ড. ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সফল হলেই ভারতের স্বার্থ রক্ষিত হবে: ভারতীয় ব্যবসায়ী
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সফল হলেই ভারতের সর্বোত্তম স্বার্থ সুরক্ষিত হবে বলে মনে করেন ভারতীয়-আমেরিকান বিশিষ্ট ব্যবসায়ী বিনোদ খোসলা। ২৭ অক্টোবর ভারতীয় গণমাধ্যম দ্য ওয়্যারে তাঁর লেখা একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেখানেই তিনি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অধীনে বাংলাদেশ কীভাবে একটি সফল রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে এবং ভবিষ্যতে প্রতিবেশী ভারতের একটি শক্তিশালী মিত্র হয়ে উঠতে পারে, তা তুলে ধরেন।
নিবন্ধে বিনোদ খোসলা বলেন, ‘মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বকে ঘিরে বাংলাদেশে যে ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, একজন গর্বিত আমেরিকান ও ভারতের সন্তান হিসেবে আমি তা নিয়ে আশাবাদী।’
গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার তিন দিন পর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে শপথ নেন।
খোসলা বলেন, ‘ইউনূস, যাকে আমি বন্ধু মনে করি এবং কয়েক দশক ধরে চিনি, শিক্ষার্থী আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা ছাত্রদের অনুরোধে তিনি এ দায়িত্ব গ্রহণ করেন।’
এই ব্যবসায়ী নিজেকে একজন উদ্যোক্তা, নতুন চিন্তাভাবনার শক্তিতে বিশ্বাসী এবং স্থায়িত্ব ও প্রভাব নিয়ে বেশ উৎসাহী উল্লেখ করে বলেন, ‘ইউনূস তাঁর জীবনে যা কিছু অর্জন করেছেন, তাতে আমি বিস্মিত। আমি আমার বিনিয়োগের মাধ্যমে বিশ্বে সবার জীবনকে উন্নত করবে, এমন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করি।’ বিনোদ খোসলা বলেন, ড. ইউনূস অবিরাম পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাস, স্বাস্থ্যসেবাকে উন্নত, শিক্ষার ইতিবাচক প্রভাব ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য একগাদা প্রাতিষ্ঠানিক সাফল্যের মডেলগুলো তৈরি করেছেন।
বিনোদ খোসলা উল্লেখ করেন যে ১৯৯৬ সালে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে কয়েক হাজার দরিদ্র নারীর হাতে মুঠোফোন তুলে দিতে সফল হয়েছিলেন। যাতে তাঁরা নিজ উদ্যোগে অর্থ উপার্জন করতে পারেন।
নিবন্ধে বলা হয়, ‘আমি পরিবেশ রক্ষায় বেশ উত্সাহী। অধ্যাপক ইউনূস ১৯৯৫ সালে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন, যেটি ১ দশমিক ৮ মিলিয়ন সোলার হোম সিস্টেম এবং ১ মিলিয়ন ক্লিন কুক স্টোভ স্থাপন করেছে। এটিও মূলত বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলেই হয়েছে।’
এতে বলা হয়, গ্রামীণ ব্যাংকের অবদানও এখানে স্মরণীয়, যা ১ কোটির বেশি দরিদ্র নারীকে ৩ হাজার ৯০০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দিয়েছে। এই ক্ষুদ্রঋণ থেকে অনেকেই উপার্জনের পথ খুঁজে পেয়েছেন। ভারত ও অন্যান্য অনেক দেশেও একই মডেলে কাজ হয়েছে।
নিবন্ধে বলা হয়, জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম দেশ বাংলাদেশ, যেখানে ১৭০ মিলিয়নের (১৭ কোটি) বেশি মানুষ বাস করেন। এটি এমন একটি দেশ, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা বাস করে, অথচ যার আয়তন দেশটির ইলিনয় রাজ্যের সমান।
বিনোদ খোসলা বলেন, ‘বাংলাদেশ ও সারা বিশ্বে এমন অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা ইউনূসের সাফল্য কামনা করেন। আমি তাঁদের মধ্যে অন্যতম। কিন্তু এমন অনেকে আছেন, যাঁরা তাঁকে ও অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করতে চান; অনেকে তাঁর নেতৃত্ব নিয়ে মিথ্যা বয়ানও ছড়িয়ে যাচ্ছেন।’
