যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে পাশে থাকবে বেসরকারি খাত

দেশে যক্ষ্মার বোঝা এখনো অনেক বড়। দরকার নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে বেসরকারি খাতকে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকা।

(ওপরে বাম থেকে) আবদুল মোক্তাদির, এ এম শামীম, আসিফ মুজতবা মাহমুদ, জাহাঙ্গীর কবির

দেশে যক্ষ্মা অনেক পুরোনো রোগ। এই রোগ নিয়ন্ত্রণে বহু বছর ধরে দেশে কাজ হচ্ছে। এখনো প্রতিদিন এক হাজারের বেশি মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়; আর দৈনিক যক্ষ্মায় মারা যায় ১১৫ জন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের একার পক্ষে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ বা নির্মূল করা সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার যক্ষ্মা কর্মসূচিতে বেসরকারি খাতের সক্রিয় অংশগ্রহণ।

গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক গোলটেবিল বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা এ কথাগুলো বলেন। ‘যক্ষ্মা চিকিৎসায় বেসরকারি খাতের ভূমিকা’ শীর্ষক এই গোলটেবিল বৈঠক স্টপটিবি পার্টনারশিপের সহযোগিতায় যৌথভাবে আয়োজন করে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ও প্রথম আলো। জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির কর্মকর্তা ছাড়াও বৈঠকে অংশ নেন বিশেষজ্ঞ যক্ষ্মা চিকিৎসক, ওষুধ শিল্প সমিতির সভাপতি, একাধিক বেসরকারি হাসপাতালের মালিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক।

অনুষ্ঠানে সরকার যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে কী করছে তার বর্ণনা যেমন পাওয়া যায়, তেমনি জানা যায়, এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ বা সমস্যা আছে। একাধিক বেসরকারি হাসপাতালের প্রতিনিধি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, বেসরকারি খাতকে যক্ষ্মা কর্মসূচিতে যুক্ত করার কথা এই প্রথম তাঁরা শুনছেন। ওষুধ কোম্পানির মালিকেরা বলেন, যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে তাঁরা সরকারের পাশে থাকবেন।

যক্ষ্মা পরিস্থিতি

অনুষ্ঠানের শুরুতে বিশ্বের ও দেশের যক্ষ্মা পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা দেন আইসিডিডিআরবির যক্ষ্মা কর্মসূচির ডেপুটি চিফ অব পার্টি শাহরিয়ার আহমেদ। তিনি বলেন, যক্ষ্মা নীরব মহামারি হয়ে আছে। দেশে প্রতিবছর ৪২ হাজার মানুষ যক্ষ্মায় মারা যায়। অর্থাৎ দৈনিক মারা যায় ১১৫ জন। অথচ দেশে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি শুরু হয়েছিল ১৯৬৫ সালে। বিশ্বের যে দেশগুলোতে যক্ষ্মা বেশি, এমন ৩০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে।

শাহরিয়ার মাহমেদ বলেন, দেশে যক্ষ্মায় আক্রান্ত শিশুরা শনাক্ত হচ্ছে কম, দেশে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মায় আক্রান্ত রোগী বাড়ছে এবং দেশে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি অর্থায়ন–সংকটে ভুগছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে বেসরকারি খাতের সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য। তিনি আরও বলেন, সত্যিকার অর্থে একটি সামাজিক আন্দোলন ছাড়া যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে লক্ষ৵মাত্রা অর্জন করা সম্ভব নয়।

সরকার কী করছে

যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে সরকার কী করেছে, এ ক্ষেত্রে সাফল্য কী তা নিয়ে বক্তব্য দেন জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির (এনটিপি) কর্মসূচি ব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর কবির। বিভিন্ন পরিসংখ্যান উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, দেশে যক্ষ্মায় মৃত্যু কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। শুধু শহরে নয়, যক্ষ্মা শনাক্ত করার আধুনিক যন্ত্রের সুফল গ্রামের মানুষও পাচ্ছে।

শিশুদের যক্ষ্মা শনাক্ত করতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে উল্লেখ করে জাহাঙ্গীর কবির বলেন, ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মায় আক্রান্ত রোগী এখন বাড়িতে বসে চিকিৎসা নিতে পারে।

