নৌকায় শৈল্পিক জীবনের কথকতা

শিল্পী ওয়াকিলুর রহমানের ‘মনন খনন’ শীর্ষক শিল্পকর্ম প্রদর্শনীতে দর্শনার্থীরা। গতকাল সন্ধ্যায় ধানমন্ডির বেঙ্গল শিল্পালয়েছবি: দীপু মালাকার

আবছায়াময় ঘরের ছাদ থেকে ঝুলছে এক বিশালকায় নৌকার কঙ্কাল। কঙ্কাল বলার কারণ নৌকাটির দুই পাশে গলুই নেই। পাটাতনও নেই। আলকাতরা লাগানো নতুন নৌকার খোলটি খণ্ড খণ্ড করে কাটা। সেগুলো ছাদের সঙ্গে তার দিয়ে আটকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে মেঝের মাঝবরাবর। সেটির তলায় বিছিয়ে রাখা কালো পোড়ামাটির এক সারি শব্দ-অক্ষর। নদীতে নৌকা চলার সময় পাশ দিয়ে যেসব জলজ উদ্ভিদ ও হরেক রকম বস্তুনিচয় ভেসে যায়, ছায়া পড়ে মেঘের, মাঝিমাল্লা, যাত্রী বা মালামালের প্রতিচ্ছবি পড়ে। অনেক সময় এই শব্দগুলো যেন প্রকাশ করেছে সেই ব্যঞ্জনা। 

নৌকাটির এক পাশে আছে পোড়ামাটির ফলকে তৈরি পদচ্ছাপ। নদীতীরের কাদামাটিতে হেঁটে গেলে যেমন পায়ের ছাপ পড়ে, তেমনি। পোড়ামাটির কালো ফলকের এই পদচ্ছাপের সারি। এর দু-একটিতে সাদা বা হালকা গোলাপি বালুর আভা; যেমন চরাঞ্চলে থাকে। টেরাকোটার বালুচর এসে শেষ হয়েছে নৌকার সামনে। এই পদচ্ছাপখচিত বালুচর, নৌকা আর তার তলার শব্দমালা—এসব মিলিয়ে সৃষ্টি হয়েছে জীবন ও প্রকৃতির কাব্যিক কথকতা। এসব নিয়েই শিল্পী ওয়াকিলুর রহমানের ভাস্কর্য স্থাপনা শিল্পকর্ম প্রদর্শনী শুরু হলো গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় ধানমন্ডির বেঙ্গল শিল্পালয়ে।

‘মনন খনন’ নামের এই দৃশ্য শিল্পকর্মের প্রদর্শনীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন শিল্পসমালোচক অধ্যাপক আবুল মনসুর। তিনি বলেন, ‘ওয়াকিলুর রহমান ন্যূনতম উপকরণ ব্যবহার করে নিজের শিল্পভাবনা উপস্থাপন করেন। এটি তাঁর বিশেষ বৈশিষ্ট্য। তাঁর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো তিনি বাস্তবানুগ রীতিতে শিল্পকে উপস্থাপন না করে অনেকটা বিমূর্ত বা নির্বস্তুক উপায়ে তাঁর ভাবনার প্রকাশ করেন। এই প্রদর্শনীতে তিনি নৌকাকে উপস্থাপন করেছেন ভিন্ন আঙ্গিকে।

নৌকা আমাদের দেশের জনজীবন, যোগাযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প–সাহিত্য থেকে আধ্যাত্মিকতায় নানাভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। নৌকাকে তাঁর আপন পরিপ্রেক্ষিত থেকে তুলে এনে অর্থাৎ নদী থেকে পৃথক পরিবেশে ডাঙায় প্রদর্শনী কক্ষের ভেতরে আলাদা উপস্থাপন করায় একটি আলাদা দ্যোতনা সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়গুলো অবলম্বন করে তাঁর শিল্পভাবনার প্রকাশ ঘটেছে এই প্রদর্শনীতে।’

শিল্পী ওয়াকিলুর রহমান বলেন, তিনি বরাবরই সমকালীন শিল্পকলার উপস্থাপনায় স্থানীয় উপকরণ ও দেশজ অনুষঙ্গ প্রয়োগ করে থাকেন। এবারের প্রদর্শনীতেও তিনি কাদামাটি, নৌকা ও আলোছায়া—এই তিন উপকরণই ব্যবহার করেছেন। আমাদের নদীবিধৌত জনপদে নৌকা মানুষের জীবনযাপনের সঙ্গে অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। সেই চর্যাপদের কাল থেকে এখন পর্যন্ত সংগীত, শিল্প, মরমি চেতনায় নৌকার প্রতীক উপমা নানাভাবে উদ্ভাসিত হয়েছে। তবে নৌকার এখন অনেক বিবর্তন হয়েছে। প্রযুক্তির প্রয়োগে নৌকা হারিয়েছে পাল। গুন টানা নেই। লগি-বৈইঠার ব্যবহারও সীমিত। এসব একরকমের বিপণ্নতার বোধও সৃষ্টি করেছে তাঁর ভাবনায়। সঙ্গে আছে প্রদর্শনী কেন্দ্রের পরিসরটিকে শিল্পসামগ্রীর সঙ্গে সাযুজ্যময় করে ব্যবহারের নিরীক্ষা। আছে আলো–ছায়ার দ্বন্দ্ব। এই প্রদর্শনী কক্ষটিতে দিনের স্বাভাবিক আলো আসে প্রচুর। সেই আলোয় নৌকা নিয়ে সৃষ্ট ভাস্কর্যগুলো একরকম দেখায়। আবার বেলা পড়ে এলে ম্লান আলোয় বা সন্ধ্যার পরে বৈদ্যুতিক আলোয় ভিন্ন রকম। আলো–ছায়ার এই নান্দনিক রূপটি তিনি ধরতে চেষ্টা করেছেন প্রদর্শনীতে।

প্রদর্শনীতে শিল্পকর্ম রয়েছে ১১টি। সব কটিই নৌকা নিয়ে। কোথাও নৌকার গলুই মেঝের ওপর খাড়া করে রাখা। লগি-বৈইঠা-হাল আছে, নৌকার বিভিন্ন অংশ আছে কোনোটি শোয়ানো, কোনোটি হেলান দেওয়া। এগুলোয় ঘনত্ব, পুরুত্ব, কাঠিন্য বা পেলবতার মতো বিষয়গুলোও তুলে ধরা হয়েছে উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে। প্রদর্শনীটি চলবে আগামী ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, রোববার ছাড়া প্রতিদিন বিকেল চারটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত। প্রদর্শনীতে এলে দর্শকের ভিন্নমাত্রার এই নৌকা পরিভ্রমণ আনন্দময় হবে।