ড. ইউনূসের মূল্যবোধ, তাঁর কর্মপদ্ধতি ও প্রাথমিকভাবে তাঁর নেতৃত্বের ফলাফল নিয়ে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি জানাতে গিয়ে খোসলা বলেন, দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দুই মাসের মধ্যে তিনি পুলিশ বাহিনীকে কাজে ফিরিয়েছেন, যা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করেছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীসহ অন্যান্য সংখ্যালঘুদের সুরক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছেন। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করেছেন। সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করতে আঞ্চলিক শক্তিগুলোকে পরামর্শ দিয়েছেন এবং বাংলাদেশের ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা আনার ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে (যেটি তিনি দায়িত্ব গ্রহণের সময় বিশৃঙ্খলার মধ্যে ছিল)।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে কার্যকরভাবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। নিউইয়র্কে থাকাকালে বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে ৫০টির বেশি ফলপ্রসূ বৈঠক করেছেন।
খোসলা আরও বলেন, ‘আমি তাঁকে (ড. ইউনূস) তাঁর ক্যারিয়ারজুড়ে যে মূল্যবোধ ও কর্মপদ্ধতি ব্যবহার করতে দেখেছি, এখন নতুন ভূমিকায় কাজ করার সময়ও তিনি সেভাবেই করছেন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে জাতীয় ঐকমত্য তৈরি করা, কোনটি ভালো হবে, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে বের করে নিয়ে আসা, ব্যবহারিক ও গঠনমূলক কাজে যুক্ত হতে নাগরিকদের (বিশেষ করে তরুণদের) অনুপ্রাণিত করা; ধর্ম, লিঙ্গ বা জাতি–নির্বিশেষে সবাইকে সম্মান করা এবং সর্বোপরি তিনি ৮৪ বছর বয়সী হলেও বাস্তববাদী, সেই সঙ্গে প্রচণ্ড উদ্যমীও।’
কিন্তু ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে উল্লেখ করে এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘সামাজিক ব্যবসা ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠান চালানোর চেয়ে একটি সরকারকে নেতৃত্ব দেওয়া বহুগুণ কঠিন হতে পারে। ক্ষমতাচ্যুত সরকারে সুবিধাপ্রাপ্ত গোষ্ঠী ইউনূসকে ব্যর্থ দেখতে চায়। এদিকে বছরের পর বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা আরেকটি দল (বিএনপি) দ্রুত ক্ষমতায় ফিরতে চায়। তবে আমার বিশ্বাস, ইউনূস তাঁর কাজ করে যাবেন।’
গত সেপ্টেম্বরে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়ে যৌথ চিঠি দেন ৯২ জন নোবেল বিজয়ী এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ১০৬ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী ও সুশীল সমাজের নেতারা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন বিনোদ খোসলাও।
সেই চিঠিতে বলা হয়েছিল, ‘শেষ পর্যন্ত সমগ্র দেশের, বিশেষ করে সবচেয়ে প্রান্তিক মানুষদের জন্য ড. ইউনূস স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন। এতে আমরা আনন্দিত।’
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রথম দিকের সাফল্য তাঁর বর্তমান দায়িত্বে ভূমিকা রাখবে, যা বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য শুভসূচনা। ব্যর্থ বাংলাদেশের তুলনায় একটি সফল বাংলাদেশ ভারতের শক্তিশালী মিত্র হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
বিনোদ খোসলা বলেন, ‘আমাদের সবার উচিত ইউনূসের এই গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্বর্তীকালীন ভূমিকার অগ্রগতি অব্যাহত রাখার দিকে মনোনিবেশ করা। কারণ, বাংলাদেশ সম্ভাবনার বিকাশ ঘটাতে পারলে ভারতের সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষিত হবে।’