দাপ্তরিক কাজে বুধবার রাজশাহী থেকে নওগাঁয় যাচ্ছিলেন এনামুল হক। পথে দেখা পান র্যাবের একটি টহল দলের। তিনি নিজের একটি সমস্যার কথা টহল দলের ইনচার্জকে বলেন। সঙ্গে সঙ্গে র্যাব অভিযান চালিয়ে এক নারীকে আটক করে। সেই নারী হলেন নওগাঁর একটি ইউনিয়ন ভূমি অফিসের সহকারী সুলতানা জেসমিন। আর এনামুল হক হচ্ছেন রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক।
র্যাবের হাতে আটকের পর অসুস্থ হয়ে পড়লে সুলতানা জেসমিনকে প্রথমে নওগাঁ মেডিকেল কলেজ এবং পরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। পরদিন বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজশাহী নগরের রাজপাড়া থানায় তাঁর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন এনামুল হক। সুলতানা জেসমিন তখন অচেতন অবস্থায় হাসপাতালের আইসিইউতে। পরদিন শুক্রবার তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
মামলার এজাহারে এমন বর্ণনা দিয়েছেন বাদী এনামুল হক।
জেসমিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনিসহ কয়েকজন বাদীর পরিচয় ও পদবি ব্যবহার করে ভুয়া ফেসবুক আইডি খোলেন। এরপর চাকরি দেওয়ার নামে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে টাকাপয়সা হাতিয়ে নিয়েছেন।
তবে জেসমিনের মামা নাজমুল হক বলেন, তাঁর ভাগনি মোবাইল ও কম্পিউটার ঠিকমতো ব্যবহারই করতে পারতেন না। এ জন্য অফিসের সহকর্মীদের কাছে তাঁকে কথা শুনতে হতো। তাঁর যে জীবনাচরণ ছিল, তাতে অন্যের নামে ফেসবুক আইডি খুলে প্রতারণা করা অসম্ভব।
জেসমিনের (৩৮) বাড়ি নওগাঁ সদরের হাজি মনসুর রোডে। এ মামলায় জেসমিন ছাড়াও মো. আল আমিন (৩২) নামের একজনকে আসামি করা হয়েছে। তাঁর বাড়ি চাঁদপুরের হাইমচরে। আল আমিন সম্পর্কে সুলতানা জেসমিনের স্বজনেরা বলছেন, এই নামের কারও সঙ্গে সুলতানার পরিচয় ছিল, এটা তাঁদের জানা নেই। মামলায় অজ্ঞাতনামা আরও দু-তিনজনকেও আসামি করা হয়েছে।
নওগাঁ সদর থানার ওসি ফয়সাল বিন আহসান জানান, তাঁরা জেসমিনের বিরুদ্ধে এর আগের কোনো মামলার তথ্য পাননি।
র্যাবের হেফাজতে মারা যাওয়া জেসমিনের ময়নাতদন্ত (পোস্টমর্টেম) প্রতিবেদনসহ সংশ্লিষ্ট নথিপত্র দেখতে চেয়েছেন হাইকোর্ট। রাষ্ট্রপক্ষকে এসব কাগজ ও তথ্য আজ মঙ্গলবার আদালতে দাখিল করতে বলা হয়েছে।
সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনায় উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন। তারা বলেছে, মামলা দায়েরের আগে আটক, বেআইনি জিজ্ঞাসাবাদ ও পুলিশকে না জানানো সংবিধান, মানবাধিকারের মূলনীতি, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা ও বিদ্যমান আইনের লঙ্ঘন। আর এটি ক্ষমতার অপব্যবহারের নিকৃষ্ট উদাহরণ। তাদের অভিমত, আগের ঘটনাগুলোর আইনগত প্রতিকার না হওয়ায় বারবার একই ঘটনা ঘটছে।
এজাহারে বাদী যা বলছেন
বাদী এনামুল হক এজাহারে বলেছেন, মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে তাঁর নামে ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলেছিলেন জেসমিন ও তাঁর সহযোগীরা। ওই আইডিতে সরকারি কাজ বাস্তবায়নের সময় তোলা তাঁর (এনামুল) ছবি শেয়ার করছিলেন তাঁরা। ১৯ মার্চ রাজশাহী মহানগরের রাজপাড়ায় তাঁর কার্যালয়ের সামনে চাকরি দেওয়ার নামে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার তথ্যও তিনি পেয়েছেন। এসব অর্থ জেসমিন নিজের ব্যাংক হিসাব এবং মুঠোফোনে আর্থিক সেবার হিসাবে লেনদেন করতেন বলেও জানতে পেরেছেন। এতে তাঁর (এনামুল) সম্মানহানি হয়েছে।