এই সরকারি কর্মকর্তা বলেন, বেসরকারি খাতকে জাতীয় কর্মসূচিতে যুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বেশ কিছু বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যক্ষ্মা শনাক্তের আধুনিক যক্ষ্মা জিনএক্সপার্ট দেওয়া হয়েছে। বেসরকারি খাতের চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে। ব্র্যাক, আইসিডিডিআরবি, ডেমিয়েন ফাউন্ডেশন, ওয়ার্ল্ডভিশনের মতো অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে বহু বছর ধরে সরকারের সঙ্গে কাজ করে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

বেসরকারি খাতের অবস্থান

ল্যাবএইড হাসপাতাল ও ল্যাবএইড ফার্মার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এম শামীম বলেন, ‘৩৫ বছর ধরে স্বাস্থ্য খাতে কাজ করছি; কিন্তু সরকার কোনো দিন যক্ষ্মার বিষয়ে কাজ করার জন্য ডাকেনি। তিনি বলেন, ভারতে যক্ষ্মা শনাক্ত হতে গড়ে ১৩ দিন সময় লাগে, বাংলাদেশে সময় লাগে ৪৭ দিন। বাংলাদেশে যক্ষ্মা চিকিৎসার ব্যয় ভারতের চেয়ে বেশি।

জাপান–বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান সরকার এ নাঈম বলেন, সরকারি হাসপাতালে বিনা মূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার ধারণাটি ভুল। সরকারি হাসপাতালের রোগীদের পেছনে যে ব্যয় হয়, তা ট্যাক্সের টাকায় বা অন্য কোনো উৎস থেকে আসে। তিনি বলেন, চিকিৎসাসেবার দুই–তৃতীয়াংশ আসে বেসরকারি খাত থেকে। অথচ নানা ধরনের ভয়ভীতির মধ্যে তাঁদের থাকতে হয়।

আলোচনায় অংশ নিয়ে এভারকেয়ার হাসপাতালের পরিচালক (স্বাস্থ্যসেবা) আরিফ মাহমুদ বলেন, কোভিড মহামারির সময় সরকারের সঙ্গে বেসরকারি খাত কাজ করেছিল। ডেঙ্গু নিয়েও সরকারের সঙ্গে কাজ করে বেসরকারি হাসপাতালগুলো। যক্ষ্মা নিয়েও কাজ করা সম্ভব।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন দুজন যক্ষ্মারোগবিশেষজ্ঞ। ইউনাইটেড হাসপাতালের সিনিয়র কনসালট্যান্ট আসিফ মুজতবা মাহমুদ বলেন, বেসরকারি হাসপাতালের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে, যেন তারাও সাধারণ যক্ষ্মার ও ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মার রোগীদের চিকিৎসা দিতে পারে। জনসচেতনতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিয়ে আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কনসালট্যান্ট আবদুস শাকুর খান বলেন, বেসরকারি খাতকে সংযুক্ত করার নীতিমালা থাকতে হবে, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক বা বন্ধন বাড়াতে হবে। অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো কাজ করার এখনই উপযুক্ত সময়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, রোগ শনাক্ত, রোগীর চিকিৎসা ও জাতীয় কর্মসূচি—এই তিন ক্ষেত্রে বেসরকারি খাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।

পাশে থাকবে ওষুধশিল্প

বাংলাদেশ ওষুধশিল্প সমিতির প্রেসিডেন্ট এবং ইনসেপ্‌টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল মোক্তাদির বলেন, দেশের ওষুধশিল্পের সক্ষমতা আছে যক্ষ্মার ওষুধ তৈরি করার। যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে ওষুধশিল্পকে যুক্ত করলে তারা স্বল্প মূল্যে দেশের মানুষকে ওষুধ দিতে পারবে।

আলোচনা অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে আইসিডিডিআরবির সিনিয়র টিবি মিটিগেশন অ্যান্ড কোঅর্ডিনেটর অ্যাডভাইজার আজহারুল ইসলাম খান বলেন, বেসরকারি খাত ওষুধ, রোগ শনাক্তকরণ, চিকিৎসা ও অর্থায়নের মাধ্যমে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পারে। এই অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।