ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের ফটোফিচারে কক্সবাজার সৈকত
বিশ্বখ্যাত সাময়িকী ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের চলতি সেপ্টেম্বর সংখ্যার পাতা ওলটাতে ওলটাতে একেবারে শেষ দিকে হঠাৎ এক হাওয়াই মিঠাইওয়ালার বড়সড় ছবি চোখে পড়ল। বাংলাদেশের ছবি মনে হলো। পৃষ্ঠা খুলে চোখে পড়ল শিরোনাম ‘আ বিচ ফর অল’। এ তো আমাদের কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত! ১২৬ থেকে ১৩৪ পৃষ্ঠাজুড়ে মোট ৯টা ছবি নিয়ে ফটোফিচার, সঙ্গে লেখা। আলোকচিত্রীর নাম ইসমাইল ফেরদৌস। বাংলাদেশি আলোকচিত্রী, থাকেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে। লেখাটা লিখেছেন নিনা স্ট্রচলিক, তিনি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের নিজস্ব লেখক।
ফটোফিচারে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে প্রৌঢ় দম্পতি ঝিনুক কুড়াচ্ছেন, পাশে একই কাজ করছেন তরুণ দম্পতিও। লাল শাড়ি পরা নতুন বউ, সঙ্গে বর। হাওয়াই মিঠাইওয়ালা, খেলনা বিক্রেতা, দুই পুলিশ সদস্য, কুকুর, ঘোড়সওয়ার, ফুল বিক্রেতা, কয়েকটি গরুর বিশ্রাম—এই সব ছবিই রয়েছে, সবই সহজ–সরল। দেখেই মনে হয়—সমুদ্রসৈকতে বেড়ানোর এক সর্বজনীন গল্প উঠে এসেছে ফটোফিচারে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির মাসিক সাময়িকী ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক প্রকাশিত হচ্ছে ১৩৪ বছর ধরে (প্রথম সংখ্যার প্রকাশকাল: ২২ সেপ্টেম্বর ১৮৮৮)। ১৯০৫ সাল থেকে এতে ছবি ছাপানো শুরু হয়। প্রথম রঙিন ছবি ছাপা হয় ১৯১০ সালে। ধীরে ধীরে এটি বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের জনপ্রিয়তার পেছনে ফটোসাংবাদিকতার বড় ভূমিকা রয়েছে।
কক্সবাজার নিয়ে এমন ছবি তোলার কথা মাথায় এল কীভাবে, এটা ছিল ২০ সেপ্টেম্বর রাতে হোয়াটসঅ্যাপে ইসমাইল ফেরদৌসের কাছে প্রথম প্রশ্ন। ইসমাইল বললেন, ‘যেকোনো বাংলাদেশিকে যদি জিজ্ঞেস করেন, জীবনে একবার হলেও কোথায় বেড়াতে যেতে চান, তবে উত্তরটা হবে, কক্সবাজারে। এখানে ৬৪ জেলার মানুষের ভাষা শুনতে পাবেন। কক্সবাজার আসলে বাংলাদেশের মানুষের বেড়ানোর গন্তব্য। সবার জন্যই এই সৈকত। এ থেকে এই প্রজেক্টের ধারণা আমার মাথায় আসে।’
এক দশক ধরে দেশের বাইরে ইসমাইল ফেরদৌস। করোনা মহামারির ঠিক আগে ২০২০ সালে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার হয়ে কক্সবাজারে আসেন। কাজের বিষয় ও জায়গা রোহিঙ্গা ক্যাম্প। রোহিঙ্গাদের নিয়ে ২০১৭ সাল থেকেই ছবি তুলছেন। এ দফায় রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করতে করতে দু–তিন দিনের ফাঁকা সময় পেলেন। ইসমাইল বলেন, ‘ভাবলাম, একটু সৈকতে যাই। পাঁচ বছর বয়সে মা–বাবার সঙ্গে প্রথম কক্সবাজারে এসেছিলাম বেড়াতে। ২০১৭ সাল থেকে কাজের জন্য আসি কিন্তু সৈকতে যাওয়া হয়নি।’
২০২০ সালের জানুয়ারিতে যখন কক্সবাজার সৈকতে গেলেন ইসমাইল ফেরদৌস, তখন তাঁর কাছে সৈকতটা অন্য রকম লাগল। ‘আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের পরিচয় এই সৈকত। আমার অনুভূতি এমনই এই জায়গার প্রতি। ছবি তোলা শুরু করি। দু–তিন দিনই মাত্র ছবি তুলেছি,’ বললেন ইসমাইল।
এরপর করোনা মহামারি শুরু হলো। নিউইয়র্কে ফিরে গিয়ে সবার মতোই ঘরবন্দী ইসমাইল ফেরদৌস। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে ফিরে আসার পাঁচ–ছয় মাস পর কক্সবাজারে তোলা ছবিগুলো দেখতে থাকি। তখন মনে হলো, আমি পেয়েছি। ১০–১২টা ছবি বাছাই করে আমার বন্ধুস্থানীয় কয়েকজন ফটো এডিটরের কাছে পাঠাই। তাঁরা বলেন, নতুন কিছু।’