এজাহারে এনামুল হক উল্লেখ করেন, দাপ্তরিক কাজে নওগাঁয় যাওয়ার সময় তিনি গত বুধবার সোয়া ১১টার দিকে নওগাঁ বাসস্ট্যান্ডে র্যাবের একটি টহল দলকে বিষয়টি জানান। ওই দলের ইনচার্জ ডিএডি মো. মাসুদ বিস্তারিত শুনে জানান, এ ধরনের অপরাধ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় পড়ে। পরে র্যাব কর্মকর্তারা তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় সুলতানা জেসমিনের অবস্থান শনাক্ত করেন। এনামুল হককে সঙ্গে নিয়ে নওগাঁ শহরের মুক্তির মোড় এলাকা থেকে ১১টা ৫০ মিনিটে জেসমিনকে আটক করে র্যাবের দলটি। তাঁর কাছ থেকে একটি মুঠোফোন উদ্ধার করা হয়। এ সময় জিজ্ঞাসাবাদে তিনি প্রতারণার বিষয়টি র্যাবের কাছে স্বীকার করেন। তাঁর মুঠোফোনেও এসব প্রতারণার তথ্য–প্রমাণ পাওয়া যায়। জিজ্ঞাসাবাদের একটা পর্যায়ে জেসমিন অসুস্থ হয়ে পড়েন।
মামলা করতে বিলম্ব হওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, জেসমিন অসুস্থ হওয়ায় তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা ও শারীরিক অবস্থার পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি বিষয়টি নিয়ে তিনি (বাদী) স্বজনদের সঙ্গে আলোচনা করেন। পরে মামলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে র্যাবের সহযোগিতায় থানায় এজাহার করেন।
এ বিষয়ে বক্তব্য নেওয়ার জন্য একাধিকবার মামলার বাদী এনামুল হকের ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
জেসমিনের লাশের ময়নাতদন্ত করেছেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান কফিল উদ্দিনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি চিকিৎসক দল।
ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে কী পাওয়া গেছে, জানতে চাইলে কফিল উদ্দিন বলেন, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন সরাসরি বিচারিক কাজের সঙ্গে জড়িত। এ প্রতিবেদন সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত কোনো তথ্য দেওয়া যাবে না। সম্পূর্ণ করতে তাঁদের একটু সময় লাগবে।
তবে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে দেওয়া মৃত্যুসনদে উল্লেখ করা হয়েছে, মাথায় আঘাতের কারণে জেসমিন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। শুক্রবার সকাল ১০টায় তিনি মারা যান। মৃত্যুর কারণ হিসেবে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রাজপাড়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) রুহুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, মামলার আরও আসামি রয়েছে। তদন্ত সাপেক্ষে তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
র্যাবের ভাষ্য
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন প্রথম আলোকে বলেন, সুলতানা জেসমিন একজন প্রতারক। তদন্তে প্রতারণার প্রাথমিক তথ্য-প্রমাণ পাওয়ার পরই তাঁকে আটক করা হয়। আটকের পর র্যাবের ক্যাম্পে নেওয়ার আগেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাৎক্ষণিকভাবে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। চিকিৎসক জানিয়েছেন, তিনি হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
‘মা চক্রান্তের শিকার’
জেসমিনের সঙ্গে তাঁর স্বামীর ছাড়াছাড়ি হয় ১৭ বছর আগে। পরে তিনি আর বিয়ে করেননি। তাঁর একমাত্র ছেলে শাহেদ হোসেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী।
শাহেদ হোসেন বলেন, ‘আমার মা চক্রান্তের শিকার হয়েছেন। আটক হওয়ার আগে মা সুস্থ ছিলেন। র্যাবের সদস্যরা আটকের পর মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর সঙ্গে কী হয়েছে জানি না। তাঁর ওপর নির্যাতন করা হলে, যাঁরা দায়ী, তাদের বিচার চাই।’