এই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে, যুদ্ধের একপর্যায়ে পাকিস্তান সরকার জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের অনেক বাঙালির সদস্যপদ বাতিল করে উপনির্বাচন দিয়েছিল। এটা বিস্ময়কর যে শেখ মুজিবের সদস্যপদ বহাল ছিল। তিনি সম্ভবত ছিলেন পাকিস্তানিদের শেষ ভরসা।

২৫ মার্চ রাতে যে পর্যায়ে আক্রমণ ও গণহত্যা শুরু হয়েছিল, তখন সশস্ত্র প্রতিরোধ ছাড়া উপায় ছিল না। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা বিদ্রোহ করে বেরিয়ে এসেছিলেন, শুরু করেছিলেন প্রতিরোধযুদ্ধ। আরও ছিলেন আধা সামরিক বাহিনী ইপিআর ও পুলিশের বাঙালি সদস্যরা। তাঁদের ফেরার উপায় ছিল না। যুদ্ধ ছাড়া তাঁদের সামনে আর কোনো বিকল্প ছিল না।

এই যুদ্ধ ভারতের সামনে এনে দিয়েছিল তার চিরশত্রু পাকিস্তানকে ভেঙে দুর্বল করার এক মহাসুযোগ। ভারত সেই সুযোগটি ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছিল। যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হোক, এটা ভারত চায়নি। তার সুবিধামতো সময় ভারতের সামরিক বাহিনী বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে এবং পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের এক সপ্তাহের মধ্যে মুজিবনগর সরকার ঢাকায় চলে আসে।

ফলে সমীকরণটা কেমন দাঁড়ায়? নৃশংসতার কারণে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ছিল পুরোপুরি জনবিচ্ছিন্ন। মানুষ চেয়েছিলেন তাদের হাত থেকে মুক্তি। পাকিস্তানের পরাজয় ছিল শুধু সময়ের ব্যাপার।

১৬ ডিসেম্বর মানুষ মুক্তি পেলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। ভারত চেয়েছিল পাকিস্তানকে দুর্বল করে এ অঞ্চলে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। ভারতের লক্ষ্যও অর্জিত হলো। ভারত উপরি পাওনা হিসেবে পেল বাংলাদেশকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করার সুযোগ। এ জন্য তাদের দরকার ছিল একটি সমর্থক গোষ্ঠী। আওয়ামী লীগ ও সমমনাদের মধ্যে ভারত তা পেয়ে যায়। পাকিস্তানিদের সঙ্গে যদি বাঙালি নেতাদের একটা নিষ্পত্তি হয়ে যেত, তাহলে ভারত সে সুযোগটি পেত না। যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন প্রশাসন এমনটিই চেয়েছিল। যুদ্ধ চলাকালে মুজিবনগর সরকারের কয়েকজন প্রতিনিধির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দূতিয়ালিতে যে আলাপ–আলোচনা হয়েছে এবং ডিসেম্বরে জাতিসংঘে যে কূটনৈতিক লড়াই চলেছে, তাতে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে ভারত যেকোনোভাবে যুদ্ধবিরতি ঠেকিয়ে সময়মতো তার অবসান
ঘটাবে।

সবাই স্বাধীনতা চেয়েছিলেন, বিষয়টি এত সরল নয়। কয়েকটি রাজনৈতিক দল স্থিতাবস্থা চেয়েছিল। তাদের মধ্যে ছিল পিডিপি, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলাম পার্টি। তারা আওয়ামী লীগের মধ্যে কর্তৃত্ববাদ এবং তার ওপর ভর করে ভারতীয় আধিপত্যের আশঙ্কা করেছিল। তারা পাকিস্তান সরকার ও সামরিক বাহিনীর তাবৎ কর্মকাণ্ড সমর্থন করেছিল ও সহযোগিতা দিয়েছিল। তারা ওই সময়ের জন-আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু তাদের যে আশঙ্কা ছিল, ৫৩ বছর পর আমরা তার প্রতিফলন দেখতে পাই।

আমরা দেখি, যুদ্ধের পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে জন-আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন ঘটাতে পারেনি। মোটাদাগে যদি সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথাই বলি, তারা সেই প্রতিশ্রুতি রাখেনি। তারা গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠিয়ে তিন বছরের মাথায় একদলীয় স্বৈরশাসন চালু করেছিল। এক সেনা অভ্যুত্থানে সেটি উৎখাত হয়েছিল। অনেক বছর পর ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এক নির্বাচনে জয়ী হয়ে ওই নির্বাচনব্যবস্থা সংবিধান থেকে মুছে ফেলে এবং কাগজে-কলমে বহুদলীয় সরকারব্যবস্থার ছদ্মাবরণে চালু করে একটি ফ্যাসিস্ট পারিবারিক শাসন। এর সমর্থন দিয়ে যায় ভারত। এ রকম যে হবে, পাঁচ দশক আগে যাঁদের এই শঙ্কা ছিল, তাঁদের একাত্তরের মানবতাবিরোধী কার্যক্রমকে কোনোভাবেই বৈধতা দেওয়া যায় না। বলা যায়, ফ্যাসিবাদ বারবার ফিরে আসে, ভিন্ন ভাষায়, ভিন্ন লেবাসে। একাত্তরে এটি ছিল নয় মাস, পরে দেখেছি ১৫ বছর।

গণতন্ত্র নিয়ে আমাদের ধারণা ভাসা–ভাসা। এটি এসেছে টেমস নদীর পার থেকে ইংরেজদের হাত ধরে। আমাদের সমাজ অনেক পশ্চাৎপদ। আধুনিক ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও চিন্তাচেতনার সঙ্গে তার অনেক ফারাক। এখানে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা নিয়েই যুদ্ধ হয়। এরপরও মোটাদাগে আমরা বলতে পারি, আমরা এমন একটি প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার চাই, যেখানে আমরা নিজেরাই আমাদের প্রতিনিধি ইচ্ছামতো বাছাই করব এবং আমাদের প্রতিনিধিরা আমাদের দেওয়া তাঁদের প্রতিশ্রুতি রাখবেন।

দরকার ছিল একটি স্বচ্ছ নির্বাচনব্যবস্থা এবং একটি জবাবদিহিমূলক সরকারের। এটি হলেই আমরা ‘সুশাসন’ পেতাম। এটি হয়নি। একটা মাফিয়া চক্র নির্বাচনব্যবস্থাকে কলুষিত করেছে এবং জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন না করে তাদের চোখরাঙানি দিয়ে গেছে। এদিক থেকে বিচার করলে বলা যায়, আমরা ৫৩ বছর ধরেই প্রতারিত হয়ে আসছি। দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু মানুষ স্বাধীন হয়নি। মানুষের স্বপ্নভঙ্গ
হয়েছে বারবার, কিন্তু স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা রয়েই গেছে।

  • মহিউদ্দিন আহমদ: বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের গবেষক