এই ‘নতুন কিছু’ বলার কারণটা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকে ফটোফিচারের সঙ্গে লেখার সূচনাতেই পাওয়া গেল। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এখন কক্সবাজারের পরিচয় হয়ে উঠেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থীশিবিরের স্থান হিসেবে। ইসমাইল বলেন, ‘আমি তো অনেক দিন পশ্চিমে আছি। এখানকার লোকজনের কাছে কক্সবাজারের পরিচিতি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কারণে। তবে আমরা বাংলাদেশের মানুষেরা জানি, কক্সবাজার পৃথিবীর দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন সমুদ্রসৈকত। বিদেশিদের কাছে এ বিষয়টাই নতুন।’
২০২১ সালের নভেম্বর–ডিসেম্বরে আবার ইসমাইল ফেরদৌস এলেন কক্সবাজারে। সপ্তাহ দুয়েক থাকলেন। এবার তাঁর লক্ষ্য সৈকতের ছবি। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির আগে আগে আবার কাটালেন দুই সপ্তাহ।
ইসমাইল ফেরদৌস ফটোসাংবাদিক। ছবি তোলার প্রতি তাঁর ভালোবাসা প্রগাঢ়। মুক্ত পেশাজীবী বা ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করেন। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের তিনি একজন নিয়মিত প্রদায়ক আলোকচিত্রী, পত্রিকাটি যাঁদের ‘এক্সপ্লোরার’ হিসেবে পরিচয় দেয়। কক্সবাজার থেকে ফিরে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকে ছবিগুলো দেন ইসমাইল। সেসবই ছাপা হলো সাময়িকীটির সেপ্টেম্বর ২০২২ সংখ্যায়।
ইসমাইল ফেরদৌস এখন ফরাসি সংবাদ সংস্থা অ্যাঁজস ভুর সঙ্গে কাজ করেন। যেহেতু ফ্রিল্যান্সার, তাই বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন, কাজ করছেন। এ তালিকায় আছে নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, ব্লুমবার্গ, ওয়াশিংটন পোস্ট, ইকোনমিস্ট, ল্য মঁদ, গার্ডিয়ান ইত্যাদি।
১৯৮৯ সালের ২ জানুয়ারি ঢাকার খিলগাঁওয়ে জন্ম নেওয়া ইসমাইল ফেরদৌস জানালেন, তিনি ছবি তুলছেন ১০ বছর ধরে। ঢাকায় ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ পড়ার সময় ছবি তোলার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটোগ্রাফি ক্লাবের এক প্রদর্শনী দেখে। প্রথম কাজ সাতক্ষীরায় জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে। ১০ বছর আগে পাড়ি জমান মধ্যপ্রাচ্যে। এরপর ইউরোপ, তারপর যুক্তরাষ্ট্রে। রানা প্লাজা দুর্ঘটনা নিয়ে ২০১৩ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। চলিত বছর সম্মানজনক ওয়ার্ল্ড প্রেস, ইউএস পুরস্কার পেয়েছেন ইসমাইল।
ইসমাইল জানালেন, যুক্তরাষ্ট্রের মাংস প্রক্রিয়াকরণশিল্পে অভিবাসীরা কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘আমি নিজেও অভিবাসী। তাই এই সিরিজে আমি মাংস প্রক্রিয়াকরণ কারখানায় কাজ করা নানা দেশ থেকে আসা অভিবাসীদের পোর্ট্রেট তুলেছি।
সিরিজটায় আমি বলতে চেয়েছি, দেখো এঁরাই তোমার জন্য খাবার তৈরি করে।’
চলতি বছরের শেষ দিকে আবার আসবেন বাংলাদেশে। জানালেন, কক্সবাজারের ছবিগুলো নিয়ে সারা দেশে প্রদর্শনী করতে চান। এসব নিয়ে নিজের প্রথম আলোকচিত্রের বই প্রকাশের আগ্রহ রয়েছে তাঁর। পাশাপাশি আগামী বছরে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আরও ছবি তুলতে চান। ইসমাইল ফেরদৌসের ইচ্ছা, ভবিষ্যতে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা। সেটা হতে পারে প্রামাণ্যচিত্র কিংবা কাহিনিচিত্র।